প্রবন্ধ ২

পৃথিবী বদলেছে, বাংলা একটু বদলাক

এ রাজ্যে জীবনের একটি অঙ্গ গণতন্ত্রের নামে মিছিল বার করা। একটি মিছিল হলে ইদানীং আবার কাউন্টার মিছিল হয়। মিছিল-দাদা এবং মিছিল-দিদিরা বাঙালিকে একটু এগোতে দিন না, প্লিজ! ভারতবর্ষের গণতন্ত্র খুবই সক্রিয় এবং তীব্র। কিন্তু গণতন্ত্রের গতি বহুরূপী এবং পশ্চিমবঙ্গের রূপটি বড়ই বিচিত্র। এ রাজ্যে দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গণতন্ত্রের নামে মিছিল বার করা। একটি মিছিল হলে ইদানীং আবার কাউন্টার মিছিল হয়।

Advertisement

বিকাশ সিংহ

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share:

এ রাজ্যে জীবনের একটি অঙ্গ গণতন্ত্রের নামে মিছিল বার করা। একটি মিছিল হলে ইদানীং আবার কাউন্টার মিছিল হয়। মিছিল-দাদা এবং মিছিল-দিদিরা বাঙালিকে একটু এগোতে দিন না, প্লিজ!

Advertisement

ভারতবর্ষের গণতন্ত্র খুবই সক্রিয় এবং তীব্র। কিন্তু গণতন্ত্রের গতি বহুরূপী এবং পশ্চিমবঙ্গের রূপটি বড়ই বিচিত্র। এ রাজ্যে দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গণতন্ত্রের নামে মিছিল বার করা। একটি মিছিল হলে ইদানীং আবার কাউন্টার মিছিল হয়। মাঝে মাঝে সংশয় হয়, পার্টি রাজনীতির সঙ্গে এই মিছিলের লোকেদের সম্পর্ক কতটা পাকা।

মিছিলের লোকসংখ্যা হল সাফল্যের আর একটা মাপকাঠি, মহাসংগ্রামের একটি সিগনাল। মিছিল না করলে গণতন্ত্রের তেজ ফুস হয়ে যাবে। কিন্তু নেতারা, যাঁরা অনেক ক্রিয়েটিভ এবং অরিজিনাল বুলির মাধ্যমে মিছিলের প্রাণশক্তি জোগান দেন, তাঁরা ওই মিছিলের নেশায় সাধারণ মানুষের জীবন যে নাজেহাল করে ছাড়ছেন, সেটা এক বার ভেবে দেখেছেন কি?

Advertisement

বহু মানুষ, যাঁরা সাধারণ কর্মস্থানের দিকে যাচ্ছেন, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। বাড়িতে নবীন পড়ুয়াদের যদি পরীক্ষা থাকে, তা হলে মায়েদের করুণ চেহারা চোখে দেখলে মায়া লাগে। এক দিকে পরীক্ষার করালগ্রাস আর অন্য দিকে ধিক্কার মিছিলের উদ্যম ডাক, বাঙালি মাঝখানে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে। ভাবি, সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি এই ধৈর্য কোথা থেকে পেল? এত বিপ্লব থাকতেও? ট্রাফিক আটকে যাওয়া বাসের যাত্রীরা, স্রেফ অসম্ভব দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে তো বিপ্লবে নামতে পারে!

ইদানীং দেখছি, গণতন্ত্রের তীব্রতা এতই বেড়ে গেছে যে সারা বছর ধরেই ভোট আর বিপ্লব লেগেই আছে। আজকে পুরসভার ভোট, আগামী কাল পঞ্চায়েতের ভোট, এক সপ্তাহের মধ্যেই বাই-ইলেকশন, তার পরেই বড় ইলেকশন, জেনারেল ইলেকশন-এর দামামা। রাজ্যের ইলেকশন তো এল বলে। রাজ্য চালাবার সময় কোথায়? কিন্তু এত মিছিল আর বক্তৃতার ঠেলায় অ্যাডমিনিস্ট্রেশন তো চুলোয় যাবে! বোধ হয় সময় এসেছে যখন প্রতিবাদ মিছিলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদ, প্রতিবাদ মিছিল’ বার করতে হবে, শান্তিপ্রিয়, কাজ-করতে-চাওয়া মানুষদের জন্যে।

নিজের কথা বলি। মুর্শিদাবাদের লোকেরা বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি রাজনীতির ধারেকাছে নেই: ‘সে কী, (বিস্ফারিতনয়‌নে) আপনি অতীশবাবুর ভাই না!’ বলি, ‘এই গণতন্ত্রই তো আমাকে নাগরিক করেছে, স্বাধীনতা দিয়েছে আমার পেশা নির্বাচনের। তার সম্মান রাখাই তো আমার কাজ’। ‘ও সব বড় বড় কথা ছাড়ুন, কাজের কথায় আসুন।’

হ্যাঁ, এক সময় বাংলার কৃষ্টি খুব উঁচু মাপের ছিল, কিন্তু রাজনীতি এবং মিছিলের অদম্য প্রভাবে তার বারোটা বেজেছে। রাজনীতি, জীবনের তনুতে অণুতে ঢুকে পড়েছে, যেখানেই চোখ খুলবেন সেইখানেই রাজনীতির বিচিত্র লীলা— এইটেই তো জীবন! কালিদাকে আর স্মরণ করলুম না। কোনও একটি মানুষকে দোষ দেব না, এইটেই গণতন্ত্রের গড্ডলিকাপ্রবাহ। অন্তত বাংলায়।

