‘আমার চাইবার কিছু নেই, আমরাই ভারতবর্ষ। ভিক্ষা দিয়ো না’

কাল আজ কাল

যখন ফরাক্কা ব্রিজ হয়নি, মনিহারি ঘাট হয়ে, দু’বার ট্রেন বদলে, এক বার স্টিমার পেরিয়ে নর্থ বেঙ্গল যেতে হত, তখন নানা কাজের বন্ধুবান্ধব নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছি বলত না, বলত দেবেশ/দেবেশদার ওখানে যাচ্ছি। আসলে জলপাইগুড়ি যাচ্ছেই না, যাচ্ছে হয়তো মালদহ।

Advertisement

দেবেশ রায়

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০৩
Share:

এক বার কোনও একটা আলগা লেখায় লিখেছিলাম, কারও ওপর রাগ করে, সে আমাকে জিগেস করেছিল, ‘‘আপনি তো নর্থ বেঙ্গলের, না?’’ লেখায় আমার জবাবটা ছিল, আপনি কি বসিরহাট-হাসনাবাদের সরু রাস্তায় একটা শালগাছকে দেখে জিগেস করবেন, আরে, আপনি লাটাগুড়ি ফরেস্টে ছিলেন না? আমি ফরেস্টের জংলা জঙ্গল। আর লাটাগুড়িরই।

Advertisement

যখন ফরাক্কা ব্রিজ হয়নি, মনিহারি ঘাট হয়ে, দু’বার ট্রেন বদলে, এক বার স্টিমার পেরিয়ে নর্থ বেঙ্গল যেতে হত, তখন নানা কাজের বন্ধুবান্ধব নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছি বলত না, বলত দেবেশ/দেবেশদার ওখানে যাচ্ছি। আসলে জলপাইগুড়ি যাচ্ছেই না, যাচ্ছে হয়তো মালদহ।

কিন্তু এমন ঘটনার একটা উল্টো দিক আছে, সেটা খুবই পারিবারিক। আমার গল্প-উপন্যাসগুলো নিজেদের অকুস্থল, একেবারে নদী-নালা-ফরেস্ট-নিধুয়া পাথার, কোন রাস্তায় কী বিপদ, সব মিলিয়ে অকুস্থল, নিখুঁত খুঁজে বার না করা পর্যন্ত আমি এক লাইনও লিখতে পারি না। আমি যত জায়গায় ঘুরেছি-থেকেছি-কাটিয়েছি, আমার বাড়ির কেউ সে-সব জায়গার নামও শোনেনি। তাই বাড়িতে একটা ঠাট্টা চালু আছে— এ বার তা হলে পাতকাটা। কিছু একটা ঘটবে তা হলে পাতকাটায়।

Advertisement

আর কপাল কাকে বলে। বছর কয়েক ধরে একটা উপন্যাস তৈরি হয়ে উঠছে— পাতকাটা নিয়ে। বেরিয়েওছে টুকরোটাকরা। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই পাতকাটার মেয়ে স্বপ্না বর্মন, এই বছরই জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে প্রথম ভারতীয় হিসেবে হেপ্টাথলনের সোনার মেডেল গলায় ঝোলাল, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে। ভ্যানরিকশাওয়ালা ও এক কালে পাশের চা-বাগানে খেপ-খাটা কামিনের মেয়ে। কোনও কোনও দিন দু’বেলা ফেনাভাত জুটত, যদি বাবার ভ্যানরিকশায় চাল কেনার মতো ভাড়া মিলত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বপ্নার মা বাসনাকে ফোন করে জিগেস করলেন, ‘‘আমি আপনাদের জন্য কী করতে পারি?’’ ফোনের পাশে দাঁড়ানো স্বপ্না চাপা স্বরে মাকে বলল, ‘‘ভিক্ষে চেয়ো না মা, টাকা চেয়ো না, সারা জীবন তো আমাদের জন্যে ভিক্ষে করেছ!’’ স্বপ্নার ব্যক্তিত্বের জোর ওর মেরুদণ্ডের চাইতে শক্ত। ওর মেরুদণ্ডের একেবারে তলার দুটো লাম্বারে ফাঁক আছে। অপারেশনে রাজি হয়নি স্বপ্না ও তার কোচ সুভাষ সরকার। ওর মা বাসনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বললেন, ‘‘আমাদের তো কিছু দরকার নেই। আপনাদের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছাই তো যথেষ্ট। যেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।’’

কিছু দরকার নেই স্বপ্নার। তাদের বাড়ি বলতে যা, সেটাকে ‘চালা’ বলে। বাঁশের বেড়া আর প্লাস্টিকের তাপ্পি দিয়ে কোনও রকমে মাথা গোঁজা। বাকিটা খোলা মাঠ।

সেই ঘরের মেয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানাল— আমাদের তো কিছু দরকার নেই। আর ওর মা ভদ্রতা করে যেটুকু বললেন, ‘‘যেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে’’, তার একটা অর্থ: আমিই দেশ, আমিই ভারতবর্ষ, আমার জন্য দুনিয়ার মাঠে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজে। আর আরও একটা অর্থ: আপনার জন্য তো বাজে পদাধিকারে।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, মনে থেকে গিয়েছে— কাল, আজ ও কাল যদি শুধু তারিখের তফাত হয়, আর সবই এক থাকে, তা হলে বাঁচার হিসেব হবে কী দিয়ে?

কথাটা প্রমাণ করতে একটি নাটক দেখে ফেরার সময় আমি মধুসূদন মঞ্চের বাইরের রোম্যান্টিক সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে পড়লাম। ডাক্তাররা সব রকম পরীক্ষা করে ‘পরশপাথর’ সিনেমার কালী ব্যানার্জির এক্স-রে’র ডাক্তারের মতো বললেন, ‘‘স্ট্রে— ন্— জ! আপনার বয়েসে এই ফলে তো অবধারিত মৃত্যু! সুইসাইড অ্যাটেম্পট নয় তো? একটা আঁচড়ও পড়েনি কোথাও। নিজে নিজে সারবে।’’ আমাকে, বিশেষ করে শোয়ার নারকীয় যন্ত্রণা সয়ে-সয়ে দেশবিদেশে ফোন-হোয়াটসঅ্যাপ-মেল ইত্যাদি মারফত ডাক্তারদের কথা ছেলেমেয়ে নাতিনাতনিদের জানাতে ও নিজে নিজে সারতে হল। এই যন্ত্রণার মধ্যে পাতকাটা ও স্বপ্না। ২৯ অগস্ট। প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা দিন থেকে আলাদা।

কিন্তু ওই ব্যথাহত আমাকে ৮ নভেম্বর দিল্লি নিয়ে গেল আমার ভাইপো— তার ভাইকে জ্বলজ্যান্ত দেখাতে যে আমি বেঁচেবর্তেই আছি।

দিল্লিতেই আমি স্বপ্নার কথাটার আসল অর্থ বুঝতে পারলাম। ২৯-৩০ নভেম্বর কৃষক জাঠা ছিল। আমি বললাম, আমাকে যেতেই হবে। আমার বৌমার কাছে অসম্ভব বলে কোনও শব্দ নেই। গাড়ি-ড্রাইভারের সঙ্গে এক জন সঙ্গীও থাকল, যে আমার শরীর খারাপ বুঝলেই বাড়ি ফিরিয়ে আনবে।

আমি জাঠার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের প্যাঁচে পড়ে গেলাম। পুলিশকে আর কী করে বোঝাই যে আমি জাঠার লোক, গাড়ির না। আমার হিন্দিতে খানিকটা চেষ্টা করলাম, ক্রাচ-টাচ দেখিয়ে। শেষে পুলিশের নির্দেশে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে ক্রাচ বগলে জাঠার কিসানদের লাল সেলাম দিতে লাগলাম। আমি বুঝলাম, একটা ক্লাউনের মতো আচরণ করছি। আবার, এ-ও বুঝলাম, এক জন ক্লাউনই তো সবচেয়ে আত্মসচেতন। এবং, আশ্চর্য, কিসানরা বুঝতে পারল, চিনতে পারল আমাকে, আমি জাঠারই মানুষ, জখম হয়েছি বলে জাঠায় হাঁটতে পারছি না। চিনতে পারল, আমি পাতকাটা-জলপাইগুড়ির দেবেশ। আর যখনই বুঝতে পারল, সঙ্গে সঙ্গে তারা স্লোগানের সঙ্গে আমার ব্যথার উপশম ঘটিয়ে স্বপ্নার সেই জবাবটার মানে বুঝিয়ে দিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে— তোমার কাছ থেকে আমার চাইবার কিছু নেই, আমরাই ভারতবর্ষ। ভা র ত ব র্ষ। ভিক্ষা দিয়ো না।

