বর্তমানের একটি মুহূর্তকে ‘ঐতিহাসিক’ বলিয়া চিহ্নিত করা সহজ নহে। ১৬ জানুয়ারি দিনটি ব্যতিক্রম। এই দিন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম যে নাগরিক কোভিডের প্রতিষেধক লাভ করিবেন, তাঁহার টিকা প্রাপ্তির মুহূর্তটি বাংলার ইতিহাসে তৎক্ষণাৎ প্রবিষ্ট হইবে। কোভিডের প্রতিষেধক দানের সূচনা রাজ্যবাসী, তথা দেশবাসীর নিকট আতঙ্কমুক্ত জীবনের উদ্বোধন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গোটা বিশ্বে যত ব্যাপক ভাবে ছড়াইয়াছে, সকল দেশের দৈনন্দিন কর্মস্পন্দনকে থমকাইয়া দিয়াছে, তাহা অভূতপূর্ব। তবে নূতন ইতিহাস গড়িয়াছে মানুষও। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে নূতন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে একাধিক টিকা প্রস্তুত করিয়াছেন বিজ্ঞানীরা। এই গতি অকল্পনীয়, বিজ্ঞান তাহা বাস্তব করিল। ভারত সরকারও প্রতিষেধক প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে। তবে, মূলত এই সরকারের স্বভাবগত অস্বচ্ছতার কারণেই, সেই প্রক্রিয়া লইয়া সংশয়ও বিস্তর। কোন প্রতিষেধক কতটুকু কার্যকর, কতখানি নিরাপদ, বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রতিষেধকটি তড়িঘড়ি ছাড়পত্র পাইল কি না, এমন নানা প্রশ্ন উঠিয়াছে। বাংলায় প্রতিষেধক-আতঙ্কের ইতিহাস দীর্ঘ। উনিশ শতকের শেষে প্লেগের টিকা এমন ভয় সৃষ্টি করিয়াছিল যে রোনাল্ড রস কলিকাতায় এমন মানুষ পান নাই, যিনি সুচ ফুটাইতে রাজি। সাম্প্রতিক অতীতে পোলিয়ো টিকাকরণ কর্মসূচিও নানা বিরোধিতার মুখে পড়িয়াছে।
শনিবার কোভিড প্রতিষেধক প্রদানের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের দায়িত্ব আরও বাড়িবে। তন্মধ্যে প্রধান, প্রতিষেধক প্রাপকদের তালিকা প্রস্তুত করা। স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পরিষেবা প্রদানকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হইতেছে, তাহা সঙ্গত ও স্বাগত। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের প্রতিষেধক পাইবার ক্রম কেমন হইবে, সে বিষয়টি স্বচ্ছতা ও তৎপরতার সহিত সর্বসমক্ষে লইয়া আসা প্রয়োজন। যে সকল অসুস্থতা (কো-মর্বিডিটি) প্রাণের ঝুঁকি বাড়াইতে পারে, তাহাতে আক্রান্তদের অগ্রাধিকার দিবার প্রস্তাব হইয়াছে। আক্ষেপ ইহাই যে, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত শর্করা প্রভৃতি উপসর্গ, যাহা কোভিড-আক্রান্তের মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ায়, সেগুলি খুব কম ক্ষেত্রেই চিহ্নিত হইয়া থাকে। অধিকাংশই অনির্ণীত রহিয়া যায়। দ্বিতীয় সমস্যা, প্রথম ডোজ় প্রতিষেধক যাঁহারা পাইবেন, তাঁহাদের সকলেরই দ্বিতীয় ডোজ় যথাযথ সময়ে নিশ্চিত করিতে পারা। আটাশ দিন অন্তর দুই বার টিকা না দিলে তাহা কার্যকর হইবে না। অভিজ্ঞতা দেখাইয়াছে, যে সকল ঔষধ নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিত খাইতে হয়, যেমন যক্ষ্মার ঔষধ, সেগুলির চিকিৎসা প্রায়ই অসম্পূর্ণ রহিয়া যায়। কোভিড প্রতিষেধকের সকল প্রাপকের দুইটি ডোজ় নিশ্চিত করা জরুরি।
কঠিন কাজ যে করা সম্ভব, তাহা দেখাইল অতিমারি। যথাযথ কৌশল, শৃঙ্খলা এবং কঠোর পরিশ্রমকে মূলধন করিয়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সংক্রমণ রুখিয়াছেন, অধিকাংশ সংক্রমিতকে সুস্থ করিয়াছেন। প্রতিষেধক প্রদানই বা সফল হইবে না কেন? রাজ্যবাসীরও কর্তব্য, প্রতিষেধকের দুইটি ডোজ় সম্পূর্ণ করিতে সহযোগিতা করা। প্রতিষেধক লইয়া বিভ্রান্তি ছড়াইতে না দেওয়া। বিশেষ পণ্যবাহী বিমানে ‘কোভিশিল্ড’ প্রতিষেধক আসিয়াছে কলিকাতায়। চুয়াল্লিশ হাজার কর্মী প্রশিক্ষণ পাইয়াছেন; প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই প্রাপকের তালিকায় নাম লিখাইয়াছেন। রোগমুক্তি অভিযানের এই আরম্ভ শুভ হউক।