১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছই, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ইংল্যান্ডে কমিউনিজম নামক একটা ফ্যাশনের ঢেউ উঠেছিল। যাঁরা এই ঢেউয়ে সাঁতার কাটতেন, তাঁরা মোটামুটি উচ্চমধ্যবিত্ত, কম করে। ব্যক্তিগত জীবন মন্দ নয়, কিন্তু বাইরে ভাব অন্য রকম। পীড়িত, গরিবের জন্যে মন-হৃদয় কাঁদছে, রাশিয়া একমাত্র সামাজিক সমাধান, ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিষ্কার আরামকেদারার সাম্যবাদ। আমি নিজেকেও এই মোহ থেকে একেবারে ছাড়াতে পারিনি। তখন ভেবেছিলুম, এত রোম্যান্টিক! প্রোফুমো স্ক্যান্ডালের মাথায় চড়ে হ্যারল্ড ম্যাকমিলান-এর সরকারকে হারিয়ে হ্যারল্ড উইলসন ঢুকলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ইংল্যান্ডের ট্রেড ইউনিয়নরা তখন রাজা, অনেকটা বাংলার সিপিএম-এর আমল।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। আমার তখনকার কলেজ কিংস, স্ট্র্যান্ড-এর ওপরে, ১৯৬৭-র পর। তারিক আলি তখন বামপন্থীদের বড় প্রিয়। সুপুরুষ চেহারা। তিনি মিছিল করতেন, ফ্লিট স্ট্রিট থেকে, সাংবাদিকরা সে কালে ওইখানেই বসতেন। বামপন্থী পত্রিকাগুলোর সম্পাদক ছিলেন, বলা যেতে পারে দ্য ডারলিং অব দ্য মিডিয়া। অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাপতি, সুন্দর বক্তা। কোল মাইনস-এর মিছিলেও তিনি সর্বেসর্বা, পীড়িত মানুষের নেতা। বেশ কয়েক বছর পরে মার্গারেট থ্যাচার প্রধামন্ত্রী হয়ে এলেন, ট্রেড ইউনিয়নদের রমরমা অন্তিমে। ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক পরিবেশ উন্নতির দিকে এগোতে আরম্ভ করল। অকালবৃদ্ধ তারিক আলি হাইড পার্কে বক্তৃতাবাজি নিয়ে থাকলেন।

রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মিছিল একেবারেই যে হত না, তা নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ রুজি রোজগারের চাপে ব্যস্ত। কাজেই রাজনীতির দোহাইয়ে রাস্তায় ভিড়ভাড়াক্কা হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। নেতারা বুঝে গেলেন যে এই সব কম্ম করলে ভোট কম পাবেন। আর আলু ভাজা, মাছ ভাজা ফোকটে খাবার প্রবৃত্তি অনেক দিন আগেই ইংল্যান্ডে শেষ হয়েছে। মূল কথা, আমার কাছে পরিষ্কার হল যে নাগরিকদের সেল্ফ রেসপেক্ট খুব উঁচু মাপের, খাবার ঘুষ তাদের মন ঘোরাবে না।

১৯৭৬ সালে রাজা রামান্নার সৌজন্যে মুম্বইতে ফিরে এলুম। দীর্ঘ বারো বছর ইংল্যান্ডে থাকার পরে। নতুন জীবন শুরু হবে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে। তখন অবশ্য ইমার্জেন্সি চলছে। সব চুপচাপ। ভয়ে মানুষ কাঁপছে। মোর্চা, মিছিলের তো কোনও বালাইই নেই। মুম্বইয়ের মানুষ রোজগারের ধান্দায় খুব ব্যস্ত। রাজনীতি এমন একটা গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে এসেছে, যে কে মুখ্যমন্ত্রী তাও অনেকেই জানে না। কিন্তু জে আর ডি টাটাকে সবাই চেনে। বিড়লাদের সবাই চেনে। মুম্বইওয়ালাদের পরিষ্কার উপলব্ধি যে টাটা, বিড়লারাই সমাজকে অনেক দিয়েছে। অম্বািনরা তখনও নাচঘরে পৌঁছননি।

কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নগুলো বেশ ভাল ভাবেই ছিল। টাটা ইনস্টিটিউটে মহারাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন খুব সতেজ। কিন্তু তারা টাটা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল চাইত। জানত, টাটা ইনস্টিটিউটের উন্নতি হলে ওদেরও উন্নতি হবে। ‘চলবে না, চলবে না’ কখনও শুনিনি। চালানোটাই ওদের উদ্দেশ্য, সামঞ্জস্য বজায় রেখে।

ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে জলের খুব কষ্ট। চেয়ারম্যান হোমি ভাবার গাড়ি আটকে বাড়ির মহিলারা খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, কিছু একটা সুরাহা করুন স্যর। সাত দিনে নতুন মোটা পাইপ বসিয়ে ব্যবস্থা হল। লক্ষ করলুম, বিদ্রোহ আর মিছিল আর কাউন্টার মিছিল মুম্বইয়ের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। আজকে সেই মুম্বই ভারতের কমার্শিয়াল রাজধানী, যেটা কলকাতা ছিল একশো বছর আগে।

দিন পালটেছে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পালটেছে, পৃথিবী পালটেছে, এ বার বাংলা একটু পালটাক। এই সামান্য বিনীত অনুরোধ। আর শুনুন, শহিদ মিনারটাকে তুলে নিয়ে রাজারহাটে ‘বিপ্লব অঙ্গন’-এর জমিতে ভাল করে বসান। মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। মানুষকে মাছ-ভাতের লোভ দেখিয়ে বশ করবেন না, আজকের মানুষ মর্যাদা বোঝে। গণতন্ত্রের এটাই তো মুখ্য লক্ষণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement