বক্রেশ্বর ধাম। নিজস্ব চিত্র
সতীপীঠ হিসাবে বিশেষ খ্যাতি রয়েছে বীরভূম জেলার। একই সঙ্গে এ জেলাতেই রয়েছে বেশ কয়েকটি শৈবক্ষেত্র। কলেশ্বর, বক্রেশ্বর, রাখড়েশ্বর, জুবুটিয়া, ডাবুক, কবিলাশপুরের মতো শৈবক্ষেত্রগুলি বেশ প্রাচীন। এ সব স্থানের মন্দিরগুলির নির্মাণশৈলী, প্রত্নগুরুত্ব এবং কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য শুধু পুর্ণ্যার্থীদের নয়, গবেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিভিন্ন সময়ে। মন্দির বা মন্দিরের দেবতাকে ঘিরে প্রায় সারা বছরই হয়ে থাকে নানা উৎসব অনুষ্ঠান। তবে অধিকাংশ শৈবতীর্থই জমে ওঠে শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রির সময়।
জেলার অন্যতম পর্যটনস্থল তথা তীর্থক্ষেত্র বক্রেশ্বর। শিবরাত্রি উপলক্ষে সবচেয়ে বড় মেলাটি হয় বক্রেশ্বরেই। আর ক’দিন পরেই শুরু সেই মেলা। সরকারি হিসাবে এই মেলার স্থায়িত্ব যাই হোক না কেন, অন্তত আট দিন ধরে মানুষজন মেলায় আসেন। এর প্রধান কারণ কিন্তু স্থানটির দেব মাহাত্ম্য। পুরাণ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে গল্পের আকারে রয়েছে এই মাহাত্ম্যের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। পুরাণে। তবে একটা বিষয়ে সবাই একমত, ঋষি অষ্টাবক্রের নামেই এই পীঠস্থানের নাম বক্রেশ্বর।
একটি বর্ণনা অনুসারে— ‘‘শান্ত স্নিগ্ধ মনোরম একটি সকালে নিজের আশ্রমে বসে ঋষিবালকদের পাঠ দিচ্ছেন কাহোড় মুনি। পাশে স্ত্রী সুজাতা। গর্ভবতী। পাঠদানের সময় হঠাৎই স্ত্রী সুজাতার একটি অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বিরক্ত হলেন মুনিবর। ক্ষুব্ধ হয়ে এই আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। উত্তরে সুজাতা কাহোড় মুনিকে বললেন, ‘প্রভু আমাদের গর্ভের সন্তান বলতে চাইছে, আপনার পাঠদানে কিছু ভুল রয়েছে’। শিক্ষার্থী আশ্রমবালকদের সামনে গর্ভস্থ সন্তানের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হলেন কাহোড় মুনি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অভিশাপ দিলেন, এই শিশু জন্মলাভ করবে অষ্টঅঙ্গ বিকৃতি নিয়ে। সেই অভিশাপের জেরেই শিশু ভূমিষ্ঠ হল আটটি অঙ্গ বাঁকা অবস্থায়। অষ্টঅঙ্গ বাঁকা, তাই তাঁর নাম হল অষ্টাবক্র’’। বিবরণে পাওয়া যায়, এই অষ্টাবক্র তাঁর অঙ্গ বিকৃতি দূর করার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। উদ্যেশ্য মহাদেবকে তুষ্ট করা। ষাট হাজার বছর তপস্যা করার পরে মহাদেব প্রকাশ হলেন এবং তুষ্ট হয়ে অষ্টাবক্রের স্বাভাবিক দেহ ফিরিয়ে দিলেন। অষ্টাবক্র আরাধিত মহাদেব, তাই মহাদেবের নাম হল বক্রেশ্বর। এবং মহাদেবের নাম অনুসারেই অষ্টাবক্রের এই তপস্যাস্থলেরও নাম হল বক্রেশ্বর।
এক সময় এই বক্রেশ্বর ছিল গভীর জঙ্গলে ঢাকা। ছিল হিংস্র জীবজন্তুর ভয়। আস্তে আস্তে রাজারাজরাদের নজরে আসে বক্রেশ্বর। প্রচারিত হয় দেবমাহাত্ম্য। দেবতাদের সেবা, পুজোর ব্যবস্থা করার জন্য এই রাজারাই জনবসতি গড়ে তোলেন এখানে। শুরু হয় নানা লোকাচার। দেবস্থানকে ঘিরে শুরু হয় নানা উৎসব অনুষ্ঠান। এ সব উৎসবের মধ্যেই এসে পড়ে শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। সাধারণের বিশ্বাস, এই দিনেই শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়। স্বভাবতই ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমশ। এই ভিড় এক সময় মেলার চেহারা নেয়। এ ভাবেই সূচনা হয় বক্রেশ্বর শিবরাত্রি মেলার।
এই মেলার শুরুর দিকে তেমন রাস্তাঘাট বা যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না। দূরদূরান্তের মানুষ আসতেন হেঁটেই। পরবর্তী সময়ে ঘোড়ার গাড়ি ও গোরুর গাড়ি চালু হয়। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগেও ছিল এই অবস্থা। সিউড়ি-বক্রেশ্বর রাস্তায় বক্রেশ্বর নদের উপরে সেতু তৈরি হয়নি তখনও। তাই শহর-বাজারের সঙ্গে যোগাযোগহীন গ্রামীণ মানুষ জনের সারা বছরের ঘর গেরস্থালির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, চাষবাসের সরঞ্জাম কেনাকাটায় এই মেলাই ছিল ভরসা। সারা বছরের বিনোদন বলতেও ছিল এই মেলা এবং মেলায় আসা সার্কাস, সিনেমা, ম্যাজিক, চিড়িয়াখানা, পুতুলনাচ, মরণকুয়ো, নাগরদোলা, মৎস্যকন্যা, বিদ্যুৎকন্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁবু খাটানো অস্থায়ী সিনেমা হলে মাটিতে বসে ছবি বিশ্বাস, ছায়াদেবীদের সিনেমা দেখতেন মেলার মানুষ। বসত অস্থায়ী ছবি তোলার স্টুডিও। যেখানে সেজেগুজে এসে গ্রামের মেয়ে-বউ ছেলেপুলেরা পিচবোর্ডের তৈরি নকল মোটরগাড়ি বা নকল মোটরসাইকেল চড়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলতেন। স্টুডিয়োর বাইরে সাদা কাপড়ের দেওয়ালে টাঙানো থাকতো সদ্য তোলা সেই সব সাদাকালো ছবি। এখনকার বাসস্ট্যান্ড থেকে মূল মন্দির পর্যন্ত প্রায় চারশো মিটার রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে বসত দোকানপাট।
স্থানীয় ভাষায় এক একটা পসরার পরপর অবস্থানকে বলা হত পটি। কাপড়ের পটি, জুতোর পটি, মনোহারির পটি, কলার পটি, লোহার পটির মত বিভিন্ন পটি সাজিয়ে তুলত এই মেলাকে। লাল, নীল, সবুজ গেলাসে রঙিন সরবত, ছোট ছোট কাঁসার বাটিতে রঙবেরঙের পানমশলায় সাজানো পানের দোকান, বাঁশি আর বেলুনের চলমান হাঁকডাক ছিল মেলার অন্যতম আকষর্ণ। ছোট ছোট দোকানগুলিতে সন্ধ্যে হলেই জ্বলে উঠত লম্বাদণ্ডের গ্যাসের আলো। কী পাওয়া যেত না মেলায়! মাছ ধরার জাল, পোলুই, ঘুণি থেকে শুরু করে শিল, নোড়া, পাথরবাটি, ঝুড়ি, পেছে, চাল ধোয়ার টোকা, ঘণ্টা, শাঁখ, পূজার থালা— এক কথায় দৈনন্দিন ব্যবহারের সমস্ত সামগ্রী। থাকত বইয়ের দোকানও। যেখানে নিত্যপূজাপদ্ধতি থেকে ব্রতকথা, গোপালভাঁড়ের পাশাপাশি বিক্রি হত শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, নীহাররঞ্জন। ভিড়ের মধ্যেই মাথায় টুপি, পায়ে ঘুঙুর নাচিয়ে সুর করে পাঁচালি শুনিয়ে বিক্রি হত পারিবারিক কেচ্ছাকাহিনির চটি বই। শান্তি এবং স্বাস্থ্যরক্ষায় মোতায়েন পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভিড়, মাইকে ঘনঘন স্বজন হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা—মেলাটিকে অন্য মাত্রা দিত।
এ সবই অতীতের ছবি। প্রযুক্তির আগ্রাসী থাবা মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা এবং রুচির যেমন পরিবর্তন এনেছে, তেমনই পরিবর্তন এনেছে মেলার চরিত্রেও। ‘অনলাইন’ -এ চটজলদি কেনাকাটায় অভ্যস্ত নতুন প্রজন্ম এখন তাকায় না মেলায় আসা চশমা, ঘড়ি, জামা জুতোর দিকে। স্বভাবতই পুরনো মেলার ঐতিহ্য হারিয়েছে বক্রেশ্বরও। তবে এই মেলার ক্ষেত্রে অন্য একটা সমস্যা ও প্রকট হয়েছে। বক্রেশ্বরের ধর্মীয় গুরুত্ব এবং উষ্ণ প্রস্রবণের আকর্ষণে প্রায় সারা বছরই পর্যটকের ভিড় থাকে। ফলে মন্দিরমুখী রাস্তার দুই ধারে স্থায়ী দোকান তৈরি হয়েছে। অথচ একদিন এখানেই বসত মেলার রকমারি দোকান। যেখানে তাঁবু ফেলত সার্কাস, চিড়িয়াখানা, ম্যাজিক, পুতুলনাচেরা— নানা দখলদারির কারণে লোপাট হয়েছে সেই জায়গাও। তবু মেলা হয়। হয় সেই ধর্মীয় প্রভাবেই।
ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বক্রেশ্বর ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য গঠিত হয়েছে ‘বক্রেশ্বর উন্নয়ন পর্ষদ’। আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে বক্রেশ্বরের সেই রুগ্ণ চেহারা। সংস্কার হচ্ছে রাস্তাঘাট, দিঘি এবং উষ্ণ প্রস্রবণগুলি। সঙ্গে সঙ্গে বদল করার চেষ্টা শুরু হয়েছে বক্রেশ্বর মেলার। মেলা উপলক্ষে আসা পুণ্যার্থীদের সুযোগ সুবিধার নানা ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দখলদারি উঠিয়ে অনেকটাই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তার দু’ধারের সেই মেলা বসার জায়গাটিকে। সব মিলিয়ে এ বারের শিবরাত্রি মেলা কিছুটা হলেও পুরনো সৌরভ ফিরে পাবে, এমনই মনে করছেন প্রশাসনের কর্তারা থেকে সাধারণ মানুষ।
(লেখক সাহিত্যকর্মী ও পঞ্চায়েতকর্মী)