CPM

পঞ্চাশ বছর আগের সেই আন্দোলন

কেটে গিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। আজ পর্যালোচনা করে অনেকে বলেন আসলে এই ঘটনা ছিল কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের অনিবার্য পরিণতি। বামপন্থীদের শ্রমিক আন্দোলনের এক বৃহত্তর পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল এই ঘটনা। রাজনৈতিক সমালোচকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে নির্বাচনের পরে ক্ষমতায় দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের বসার সময় থেকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে এক নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়

Advertisement

মিলন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২০ ০১:৩৮
Share:

রাজভবনে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের শপথ গ্রহণ। (বাঁদিক থেকে) রাজ্যপাল ধর্মবীর, জ্যোতি বসু ও অজয় মুখোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর হলেও একটা সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শিল্পকেন্দ্রীক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কংগ্রেস হোক বা বামপন্থী— সব দলই সংগঠন বাড়াতে পাখির চোখ করত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে। এক দিকে, হুগলি অন্য দিকে স্বাধীনতার পরে তৈরি হওয়া দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল— দু’টি দিকেই শুরু হয়েছিল শ্রমিক আন্দোলনের জমি দখলের লড়াই। স্বাধীনতার পরে প্রথম এক দশক শ্রমিকদের ইউনিয়নের ক্ষেত্রে মোটের উপরে কংগ্রেসের আধিপত্য থাকলেও বামপন্থী ইউনিয়নগুলিও ধীরে ধীরে নিজেদের জন্য রাজনৈতিক জমি তৈরি করছিল। ১৯৬৭ সালের রাজনৈতিক নির্বাচনের পরে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি পরিবেশ পাল্টাতে থাকল। বেশিরভাগ জায়গাতেই কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এলেন বামপন্থীরা। তবে ইউনিয়নের দখলদারি নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও, তখনও সে ভাবে কোনও অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। সে পরিস্থিতি তৈরি হল ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরির পরে। রাজনৈতিক মতভেদকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয় দুর্গপুর শিল্পাঞ্চলও।

Advertisement

রাজনৈতিক সমালোচকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে নির্বাচনের পরে ক্ষমতায় দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের বসার সময় থেকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে এক নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়। শিল্পাঞ্চলের প্রবীণ রাজনীতিবিদেরা বলে থাকেন, আসলে সে দিন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ‘দজ্জাল’ শাশুড়ি আর ‘মুখরা’ বৌমার মতো। দুই দলের নেতারাই পরস্পরকে দেখতেন সন্দেহের চোখে। সেই সময়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তখন যুক্তফ্রন্টের অন্যতম অ্যাজেন্ডাই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের যে নীতিগুলি তাঁদের চোখে ‘জনবিরোধী’ বলে মনে হচ্ছে তার বিরুদ্ধে তৃণমূল স্তর থেকে তীব্রতম প্রতিবাদ করা। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনও নীতিকেই রাজ্য সরকার সন্দেহের চোখে দেখত। নেতাদের অনেকে মনে করতেন, এই সব আইনের বলে কেন্দ্র সরকার যেন-তেন প্রকারেণ রাজ্যের অধিকার হস্তক্ষেপ করতে চায়। ফলে বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নীতির বিরোধিতা করাই দস্তুর হয়ে দাঁড়ায় বলে দাবি করেন রাজনৈতিক ইতিহাসকারেরা। সেই প্রেক্ষিতেই একটি নতুন ঘোষণা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্তরাও চ্যবন।

তাঁর ঘোষণায়, কারখানার নিজস্ব রক্ষীবাহিনী নয়, এর পর থেকে দুর্গাপুর-সহ ভারতের অন্য কারখানাগুলির নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিয়োরিটি ফোর্স’-এর হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেই সময়ে দুর্গাপুরের কারখানাগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল কারখানার নিজস্ব বাহিনীর হাতে। বামপন্থী দলগুলি দাবি করে, এই সিদ্ধান্তের ফলে বহু সংখ্যক রক্ষী কাজ হারাবেন। দুর্গাপুরের কমিউনিস্ট প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। সেই সময়ের কথা আলোচনা করতে গিয়ে সিআইটিইউ নেতা ও পরবর্তীকালের সাংসদ জীবন রায় অভিযোগ জানান, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জীবনবাবুর আরও দাবি করেন, নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীতে কর্মরতদের ভবিষ্যতের সুরক্ষার কথা ভেবেই তাঁরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। শ্লোগান ওঠে, ‘বাহিনী নয়, ভাত চাই’, আমাদের শিল্প আমরাই রক্ষা করতে চাই’। যদিও অনেকে দাবি করেন, সেই সময়ে যেহেতু দুর্গাপুর-সহ শিল্পাঞ্চের বহু ক্ষেত্রে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছিল তাই কেন্দ্রীয় সরকার সিআইএসএফ-কে দিয়ে তাঁদের সংগঠনকে দুর্বল করার চেষ্টা করবেন এমন আশঙ্কাও বামপন্থী নেতারা করেছিলেন।

Advertisement

এই বিষয়ে প্রবীণ আইএনটিইউসি নেতা ও বর্তমান জেলা আইএনটিইউসি-র সভাপতি বিকাশ ঘটক বলেন, “সে দিন বামপন্থীদের ধারণা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার সিআইএসএফ-এর মাধ্যমে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছেন। তাই শ্রমিকের অধিকারের দাবিতে দুর্গাপুরে তাঁরা আন্দোলনে নামেন। ফলে উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যা একেবারেই কাম্য ছিল না।’’

সেই সময়ের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্গাপুরে তখন শ্রমিক আন্দোলেনের পুরভাগে ছিলেন অজিত মুখোপাধ্যায়, নীহার মুখোপাধ্যায়, দিলীপ মজুমদারের মতো নেতারা। তঁদের দাবি ছিল, কোনও খবরদারি নয়, কারখানার দায়িত্ব দিতে হবে শ্রমিকদেরই। অবস্থা চরমে ওঠে ২৪ মার্চ দুপুরের দিকে। অভিযোগ, ওই সময়ে ডিএসপি-র নিরাপত্তারক্ষীরা কারখানার সদর দফতর অভিযান শুরু করেন। প্রধান প্রশাসনিক অফিসে আলোচনার জন্য দূত পাঠানো হলেও শ্রমিকদের একাংশের অভিযোগ, সে দূতকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। জানানো হয়, এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে না এবং কোনও স্মারকলিপিও গ্রহণ করা হবে না। শ্রমিকদের দাবি, সেই সময়ে নিরাপত্তারক্ষীরা প্রশাসনিক ভবনে ঢোকার চেষ্টা করতেই তাঁদের চার দিক থেকে ঘিরে ঘরে সিআরপিএফ-এর বাহিনী। লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, এমনকি, গুলিও চলে। কয়েক জন শ্রমিক আহত হন এবং প্রায় ৫০ জন শ্রমিককে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। পরে আন্দোলনকে অন্য শ্রমিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।

সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, পরের দিন কয়েক হাজার বামপন্থী কর্মী কাজ বন্ধ রেখে কারখানার সদর দফতরের সামনে উপস্থিত হন। শ্রমিকদের দাবি ছিল, গুলি চালানোর অভিযোগে চিফ সিকিয়োরিটি অফিসার ও কারখানার এমডি ওয়াধেরাকে গ্রেফতার করতে হবে। শ্রমিকদের অভিযোগ ছিল, তাঁর প্ররোচনাতেই চিফ সিকিয়োরিটি অফিসার গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সংসদের অধিবেশনে নির্বাচিত সাংসদ ইন্দ্রজিত গুপ্ত দাবি করেন, অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিআরপি, সিআইএসফ-কে সরাতে হবে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোতি বসু আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি করেন, সিআরপি ও সিআইএসএফ-কে দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করার জন্যই এত বড় ঘটনা ঘটেছে। তাই অবিলম্বে রাজ্য থেকে সিআরপি, সিআইএসএফ তুলে নিতে হবে। জ্যোতিবাবু জানান, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রাজ্যই রক্ষা করতে পারবে। অবস্থা চরমে উঠলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চ্যবন ঘোষণা করেন, অন্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কেন্দ্রীয় পুলিশ থাকবেই। তবে রাজ্য না চাইলে কেন্দ্রীয় বাহিনী কোনও ভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না। চ্যবনের এই ঘোষণার পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও কারখানার নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীদের ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেন, কেউ কাজ হারাবেন না। যাঁরা শারীরিক ভাবে সক্ষম তাঁদের সিআইএসএফ-এ নেওয়া হবে। যাঁরা অক্ষম, বা বাহিনীতে যেতে অনিচ্ছুক তাঁদের কারখানার কর্মী হিসেবে অন্য কাজে নিয়োগ করা হবে।

সে দিনের ঘটনার পর কেটে গিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। আজ সেই ঘটনা পর্যালোচনা করে অনেকে বলেন আসলে এই ঘটনা ছিল কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধের অনিবার্য পরিণতি। তবে দুর্গাপুর-সহ নানা ক্ষেত্রে বামপন্থীদের শ্রমিক আন্দোলনের এক বৃহত্তর পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল এই ঘটনা এমনটা দাবি করেন অনেকে। আজ পঞ্চাশ বছর পরে তাই তার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।

একটি বেসরকারি কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement