হকার।নিজস্ব চিত্র।
ব্যবসায়ীরা সচরাচর যে কথাগুলি মুখ ফুটিয়া বলেন না, পৃথ্বীরাজ সিংহ ওবেরয় তাহা বলিয়া গেলেন। তিনি কলিকাতার অন্যতম প্রাচীন হোটেল ওবেরয় গ্র্যান্ড-এর কর্ণধার। বলিলেন, শহরের প্রাণকেন্দ্রটিকে দেখিলে দুঃখ হয়। কোনও উন্নয়ন নাই, নূতন কোনও বিনিয়োগ নাই। কেন, তাহা শহরবাসী নিশ্চয় জানিবেন। কেহ যদি গ্র্যান্ড আর্কেড (অর্থাৎ হোটেলটির নীচতলায় জওহরলাল নেহরু রোডের উপর যে দোকানগুলি আছে) হইতে কিছু কিনিতে চাহেন, হকারের ভিড়ে তাহা কার্যত অসম্ভব। শ্রীওবেরয়ের বক্তব্যটি বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। যাঁহারা তাঁহার মতের সমর্থক, তাঁহারা অবিলম্বে হকার উচ্ছেদের দাবি জানাইবেন। আর, মতের বিরোধীরা বলিবেন, কোনও একটি পাঁচতারা হোটেলের চত্বর পরিচ্ছন্ন রাখা অপেক্ষা গরিব মানুষের রুজিরুটির প্রশ্নটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এবং, উভয় পক্ষই মূল সমস্যাটিতে পৌঁছাইতে ব্যর্থ হইবেন। হকাররা সমস্যা নহেন, সমস্যা রাজনীতি। যে রাজনীতি গরিবকে তাহার বোড়ে বানাইতেই অভ্যস্ত। কোনও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্ন পরিবেশের দাবি জানাইবে, তাহা এক প্রকার স্বতঃসিদ্ধ। শহরবাসীও হকারমুক্ত ফুটপাতে হাঁটিবার অধিকার চাহিবেন। তাঁহাদের এই চাহিদাকে গরিবের রুজিরুটির বিরোধিতা হিসাবে দেখাইবার চালটিই রাজনীতি। প্রকৃত প্রস্তাবে এর বিরোধ নাই। ফুটপাত হাঁটিবার জন্য, রাস্তা যানবাহনের জন্য। সেই পরিসরটি দখল করিয়া কেহ রুজিরুটির সংস্থান করিতে বসিলে তাহার বিরোধিতা করাই বিধেয়। বিকল্প পথের সন্ধান করিবার দায়িত্ব প্রশাসনের।
শহরের পরিসরে অবশ্যই গরিবেরও অধিকার আছে, তাঁহার জীবিকা অর্জনের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র যদি তাহার ব্যবস্থা করিতে চাহে, তাহার যথার্থ পন্থা আছে। ফুটপাতের হকারদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হউক। প্রান্তে নহে, প্রয়োজনে শহরের প্রাণকেন্দ্রেই হউক। কিন্তু, রাস্তা বা ফুটপাত দখল করিয়া নহে। পুনর্বাসন পাইবার পরও কেহ ফুটপাতের দখল রাখিতে চাহিলে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই তাঁহাকে উচ্ছেদ করিতে হইবে। এবং, এক বার দখলমুক্ত হওয়া ফুটপাত যাহাতে পুনরায় দখল না হইয়া যায়, তাহারও ব্যবস্থা করিতে হইবে। গরিবের জীবিকার অধিকারকে স্বীকার করা, আর যথেচ্ছাচারের অধিকার মানিয়া লওয়া যে এক কথা নহে, তাহা স্পষ্ট ভাবে বলাই প্রশাসনের, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তব্য ছিল। তাঁহারা সেই কর্তব্য পালন করিলে শহরটির চেহারা আজ এই রকম হইত না। কিন্তু, ক্ষুদ্র স্বার্থের টান এমনই প্রবল যে অন্য কোনও কথা ভাবিবার অবকাশ সেই নেতৃত্বের হয় নাই। আশঙ্কা হয়, এখনও তাঁহারা সময় পাইবেন না।
ফুটপাতের উপর হকারের অধিকার যদি মানিতে হয়, তবে যুক্তি বলিবে, শহরের প্রতিটি ফুটপাতের প্রতিটি ইঞ্চির উপরই সেই অধিকার মানিতে হইবে। যত ক্ষণ অবধি দেশে এক জন গরিব মানুষও ফুটপাতে ব্যবসা করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতে চাহিবেন, তত ক্ষণ তাঁহাকে সেই পরিসরটি ছাড়িয়া দিতে হইবে। ইহা কতখানি অসম্ভব, নেতারাও জানিবেন। সেই দাবি যদি না মানা হয়, তবে ফুটপাতের উপর কাহারও দাবি মানিবারই প্রশ্ন নাই। যাঁহারা দখল করিয়া বসিয়া আছেন, তাঁহাদের দাবিও নহে। বস্তুত, এই দখলদারিতে তাঁহাদেরও প্রকৃত উন্নয়ন হইতেছে না। ইহা নেহাতই স্থিতাবস্থা বজায় রাখিবার রাজনৈতিক খেলা। রাজনৈতিক সমাজের যদি সত্যই গরিবের প্রতি দরদ থাকে, তবে তাঁহাদের জন্য জীবিকা অর্জনের যথার্থ পরিবেশ তৈরি করুক। নগরবাসীর পথের অধিকার কাড়িয়া লইয়া নহে। শহরের ভবিষ্যৎ নষ্ট করিয়া নহে। কলিকাতা নামক নগরীটিকে যদি বাঁচাইতে হয়, তবে আর ভিন্ন পথ নাই।