তার পরের দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে গেল। ১০-১১ ডিসেম্বর। বিজেপি-বিরোধী দলগুলির একত্রিত হওয়া ও উত্তরপ্রদেশ-বিহার বাদ দিয়ে হিন্দি বলয় থেকে বিজেপি উৎখাত। প্রতিটি দিন নতুন।

মাস পাঁচেক পরের লোকসভার ভোটে বিজেপির হার ও নরেন্দ্র মোদীর শাসনের অবসান কেউ ঠেকাতে পারবে না। খবরের কাগজে বিশেষজ্ঞদের ও সাংবাদিকদের যে-সব লেখা বেরোয় তাতে অনিবার্যই কিছু অন্য কথাও লিখতে হয়। সেগুলো আসলে পরাজয়ের পাঁচালি।

বিজেপি যে হারছেই তার সবচেয়ে বড় লক্ষণ— এমন তিন রাজ্যে হারের পর বিজেপি যা যা বলছে ও করছে সবই তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। বুলন্দশহরের ঘটনার প্রতিক্রিয়া। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ওপর দখল কায়েম। নাসিরুদ্দিনকে পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ। ‘দেশদ্রোহিতা’র সন্দেহ হলেই দশ-দশটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যে কোনও ব্যক্তির কম্পিউটার তল্লাশি করার অধিকার দেওয়া। দেশদ্রোহিতার আইনি সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। এক জন সাবইনস্পেক্টর মর্যাদার পুলিশ অফিসারের সন্দেহই যথেষ্ট। তার পর তো কোর্ট বিচার করবে। যেমন ভারাভারা রাও ও আরও পাঁচ জন বুদ্ধিজীবী জেলে পচছেন— বিনা বিচারে। আর তিন রাজ্যের বিধানসভা ভোটে তো অঙ্কের হিসেবে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে— নরেন্দ্র মোদী ও আদিত্যনাথ যে যে জায়গায় সভা করেছেন সেই সব আসনেই বিজেপি বেশি হেরেছে। রাহুল যেখানে যেখানে সভা করেছেন সেখানেই কংগ্রেস জিতেছে। মধ্যপ্রদেশের ভোটের শতাংশ আর আসনের সংখ্যার অসঙ্গতির কারণ চৌহান-মামার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। লোকসভার ভোটে বিজেপির ভোটের শতাংশেও ধস নামবে।

এখন পর্যন্ত বিরোধী দলদের হিসেব অনুযায়ী যাকে হিন্দি বলয় বলা হয় সেখানে বিজেপি কমপক্ষে ১০০টি আসনে হারবে। ২০১৪’তে উত্তরপ্রদেশ-বিহার-ঝাড়খণ্ডে ১৩৪টি আসনের মধ্যে ১১৬টি আসনে তারা জিতেছিল। এই ১১৬টির মধ্যে প্রায় তিন ভাগের দু’ভাগই উত্তরপ্রদেশে। আশা করা যায়, মায়াবতী ও অখিলেশ বিরোধী ফ্রন্টে যোগ দেবেন। নইলে তাঁদের দল ভাঙবে। বিজেপির এই প্রত্যাশিত হারগুলোর সঙ্গে যোগ করতে হবে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও দিল্লির অত্যন্ত সম্ভাব্য হার।

বিজেপির সবচেয়ে বড় সঙ্কট: তিন বিধানসভা ভোটে হারের দায় থেকে মোদীকে মুক্ত রাখা। তারা বলছে, মোদীই একমাত্র জাতির নেতা। একটু বিস্মিত প্রশ্ন তো করতেই হয়— মোদী জাতীয় রাজনীতি করলেন কবে? উনি তো ভারতের চাইতে বিদেশই বেশি চেনেন।

একটা কথা মনে করলে ভোটারদের প্রাজ্ঞতা সম্পর্কে আস্থা বাড়তে পারে। ১৯৬৭-র বিধানসভা ভোটে বামপন্থীরা দুটো আলাদা ফ্রন্টে বিভক্ত। কংগ্রেস একা। তবু কংগ্রেস জিততে পারল না। প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হল।

মোদী যে প্রশ্ন করেছিলেন আমার পাতকাটার স্বপ্না বর্মনের মা বাসনাকে— ‘‘আমি আপনাদের জন্য কী করতে পারি’’, তার উত্তরে স্বপ্না বলেছিল ‘‘কিছু না।’’

সেই উত্তরের পিছনে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement