জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই স্তন্যপান করানো জরুরি

স্তন্যপান সম্বন্ধে জনগণকে অবগত করানোর জন্য এবং স্তন্যপানে মাকে সহযোগিতার জন্য প্রতি বছর ১ থেকে ৭ অগস্ট ‘বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ’ পালিত হয়। লিখছেন রণজিৎ দে বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পিতৃত্বকালীন ছুটি বা পেটার্নিটি লিভ অনুমোদন করে আইন পাশ করেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৯ ০০:০২
Share:

ফাইল চিত্র।

মাস আটেক আগের ঘটনা। বিকাশবাবুর স্ত্রী দিন দশেক আগে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। বিকাশবাবু অফিসে আসতেই সহকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরল। বিকাশবাবু তৈরি হয়েই এসেছিলেন সবাইকে মিষ্টিমুখ করানোর পর বড়বাবুর ঘরে গিয়ে এক মাসের একটা ‘পেটার্নিটি লিভ’এর একটা দরখাস্ত দিয়ে বসলেন। ব্যাপারটা জানতে পেরে সহকর্মীদের প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হতে হল তাঁকে। কেউ কেউ আবার টিপ্পনি কাটল— ছেলেরা যদি পেটার্নিটি লিভ নেয় তা হলে তো এখন মেয়েদের আর মেটার্নিটি লিভ নেওয়ার দরকার হবে না। বিকাশবাবু হয়তো এই প্রশ্নগুলো প্রত্যাশা করেছিলেন, তাই রাগলেন না। বরং নির্বিকার ভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বোঝাতে লাগলেন। আসলে ব্যাপারটা কী।

Advertisement

বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পিতৃত্বকালীন ছুটি বা পেটার্নিটি লিভ অনুমোদন করে আইন পাশ করেছে। অন্য অনেক রাজ্যেই তা বেশ কয়েক বছর আগেই চালু হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল মাতৃত্বকালীন ছুটি তো ছিলই, যা ইদানিং আরও বেড়েছে। তা হলে সন্তানের বাবার ছুটি নেওয়ার কী দরকার পড়ল?

এক জন মায়ের সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অনেক আশঙ্কা, ভয়, জিজ্ঞাসা দানা বাঁধে মনের মধ্যে। শরীরেরও খুব যত্ন নিতে হয়। তার মধ্যে আবার কিছু বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের তৈরি করে দেওয়া ভুল ধারণার কারণে মায়ের মনে শিশুকে স্তন্যপান করানো নিয়ে আরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। মায়েদের মনে এমন সংশয় হওয়া স্বাভাবিক যে, শিশুটি পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ পাচ্ছে না বলে কাঁদছে। তার উপর বাড়ির লোকজনেরও একই আশঙ্কা তৈরি হয়। কোনও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই কিনে আনা হয় একটা কৌটোর দুধ ও ফিডিং বোতল। ওই কৌটোবন্দি দুধ ফিডিং বোতলে ভরে খাওয়ানো শুরু হয়। কয়েক মাস পরে যখন শ্বাসকষ্ট নিয়ে শিশুকে হাসপাতালে যেতে হয়, তখন ওঁরা বুঝতে পারেন কী ভুলটাই না করেছেন।

Advertisement

ওঁদের কেউ বলে দেয়নি প্রতি বছর পনেরো লক্ষ শিশু মারা যায় নিউমোনিয়া, ডাইরিয়া, মেনিনজাইটিস ও অপুষ্টিতে। অর্থাৎ, প্রতি তিরিশ সেকেন্ডে একটি শিশু মারা যায়। চিন্তা করা যায় কী সাংঘাতিক অবস্থা! এবং এটা হয় বুকের দুধ না খাইয়ে কৌটার দুধ খাওয়ানোর জন্য।

তাই প্রশ্ন উঠবে মায়ের বুকের দুধ না হলে উপায় কি? বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সব সংস্থাই (ইউনিসেফ, আই এ পি, আই এম এ, বি পি এন আই, প্রভৃতি) একবাক্যে বলেছে ছ’মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু মাত্র মায়ের দুধই খাওয়াতে হবে। কোনও কৌটার দুধ বা অন্য জন্তুর দুধ নয়। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই নবজাত শিশুকে মায়ের দুধ ধরাতে হবে। এতে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা বজায় থাকবে আর শিশু স্তন্যপান শুরু করলে কলোস্ট্রাম পাবে, যার মধ্যে অ্যান্টিবডি থাকে।

এ তো গেল সতর্ক বার্তা। কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলে। শিশু জন্মানোর আগেই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ কৌটোর দুধের প্রেসক্রিপশন করে দেন। এর ফলে শিশু কলোস্ট্রাম যাকে জীবনের প্রথম টিকাও বলা হয়, তা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে মাতৃদুগ্ধ আসতেও দেরি হয়। রাত্রে শিশু কাঁদলেই আয়া মাসিরা কৌটোর দুধ গুলে খাইয়ে দেন। আর বেশির ভাগ সময়েই এটা হয় কোনও শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত ছাড়াই।

হাসপাতাল থেকে ছুটি হওয়ার পর শিশু কাঁদলেই মা এবং বাড়ির লোকজন স্বাভাবিক ভাবেই এটা ভাবেন যে, শিশু হয়তো পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ পাচ্ছে না, তাই সে কাঁদছে এবং কৌটোর দুধ খাওয়ানোর পর সে সাময়িক ভাবে চুপও করে যায়। অপর্যাপ্ত বুকের দুধের ব্যাপারে সবার মনের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। এবং শিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ানো বাড়তে থাকে, শিশুর ঘন ঘন ঠান্ডা লাগে, হাসপাতালে ভর্তি হয়, নেবুলাইজার ইনহেলার প্রয়োগ করতে হয়। যখন শিশুর বাবা-মা বুঝতে পারেন যে সর্বনাশা কৌটোর জন্য এই পরিণতি, তত দিনে কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

ভারতের মাত্র ৫০% শিশুকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে স্তন্যপান করানো হয়। মাত্র ৫৫% বাচ্চাকে ছয় মাস শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে স্তন্যপান করালে ২০% নবজাতকের মৃত্যু এড়ানো যায়। তা সত্ত্বেও বিশ্বের প্রায় ৭.৮ কোটি শিশু এ থেকে বঞ্চিত। ছ’মাস স্তন্যপান করালে প্রায় ৫০% শিশুদের ডায়রিয়া প্রতিরোধ হয়, ৩০% শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের সংক্রমণ কম হয়। শিশু জন্মানোর পর মাকে ঠিক ভাবে স্তন্যপানের পদ্ধতি নার্স, আয়া বা চিকিৎসকের দেখিয়ে দেওয়া দরকার। কৌটো, বিকল্প বা অন্য মায়ের দুধ খাওয়ানোর বিপজ্জনক দিকগুলো সম্বন্ধে মাকে বোঝানো দরকার।

সফল স্তন্যপান করানোর জন্য দরকার বাড়ির সকলের সহযোগিতা। বিশেষত শিশুর বাবার সহযোগিতা ও সাহচর্য একান্ত ভাবে প্রয়োজন। তাই স্তন্যপানের ব্যাপারে শিশুর পিতারও একটা সম্যক ধারণা থাকা জরুরি।

স্তন্যপান সম্বন্ধে জনগণকে অবগত করানোর জন্য এবং স্তন্যপান করাতে মাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতি বছর ১ থেকে ৭ অগস্ট, বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ পালন করা হয়। এ বছরের স্লোগান, ‘Empower Parents Enable Breastfeeding’— অর্থাৎ সফল স্তন্যপানের জন্য সন্তানের পিতামাতাকে ক্ষমতা প্রদান করা।

চিন দেশে এক পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে ১৮% মায়েরা শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান। কিন্তু স্তন্যপানের এই প্রক্রিয়ায় যদি পিতাকে সংযুক্ত করা হয় তা হলে সফল স্তন্যপান করানোর হার বেড়ে হয়ে যায় ৪০%। পিতাকে স্তন্যপানের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ আরও সফল করার জন্য সরকার পেটার্নিটি লিভ এবং মেটার্নিটি লিভের ব্যবস্থা করেছে। মায়েরা কর্মস্থলে সফল ভাবে যাতে স্তন্যপান করাতে পারে, তার জন্য breastfeeding breaks বা স্তন্যপানের জন্য বিরতি, স্তন্যপান করানোর জন্য breastfeeding room, শিশুকে মায়ের কাছাকাছি রাখার জন্য ক্রেশ, ইত্যাদি নানা পদক্ষেপ সরকারি এবং বেসরকারি দিক থেকে নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আমরা সাধারণ জনগণ আরও বেশি করে সচেষ্ট হলে তবেই শিশুকে সফল ভাবে স্তন্যপান করানো সম্ভব। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটানো যাবে।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement