বর্ধমান রাজবাড়িতে খুঁজে পাওয়া দু’টি ছাপার যন্ত্র। (ইনসেটে) বর্ধমানের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদিত মহাভারতের রাজ সংস্করণ। ছবি: লেখক
বাংলায় মুদ্রিত বই ও পত্রিকার সূচনাপর্বের ইতিহাসে বর্ধমান জেলার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জেলার পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুর এলাকার গঙ্গাতীরবর্তী বহড়া গ্রামের গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সচিত্র বাংলা গ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রকাশ করেন। এই গঙ্গাকিশোরই ১৮১৮-র ১৫ মে শুক্রবার ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ নামে বাংলা তথা ভারতীয় ভাষার প্রথম সংবাদপত্র (সাপ্তাহিক) প্রকাশ করেন। বর্ধমানের আর এক গর্বের প্রকাশনা ‘হরিহরমঙ্গল সঙ্গীত’ বর্ধমান রাজসভার তৎকালীন দেওয়ান পরাণচাঁদ কপূর দ্বারা রচিত এবং ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে (১২৩৭ বঙ্গাব্দে) কলকাতার বিখ্যাত খোদাইশিল্পী রামধন স্বর্ণকারের ৭২টি চিত্র-সহ মুদ্রিত হয় এখানে। সে সময় এত বড় আকারের, এত চিত্রশোভিত বই আর দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায় না। স্বাভাবিক ভাবেই, বর্ধমান রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষণা ছাড়া এ কাজ সম্ভব হত না। এই রাজপরিবারের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে উনিশ শতকেই প্রকাশিত হয় রামায়ণ ও মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ— যা বাংলা প্রকাশনার আর এক দিকচিহ্ন। বিশেষ ভাবে স্মরণীয়, এই অনুবাদকর্ম ও তার মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছিল বর্ধমানের বুকেই।
সম্প্রতি ২০১৮ তে বহড়া গ্রামে গঙ্গাকিশোরের নির্জন ভিটেতে সমীক্ষা চালিয়ে বোঝা গিয়েছে, উনিশ শতকে এই গ্রাম যথেষ্ট যোগাযোগসম্পন্ন ছিল, মূলত গঙ্গার জলপথের কারণে। সে কালে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদে নিয়মিত নৌকায় যাতায়াত ছিল। প্রেসের মালিকানা নিয়ে অপর অংশীদার হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় গঙ্গাকিশোর তাঁর কাঠের ছাপাখানা নদীপথে নিয়ে এসে এই বহড়া গ্রামেই সেটিকে চালু রাখেন। তিনি নিঃসন্তান হলেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আত্মীয় ছিলেন বর্ধমানরাজ পোষিত। শুধু তাই নয়, ছাপাখানা-সহ গঙ্গাকিশোর পরিবার যে যথেষ্ট সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন তার প্রমাণ এখনও ছড়িয়ে রয়েছে সে গ্রামে। বহড়া থেকেও গঙ্গাকিশোর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বাংলা প্রকাশনা করেছিলেন। তাঁদের পরিবারে যে বর্ধমানরাজের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল সেটা তাঁর কাব্যে বর্ধমানরাজ প্রীতিতেই প্রকাশিত। সুকুমার সেন গঙ্গাকিশোরকে ‘পুস্তকপ্রকাশকদিগের ব্রহ্মা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমগ্র বর্ধমান জেলার প্রকাশনার উদ্যোগেই বর্ধমানরাজ সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, বর্ধমানজাত এবং প্রধানত বর্ধমান রাজসভার পৃষ্ঠপোষিত প্রকাশনার উল্লেখ কোথাও তেমন পৃথক মর্যাদা পায়নি। সে কথা ভেবেই ‘বর্ধমান সাহিত্যসভা’র প্রাণপুরুষ সুকুমার সেন বর্ধমানের গবেষকমণ্ডলীকে জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার ও যথার্থ মূল্যায়নে প্রেরণা এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন। আব্দুস সামাদ রচিত ‘বর্ধমান রাজসভাশ্রিত বাংলা সাহিত্য’ (১৯৯১) সেই প্রচেষ্টারই অন্যতম সেরা ফসল। ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ বর্ধমান রাজবাড়ির পূর্বাংশে কাছারি বাড়ির একতলায় (বর্তমানে রাজ্য সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অফিস) পুরনো গুদামঘরের তালা খুলে একটি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় রাজ আমলের দু’টি প্রাচীন অ্যালবিয়ন কোম্পানির মুদ্রণযন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিল। দুঃখের বিষয়, এখনও এগুলির উপযুক্ত সংরক্ষণ হয়নি। তবে পরে মিলিয়ে দেখা গিয়েছে যে মহতাবচাঁদ থেকে আফতাবচাঁদ পর্যন্ত বর্ধমানে যে সব গ্রন্থ (বিশেষত রামায়ণ ও মহাভারত) প্রকাশিত হয়েছে, তার পৃষ্ঠার সঙ্গে যন্ত্রগুলির মাপের মিল রয়েছে। এই অনুসন্ধানে প্রধানত প্রেরণা দিয়েছিলেন অধ্যাপক আব্দুস সামাদ। তাঁর মতে, এমন অনুমান করা চলে যে, বর্ধমানের এই মুদ্রণযন্ত্রগুলি রাজ আমলেই বিদেশ থেকে আমদানি করে পূর্ণ মাত্রায় মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। যন্ত্রগুলি ‘অধিরাজ যন্ত্র’, ‘দ্বিজরাজ যন্ত্র’, ‘সত্যপ্রকাশ যন্ত্র’ ইত্যাদি নামে রাজাদেশে অভিহিত হয়েছিল। তৎকালীন রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থেও মুদ্রণযন্ত্রগুলির এই সব রাজপ্রদত্ত নাম ব্যবহার করা হয়েছে। পরে মহারাজা বিজয়চাঁদের আমলের বইগুলি মূলত আধুনিক চেহারায় এবং রঙিন চিত্র-সহ কলকাতা এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত। তখন থেকেই সম্ভবত পুরনো মুদ্রণযন্ত্রগুলি অব্যবহৃত হয়ে যায় ও পরে গুদামজাত হয়।
বর্ধমান রাজবাড়ির পুব দিকের বাইরের অংশ জহুরিপট্টি বলে অভিহিত, এটি প্রধানত বর্ধমানের সবচেয়ে বড় স্বর্ণবাজার। এলাকাটি বৃহত্তর ভাবে চাঁদনি চক নামে এখন পরিচিত। এই অংশ জহুরিমহল বা জহুরি বাজার নামেও উল্লিখিত। জহুরিবাজারই তখনকার ছাপাখানা মহল ছিল। ‘বর্ধমানিয়া’ ভাষাচার্য সুকুমার সেন তাঁর ‘বটতলার ছাপা ও ছবি’ গ্রন্থে তার মুদ্রিত প্রমাণ দিয়েছেন: ‘‘শ্রী শ্রী কালী/ পদভরসা/ শব্দকল্পলতিকা নামক/ অভিধান। শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকান্ত তর্ক্কালঙ্কারের দ্বারায়বর্ণ। সংশোধিত হইয়া। শ্রীযুক্ত ভৈরবচন্দ্র রায়। ও শ্রীযুক্ত কেনারাম মজুমদারের। দ্বারায় মোং বর্দ্ধমানের জহরীবাজারের আয়নল হেকমত। যন্ত্রালয়ে দ্বিতীয়বার মুদ্রাঙ্কিত হইল। এই পুস্তক যাহার পৃয়জন হইবেক তিনি উক্ত যন্ত্রালয়ে বা। বর্দ্ধমানের নূতনগঞ্জে উক্ত মজুমদার দিগরের বাসায় তত্ত্ব করিলে। পাইবেন। ইতি সন ১২৫৯ সাল তারিখ ৪ ভাদ্র।’’ ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের এই গ্রন্থের বিজ্ঞপ্তিতে কলকাতার বটতলার গ্রন্থ প্রচারের ছাপ সুস্পষ্ট। আর চিৎপুর বটতলার সন্নিহিত এলাকাগুলিতে যেমন বটতলার প্রকাশনার বাজার সম্প্রসারিত হয়েছিল ঠিক তেমনই তখনকার বর্ধমান রাজবাড়ির সন্নিকটস্থ পশ্চিম দিকে গঞ্জবাজার বলে পরিচিত নতুনগঞ্জ অবধি বইয়ের ব্যবসা সম্প্রসারিত ছিল।
বর্ধমান রাজসভা থেকে নানা ধরনের উল্লেখযোগ্য বই, এমনকি রাজার বই ‘পাক রাজেশ্বর’ প্রকাশিত হলেও তাদের মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতই সর্বোৎকৃষ্ট। রাজা মহতাবচাঁদ রামায়ণের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেন ১৮৬৬ তে, প্রকাশনা শেষ হয় ১৮৮২ তে। মহাভারতের অনুবাদ প্রকাশ সম্পূর্ণ হতে লেগেছিল ২৬ বছর (১৮৫৮-১৮৮৪)। মহতাবচাঁদের পরে আফতাবচাঁদ এই প্রকাশনা সম্পূর্ণ করেন। এর প্রধান কারণ বর্ধমানরাজ এই সুবিশাল প্রকাশনায় কোনও আপস করেননি। অনুবাদে এতটাই মূলানুগত্য বজায় রেখেছিলেন যে, এশিয়াটিক সোসাইটির মূল গ্রন্থ নির্ভর করে আদিকাণ্ড মুদ্রিত হওয়ার পরেও যথোপযুক্ত মনে না হওয়ায় সব বই ফেলে দিয়ে নতুন ভাবে অনুবাদকর্ম শুরু হয়। বাংলার বিশিষ্ট পণ্ডিতরা অনুবাদকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। আবার রামায়ণ থেকে মহাভারত— মুদ্রণ ও বাঁধাই-সহ সামগ্রিক প্রকাশনার ক্রমাগত উন্নতি ঘটেছে। হরফ ও বাঁধাইগুলি (বিশেষত রাজ-সংস্করণের) দেখলেও সেই কথা বোঝা যায়। উনিশ শতকে বর্ধমানে প্রকাশিত এই সব গ্রন্থ সংগৃহীত হয়ে পৃথক ভাবে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হলে বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট অধ্যায় আলোকিত হয়ে উঠবে।
ইতিহাস গবেষক