সাহিত্য অকাদেমি ১৯৭৫-এর শেষ দিকে দিল্লিতে রামায়ণ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক বিতর্কসভার আয়োজন করেছিল। উপলক্ষ তুলসীদাসের রামচরিতমানস-এর চারশো বছর পূর্তি। সভার বৈশিষ্ট্য ছিল, এশিয়ার যে সব দেশে প্রাচীন কালে ভারতীয় সংস্কৃতি ও রামায়ণ-কাহিনির প্রবেশ ঘটেছিল, সেই সব দেশের প্রতিনিধিবর্গের সঙ্গে ভারতীয় পণ্ডিতদের মত বিনিময় ও বিতর্ক। উদ্বোধনী ভাষণে সভাপতি আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রামায়ণের যে ‘সমস্যা’র প্রতি দৃকপাত করলেন, তার সূত্রে ১৯৭৬-এ এশিয়াটিক সোসাইটির আমন্ত্রণে কলকাতায় আরও একটি বক্তৃতা দিলেন। আচার্যের সিদ্ধান্তগুলি ছিল— রামকথার প্রধান সঙ্কলক চ্যবন; বিষ্ণু-অবতার হিসেবে রামকে প্রতিষ্ঠিত করা পরবর্তী কালের ঘটনা; বৌদ্ধ জাতকে রামকাহিনির উল্লেখ; রাম ও সীতার ভাই-বোন সম্পর্ক; সীতাহরণ কাহিনির পিছনে গ্রিক পুরাণের প্রভাব।
এর মধ্যে অনেক কথা নতুন নয়, তবু সমাজে আলোড়ন তুলে দিলেন সুনীতিকুমার। সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিবাদের ঝড়, তাঁর ‘সুধর্মা’ বাড়িতে রামভক্তদের কদর্য কটূক্তি, শারীরিক হেনস্থার হুমকির চিঠিও এল। চিঠিতে সবংশে রৌরব-বাস থেকে একমাত্র পৌত্রের জীবনহানি পর্যন্ত সব রকমের ভয়ই দেখানো হয়েছিল।
এরই মধ্যে কলকাতায় সাহিত্য অকাদেমি থেকে মাসিক সাহিত্য আলোচনার অঙ্গ হিসেবে সুকুমারী ভট্টাচার্যের মাধ্যমে সুনীতিকুমারের কাছে প্রস্তাব এল রামায়ণ নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। সুনীতিবাবু রাজি। তবে তাঁর শর্ত, তিনি একা বলবেন না, তাঁর মতের বিরুদ্ধে যাঁদের বলার আছে, আমন্ত্রণ জানাতে হবে তাঁদেরও। আয়োজকদের দ্বিধা দেখে বলেছিলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধ মতই তো শুনতে চাই। পণ্ডিতজনেরা যদি আমার মত ভুল প্রমাণ করেন আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু ভক্তবাবাজিদের আবেগের কাছে হার স্বীকার করব না।’’
১৯৭৬-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রেক্ষাগৃহে সভার দিনক্ষণ স্থির হলেও অকাদেমির এই আয়োজনের কথা শুনে কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে বিরক্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। সুনীতিবাবুর কাছে প্রতি দিন প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বেনামি চিঠি আসছে, এমনকি বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ তাঁর উপর ক্ষুব্ধ। কলকাতায় এমন রাম-বিতর্ক অভূতপূর্ব। বিতর্কের কেন্দ্রে যিনি, প্রকাশ্য সভাতে ফের রামায়ণ নিয়ে বলতে আগ্রহী হলে তাঁর প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা পর্যন্ত উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সুনীতিকুমারকে জানানো হল সেই ভয়ের কথা, তিনি আমল দিলেন না। তাঁর এক কথা, ‘‘মারে যদি মারবে, কিন্তু সভায় আমি যাবই। সেখানে গোলমাল করতে দেব না।’’
সুনীতিকুমারের মতের বিপরীতে সেই সভায় বক্তা ছিলেন দীনেশচন্দ্র সরকার ও সুকুমার সেন। সভাপতি, নীহাররঞ্জন রায়। সাদা পুলিশের ব্যবস্থা ছিল। জনসমাবেশ দেখে সুনীতিকুমার উত্তেজিত, ঠিক যেন গড়ের মাঠে বড় ম্যাচের আগে অধিনায়কের মনের অবস্থা। প্রধান আয়োজক শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ: ‘‘সুনীতিবাবু তাঁর কক্ষ থেকে সভাকক্ষ পর্যন্ত হেঁটে এলেন। আমরা লক্ষ রাখছি হঠাৎ কিছু অঘটন না ঘটে!’’
দীনেশচন্দ্র সরকার এবং সুকুমার সেনের বক্তৃতার পর আচার্য সুনীতিকুমার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসপ্রিয়তার সঙ্গেই সকলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন সে দিন। ভাষণ চলতে চলতে শ্রোতাদের মধ্য থেকে প্রশ্ন আসছিল, বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে ক্ষিপ্র উত্তর দিচ্ছিলেন। বার বার বলেছেন, তাঁর ধারণা ভুল হতে পারে। পণ্ডিতজনেরা আলোচনা করুন, প্রয়োজনে তাঁকে ভুল প্রতিপন্ন করুন। যুক্তি দিয়ে বিচার হোক। প্রচলিত ধারণা বলে যা চলছে, অন্ধ ভক্তির বশে যেন তা মেনে নেওয়া না হয়।
ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের তন্নিষ্ঠ ছাত্র, ছিয়াশি বছরের অকুতোভয় তরুণ জীবনের শেষ প্রান্তে রামায়ণ নিয়ে এক বিতর্কের প্রবর্তন করে গেলেন। রামকথার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা নিয়েও এই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের যুক্তিবাদী সংস্কারমুক্ত মনে যে সব প্রশ্ন জেগেছে, তা নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পাননি। ‘সংস্কার ও ভক্তির বিরুদ্ধে সিংহবিক্রমে’ তাঁর এই সংগ্রামের কথা দীর্ঘ চার দশক পরে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
রামায়ণ-বিতর্ক নিয়ে সুনীতিকুমার একটি বইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তা লেখা শুরুর আগেই ২৯ মে ১৯৭৭ সালে তিনি প্রয়াত হলেন। মৃত্যুর আগে জেনে গেলেন, তাঁর সুযোগ্য শিষ্য অথচ রামায়ণ-বিতর্কে গুরুর ‘বিরুদ্ধ-পক্ষ’ সুকুমার সেন প্রস্তুত করে ফেলেছেন রামকথার প্রাক-ইতিহাস গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। সুকুমার সেন এই বই উৎসর্গ করেছেন আচার্য সুনীতিকুমারকেই, তা-ও জেনে গিয়েছিলেন তিনি।