বিক্রয় আছে

কিন্তু মানুষ কি স্পন্দিত হয়? দেহের প্রত্যঙ্গের দালালি কলিকাতায় পুরোদস্তুর জীবিকা হইয়া উঠিয়াছে। হাসপাতালের নার্স-ওয়ার্ড বয় হইতে হাসপাতালের সম্মুখে চায়ের দোকান, সর্বত্র তাহার সদস্যরা তৎপর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

রক্তের দাগ যখন তরবারির মতো বক্র, তখন সংবাদপত্রের স্তম্ভগুলি কী করিয়া সোজা থাকে? কিডনি বিক্রয়চক্রের বিবরণ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই প্রশ্ন মনে করাইয়া দেয়। ঘাতকের উন্মত্ত হিংস্রতা নহে, ইহা প্রতারকের শীতল, সতর্ক হিংসা। তাহার অমানবিকতা অন্তঃস্থল অবধি কাঁপাইয়া দেয়। সন্তানের চিকিৎসার্থে নিজের কিডনি বিক্রয় করিয়াও পিতা দালালের হাতে প্রতারিত হইয়াছেন। অর্থাভাবে বাঁচে নাই সন্তান। চাকরির আশায় কলকাতায় আসিয়া প্রত্যঙ্গ-ব্যবসায়ীর ফাঁদে পড়িয়াছে যুবক। চাকরি পায় নাই, কিডনি হারাইয়া বাড়ি ফিরিয়াছে। এমন সব ঘটনার বিবৃতিতে দৈনিকের পৃষ্ঠার সারিবদ্ধ শব্দগুলি সত্যই যেন অস্থির হইয়া ওঠে। শব্দ তো নিষ্প্রাণ নহে। কিন্তু মানুষ কি স্পন্দিত হয়? দেহের প্রত্যঙ্গের দালালি কলিকাতায় পুরোদস্তুর জীবিকা হইয়া উঠিয়াছে। হাসপাতালের নার্স-ওয়ার্ড বয় হইতে হাসপাতালের সম্মুখে চায়ের দোকান, সর্বত্র তাহার সদস্যরা তৎপর। আইনত প্রত্যঙ্গ কেবল দান করা চলে, বিক্রয় অবৈধ। বাস্তবে টাকার বিনিময়ে ‘দাতা’ জোগাড় করিতেছেন দালালরা। এক প্রান্তে রোগী, অপর প্রান্তে দুঃস্থ প্রত্যঙ্গ-বিক্রেতা। উভয়েই সমান বিপন্ন, নিরুপায়। তাই দুষ্টচক্র এমন নীরবে, এত অনায়াসে কার্যসিদ্ধি করিতেছে। আইন তাহাকে আঘাত করিতে পারে না, বরং আইনকে ওই দুষ্টচক্র ব্যবহার করে। প্রত্যঙ্গ বিক্রয় বেআইনি, তাই বিক্রয়কারী প্রতারণার প্রতিবাদ করিলে পুলিশের ভয় দেখাইয়া চুপ করানো সহজ। প্রশ্ন একটাই, দালালের পুলিশ-ভীতি নাই কেন? কেনই বা নীরব স্বাস্থ্য দফতর? প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের বৈধতা তদন্ত করিবার জন্য নির্দিষ্ট আধিকারিক আছেন। তবে কী করিয়া এমন বিশাল চক্র কাজ করিতেছে? হাসপাতালে নিয়মিত বিপুল টাকার কারবার চলিতেছে, হাসপাতাল কর্তারা জানেন না? এই সংশয় গভীর যে, পুলিশ, চিকিৎসক, সরকারি আধিকারিক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ— কেহ সক্রিয়, কেহ নিষ্ক্রিয় থাকিয়া ইহাকে কাজ করিতে দিতেছেন।

Advertisement

বিস্ময়ের কিছু নাই। রাজ্যবাসী ভোলে নাই, অনাথ আশ্রম হইতে শিশু পাচারের অপরাধে অভিযুক্ত হইয়াছেন শিশু সুরক্ষার দায়প্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক। বালিকা-কিশোরী পাচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রায় শীর্ষে, পাচারচক্রের সহিত পুলিশ-প্রশাসনের সংযোগের অগণিত অভিযোগ উঠিয়াছে। অতএব কিডনি ব্যবসাতেও যে দেশের শীর্ষে কলিকাতা, তাহা জানিয়া লজ্জা হইতে পারে, আশ্চর্য হইবার অবকাশ নাই। সংবাদে প্রকাশ, অপরাপর শহরে প্রত্যঙ্গ বিক্রয়ের চক্র নিয়ন্ত্রিত হইয়াছে। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। সংগঠিত অপরাধ চক্র কোনও একটি ক্ষেত্রে অবাধে চলিতে দিলে, অপরাপর ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করিতে বাধ্য। আশ্চর্য বরং এই যে, এই একটি ক্ষেত্রে শাসক ও বিরোধীর মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। দুই দলের নেতারাই সমান দৃষ্টিহীন। প্রতিরক্ষায় দুর্নীতি লইয়া যাঁহারা গলা ফাটাইতেছেন, প্রত্যঙ্গ ব্যবসার মতো মারাত্মক অপরাধ লইয়া তাঁহারা নিশ্চুপ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অসহায় রোগীর প্রতারণা ও চিকিৎসা-বঞ্চনার সহস্র দৃষ্টান্ত, কোনওটিই বিরোধীদের চোখে পড়ে না। গণতন্ত্রের প্রহরীদের এমনই ভূমিকা প্রত্যাশিত বটে। বিরোধী নেতার গাড়িতে একটি ইট পড়িলে তাঁহারা সাংবাদিক সম্মেলন বসাইয়া দেন, কিন্তু কিডনি চুরি হইলে কোনও দলের নেতা একটি বাক্যও খরচ করেন না।

অপর দিকে সরকারি আধিকারিকদের বাঁধা উত্তর: কেহ তো অভিযোগ করে নাই। একের পর এক থানা পার হইয়া গরুভরা ট্রাক বাংলাদেশের দিকে চলিয়া যায়। বাঙালি বালিকারা দিল্লির বেশ্যাপল্লি হইতে উদ্ধার হয়। কর্তারা প্রশ্ন করেন, কেহ জানায় নাই কেন? বিনীত প্রশ্ন: জানাইলে তবে জানিবেন, ইহাই কি প্রত্যাশা? জানিবার কাজটি কি তাঁহাদেরই নহে? অপরাধচক্র কায়েম হইলে সমাজ ও রাজনীতির সম্পর্কগুলি দুষ্ট ও বিকৃত হইয়া ওঠে। ক্ষমতাবান অপরাধকে পালন করে, আইন প্রহসনে পরিণত হয়, হিংসাই নৈমিত্তিক কর্তব্য হইয়া দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সীমান্তে গরুপাচার, বীরভূমের অবৈধ কয়লাখনি, বর্ধমানের অবৈধ বালিখাদান, সর্বত্র সেই দুষ্ট ক্ষত হইতে রক্তপাত হইতেছে। কলিকাতার হাসপাতালের অবস্থান তাহাদের পাশে। প্রত্যঙ্গপ্রার্থীকে সর্বস্বান্ত এবং বিক্রেতাকে প্রতারিত করিয়া সহজে টাকা উপার্জনের যে পথ তৈরি হইয়াছে, তাহা তোলাবাজির এক চরম দৃষ্টান্ত। ইহাতে মানুষ যদি বা বাঁচে, মনুষ্যত্ব বাঁচে না।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

নতুন বছর আসছে, সব ভাল হবে। নির্বাচন হবে, অথচ এন্তার খুনোখুনি হবে না, নির্বাচনী মঞ্চ থেকে গালাগালের বন্যা বয়ে যাবে না, আদর্শ চুলোয় দিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য জোট গড়াগড়ি ভাঙাভাঙির সার্কাস ঘটবে না। ম্যাজিকের মতো কমবে দূষণ দুর্নীতি দুঃস্বপ্ন, কেউ আধার কার্ড চাইবে না, ব্রিজেরা দাঁড়িয়ে থাকবে সটান, টুইটে দেশের নিন্দে করলেই ‘পাকিস্তানে যা!’ হুমকির বদলে যুক্তি শানানোর চেষ্টা হবে, আর চাষারা আত্মহত্যা না করে বলবে, ‘‘অনাহারে নয়, আশায় মরি!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement