এড্‌স নিয়ে সচেতনতাই মূল লক্ষ্য

এড্‌স মূলত একটি যৌন সংক্রমিত রোগ। এই রোগের জন্য দায়ী ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’ (এইচআইভি)। এইচআইভি সংক্রমণের ফলে ধীরে ধীরে আক্রান্তের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। লিখছেন আজিজুর রহমান এইচআইভি সংক্রমিত অসুখ এড্‌স মূলত একটি যৌন সংক্রমিত রোগ (সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ)। এই রোগের জন্য দায়ী ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’ নামক এক ধরনের রেট্রোভাইরাস। যা কেবলমাত্র মানুষের রক্তে ও অন্যান্য দেহরসে বেঁচে থাকতে পারে এবং কোনও সুস্থ মানুষ আক্রান্তের রক্ত বা বীর্যের মতো দেহরসের সংস্পর্শে এলে তার দেহের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৫৫
Share:

বিশ্ব এড্‌স দিবস। ফাইল চিত্র

আটের দশকে প্রথম জানা যায় যে, রোগটিকে। সে যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সারা বিশ্ব তোলপাড় করে দেবে ভয়াবহ রূপে, তা ভাবতে পারেননি কেউ। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্ব মানামানি নেই। তার করাল গ্রাসে পড়তে হয়েছে সবাইকে। উন্নত দেশগুলি এডসের বিভীষিকাকে খুব শীঘ্রই আয়ত্ত করে ফেললেও যথারীতি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এ রোগের প্রকোপ এখনও বেশি। সারা বিশ্বে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যার নিরিখে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নাইজেরিয়ার পরেই আমরা তৃতীয় স্থানে।

Advertisement

এইচআইভি সংক্রমিত অসুখ এড্‌স মূলত একটি যৌন সংক্রমিত রোগ (সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ)। এই রোগের জন্য দায়ী ‘হিউম্যান ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’ নামক এক ধরনের রেট্রোভাইরাস। যা কেবলমাত্র মানুষের রক্তে ও অন্যান্য দেহরসে বেঁচে থাকতে পারে এবং কোনও সুস্থ মানুষ আক্রান্তের রক্ত বা বীর্যের মতো দেহরসের সংস্পর্শে এলে তার দেহের মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়।

এইচআইভি সংক্রমণের ফলে ধীরে ধীরে আক্রান্তের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। তখন বিভিন্ন সুযোগসন্ধানী বীজাণুর আক্রমণে বা বিশেষ ধরনের ক্যানসারে মানুষটি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এইচআইভি সংক্রমণ থেকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া পর্যন্ত সময়টি সুনির্দিষ্ট নয়। তবে দেখা গিয়েছে, ৮-১০ বছরের মধ্যে অধিকাংশ সংক্রমিত ব্যক্তি চরম রোগ প্রতিরোধহীনতার শিকার হন। শরীরের এই বিশেষ অবস্থাকেই এড্‌স (অ্যাক্যুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সি সিনড্রোম) বলা হয়।

Advertisement

আগেই বলা হয়েছে, এইচআইভি সংক্রমণ হওয়ার মূল কারণ হল যৌন সংসর্গ। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে কোনও অসুস্থ ব্যক্তির অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক ঘটলে তার এইচআইভি সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রতিবার প্রতিক্ষেত্রে এই সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং সেই ব্যক্তিটি যদি অন্য কোনও যৌন রোগে আক্রান্ত থাকে তবে তার এইচআইভি সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া যাঁরা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বারবার ‘ড্রাগ’ নেয় এবং একই সিরিঞ্জ ও সূচ বহুজনে ব্যবহার করে, তাদেরও সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেশি। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ অন্য ব্যক্তির দেহে সঞ্চালনের ফলেও এইচআইভি সংক্রমিত হয়। কোনও এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব করলে তার সন্তানেরও অনেক ক্ষেত্রে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে।

যেহেতু এই রোগের নিরাময় যোগ্য তেমন কোনও চিকিৎসা নেই তাই একবার এইচআইভি সংক্রমিত হলে সে সারা জীবন সংক্রমিতই থেকে যায়। ফলে এডস থেকে তার মৃত্যু ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। বর্তমানে অবশ্য বহু ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং প্রচলিত হয়েছে যার মাধ্যমে এই রোগকে কিছুটা আয়ত্তে আনা যায়। তবে সেই চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যুক্ত। তবে আশার কথা তাতে রোগীদের আয়ু অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাই এই রোগকে নির্মূল করার লক্ষ্য না নিয়ে মহামারি হিসাবে দেখা দেওয়া রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। রোগটি যেহেতু মূলত ব্যবহারিক (বিহেভিয়ারাল ডিজ়িজ) তাই আমাদের যৌন ব্যবহারে যদি পরিবর্তন আনা যায় তাহলে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই ‘ন্যাশনাল এড্‌স কন্ট্রোল অর্গানিজেশন’ যে কর্মসূচি নিয়েছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের যৌন ব্যবহারে পরিবর্তন আনা। যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ যৌন জীবনযাপন করেন তাঁদের চিহ্নিত করে এইচআইভি সম্বন্ধে স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে সচেতন করা। যার ফলে রোগটি কেন কী ভাবে হয় তাঁরা যেমন জানতে পারছেন, অন্য দিকে, সেই অনুযায়ী সচেতন হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারছেন। সাধারণত, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন জীবন যাপন করতে দেখা যায় যৌনকর্মী, ড্রাগ সেবনকারী, ট্রান্সজেন্ডার মানুষজন, প্রবাসী অস্থায়ী কর্মীগন, লরি চালক ইত্যাদি। দেখা গেছে মোটামুটি ভাবে এইচআইভি সংক্রমণ এঁদের মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। যেহেতু, এঁদের আবার পারিবারিক জীবন রয়েছে ফলে সাধারণ জনগোষ্ঠীতে রোগটি এঁদের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

স্বাস্থ্য বিভাগ, ‘হু’, ‘ইউএনএড্স’ ইত্যাদি সংগঠনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এড্সের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করা গিয়েছে। সারাবিশ্বে ১৯৯৭ সালে ৩.২ মিলিয়ন নতুন এইচআইভি আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৫ তে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২.১ মিলিয়ন। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি, মহামারির অগ্রগতি থামিয়ে দেওয়া গিয়েছে। শুধু তাই নয়, বলা যেতে পারে তাকে পিছনে ঠেলে দেওয়া গিয়েছে।

আমাদের দেশেও ২০১০-১৭ সালের মধ্যে নতুন এইচআইভি সংক্রমণ হয়েছে ২৭ শতাংশ এবং মৃত্যু ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় ৮০% মানুষ জানেন তাঁর এইচআইভি সংক্রমণ হয়েছে এবং ৫৬% মানুষ তাঁর জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করেন।

ভারতে ২০১৭ সালে এইচআইভি সংক্রমণের হার ০.২২ শতাংশ যা ২০০১-০৩ সালে ছিল ০.৩৮ শতাংশ। তার পর থেকে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। ভারতের মধ্যে মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও তেলঙ্গানায় এই সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব এখনও অনেক বেশি। বর্তমান ভারতে এইচআইভি নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষ। ইউএনএড্স-এর ‘সাসটেন্ড ডেভলপমেন্ট গোল’ (এসডিজি) হল ২০৩০ সালের মধ্যে এড্স রোগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

লেখক প্রাক্তন জেলা মাতৃত্ব ও শিশু স্বাস্থ্য আধিকারিক, পুরুলিয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement