ভাষার প্রাণ

সঙ্কটের কারণ অনুসন্ধান করিলে পৌঁছাইতে হয় ব্যবহারকারীর নিকটে। তাহার উপরেই নির্ভর করে ভাষার বাঁচা-মরা। এক কালের রাজভাষা ফারসির গুরুত্ব অপরিসীম ছিল সমাজের সর্ব স্তরে। ১৮৩৮ সালের পূর্ববর্তী বাংলায়, আইন-আদালত হইতে লেখাপড়া, সর্বত্রই আধিপত্য ছিল তাহার। স্থানীয় ভাষাগুলির উপরেও তাহার প্রবল প্রভাব ছিল। বাংলা ভাষার শব্দকোষেই প্রবেশ করিয়াছিল প্রচুর ফারসি উপাদান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

দশ বৎসরের ব্যবধানে ভাষাশুমারি হইলে কিছু ভাষা নূতন করিয়া বিলুপ্ত কিংবা বিপন্ন হইবে, ইহা স্বাভাবিক। তাহার কারণ, ভাষা চলমান। তাহা জন্মলাভ করে, প্রয়াত হয়। সাম্প্রতিক ভাষাশুমারিতে জানা গিয়াছে, ঐতিহ্যঋদ্ধ ফারসি ভাষা ভারতে বিলুপ্তির মুখে। ২০০১ সালের শুমারিতে ফারসি ছিল ‘অ-তফসিলি’ ভাষা। ভারতীয় সংবিধানে যে ভাষাগুলির উল্লেখ অষ্টম তফসিলে নাই, অথচ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দশ হাজারের অধিক, সেইগুলিই অ-তফসিলভুক্ত। সেই কালে ফারসি ব্যবহার করিতেন ১১,৬৮৮ জন। দশ বৎসরে সেই সংখ্যা হইতে স্খলন ঘটিয়াছে। ভাষাতত্ত্বের এক অধ্যাপক জানাইয়াছেন, নির্দিষ্ট ভাষা বিলুপ্ত হইবার অর্থ, তাহার সহিত সেই ভাষার জ্ঞানচর্চা এবং সংস্কৃতি জগতেরও অবলুপ্তি। কারণ, ভাষা বিপন্ন হইয়া পড়িলে, তাহার প্রয়োগক্ষেত্রগুলি সীমিত হইয়া পড়ে। বিপরীতটিও সত্য। রুমি, ওমর খৈয়াম-এর ভাষাটির ভারতীয় সংস্করণের ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছে। প্রায়োগিক জগতে ব্যবহার সামান্য। অতএব, ভাষাও সঙ্কটে।

Advertisement

সঙ্কটের কারণ অনুসন্ধান করিলে পৌঁছাইতে হয় ব্যবহারকারীর নিকটে। তাহার উপরেই নির্ভর করে ভাষার বাঁচা-মরা। এক কালের রাজভাষা ফারসির গুরুত্ব অপরিসীম ছিল সমাজের সর্ব স্তরে। ১৮৩৮ সালের পূর্ববর্তী বাংলায়, আইন-আদালত হইতে লেখাপড়া, সর্বত্রই আধিপত্য ছিল তাহার। স্থানীয় ভাষাগুলির উপরেও তাহার প্রবল প্রভাব ছিল। বাংলা ভাষার শব্দকোষেই প্রবেশ করিয়াছিল প্রচুর ফারসি উপাদান। ইহার পর রাজার ভাষা পরিবর্তিত হইল ইংরাজিতে। শাসকের ভাষা বলিয়া এত দিন যাঁহারা ফারসির ছাত্র হইয়াছিলেন, তাঁহাদের আনুগত্য দেখা দিল ইংরাজির প্রতি। ব্যবহারকারীর বদল ঘটিল, সুতরাং পরিবর্তন হইল গুরুত্বের ভারেও। ক্রমে ইউনেস্কো-র বিপন্নতার সূচকে তাহা অভূতপূর্ব সঙ্কটের সম্মুখীন হইল। আজও যে সকল স্থানে, প্রধানত ইরান-সহ এশিয়া মহাদেশের মধ্য ভাগের কয়েকটি দেশে, ফারসি রাজভাষা রূপে বিদ্যমান, সেই সকল স্থানে তাহার ক্ষমতা স্বমহিমায় বিরাজ করিতেছে।

সমাজের আর পাঁচটি বিষয়ের ন্যায় ভাষার মূল নিয়ন্ত্রকও রাজনৈতিক ক্ষমতা। নির্দিষ্ট ব্যবহারকারী গোষ্ঠীকে রাজনীতি নির্দেশ দেয়, কোন ভাষাটি ক্ষমতার পছন্দ। সেই পথেই উত্তর ভারত জুড়িয়া আজ অবিসংবাদী হইয়া উঠিয়াছে হিন্দি। কালে কালে দুর্বল হইয়াছে কুমায়ুনি কিংবা বুন্দেলখণ্ডির ন্যায় ক্ষমতাহীনের ভাষা। এই বাংলাতেও সরকারি ভাষার দাপটে কোণঠাসা হইয়াছে নেপালি কিংবা সাঁওতালির ন্যায় প্রান্তবাসী। সেই বাংলাই সংখ্যালঘু হইলে বিপদগ্রস্ত হইয়াছে প্রতিবেশী অসমে। তবে বিপরীত চিত্রও আছে। বাংলাভাষীর উপর বলপূর্বক উর্দু চাপাইতে গিয়া এক কালে আত্মঘাতী গোল খাইয়াছিলেন ক্ষমতাসীনেরা। ইহার কারণ ভাষা ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা দৈনন্দিন জীবনে অনুভব করেন জনগণ। কোনও ভাষা যদি তাঁহাদের অপরিচিত হয়, অথবা তাহার ব্যাকরণ এবং বানানবিধি অত্যধিক জটিল হয়, তবে বিচ্ছিন্নতাই তাহার ভবিতব্য। সেই পথেই ভরাডুবি হইয়াছে বহু ভারতীয় ভাষার পূর্বসূরি সংস্কৃতের। শেষ অবধি সকল ভাষার স্বাস্থ্য নির্ধারণ করিবে বাস্তবানুগতা। সেই বাস্তব আবার ক্ষমতার দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement