মেঘে ঢাকা তারা’র কাহিনিকার শক্তিপদ রাজগুরু (ইনসেটে)। ছবি: লেখক
ষাটের দশকে ঋত্বিককুমার ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখার পরে অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন সে ছবির কাহিনিকার শক্তিপদ রাজগুরুও বুঝি ও পার বাংলা থেকে আসা মানুষ। নইলে উদ্বাস্তু মানুষের জীবনযন্ত্রণার সূক্ষ্ম তারগুলো এমন করে ধরলেন কী করে? এই ধারণাটা এমনই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে বছর দশেক আগে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন সোজাসুজি বলেছিলেন, ‘‘প্রথমেই বলে রাখি, আমি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা, উদ্বাস্তু নই। আমাদের সাত পুরুষের ভিটে ছিল বাঁকুড়ায়। কিন্তু বাবা চাকরি করতেন ‘পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফস’-এ৷ তাই শৈশব-কৈশোরটা আমার এ জায়গা-ও জায়গা ঘুরে ঘুরে কেটেছে।’’
‘‘তার পরে বাবা যখন মারা গেলেন, তখন দারুণ দুঃখ আর দুর্দশার মধ্যে কাটল বেশ কিছু দিন। সে-ও আর এক রকম শিকড় হারানোর যন্ত্রণা। যেন এক রকম উদ্বাস্তুই হওয়া। এই যন্ত্রণাটা আমার অবচেতন মনে কোথাও ছিল৷ স্বাধীনতার পরে দেশভাগের ফলে বন্যার মতো মানুষ যখন এল তাদের খড়কুটো জীবন নিয়ে তখন ওই যন্ত্রণার জায়গাটাতেই যেন আমার খুব আপন মনে হতে লাগল তাঁদের। সেই সময় থেকে আমার উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করা আরম্ভ হল৷ আমি নিজে বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করেছি৷ তাঁদের জীবনযাত্রা দেখেছি৷ উদ্বাস্তুদের মানসিকতা, যন্ত্রণাটাকে দেখেছি৷’’
১৯২২ সালের ১ ফ্রেব্রুয়ারি বাঁকুড়া জেলার গোপবাঁধি গ্রামে শক্তিপদ রাজগুরুর জন্ম। বাড়িতে ছিল সাহিত্যের আবহাওয়া। শক্তিপদর স্মৃতিশক্তি ছোট থেকেই ছিল বেশ ভাল। ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কবিতাও মুখস্থ বলে যেতে পারতেন গড়গড় করে। পরে বাবার বদলির চাকরির সূত্রে চলে আসতে হয় মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপি গ্রামে। সেখানকার টিএন ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তার পরে চলে যান কলকাতায়। সেখানকার রিপন (এখন সুরেন্দ্রনাথ) কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। কিন্তু ক্লাসঘরের পড়াশোনার চেয়ে তাঁকে বেশি টেনেছিল খোলা আকাশের শিক্ষা। সুযোগ পেলেই জনপদের ছন্দের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তেন। আর ভ্রমণের এই অদম্য নেশা বজায় রেখেছিলেন সরকারি চাকরিজীবনেও।
চাকরি করতেন কলকাতার জেনারেল পোস্টঅফিসে। সেখানেই এক দিন আলাপ হল ঋত্বিককুমার ঘটকের সঙ্গে। কলকাতার সিঁথির মোড়ের কাছে রায়পাড়া বাই লেনের এক তলায় বসে শোনাচ্ছিলেন সেই গল্প, ‘‘অফিসে এক দিন বসে আছি। দেখা করতে এলেন আপাদমস্তক বাঙালি চেহারার এক ভদ্রলোক। লম্বা, সুন্দর চেহারা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। বয়সে তরুণ। এসে বললেন, ‘আমার নাম ঋত্বিক ঘটক৷ প্রসাদ পত্রিকায় আমি আপনার ‘চেনামুখ’ পড়েছি৷ ওটা থেকে একটা ছবি করতে চাই৷ আপনি যদি অনুমতি দেন’।
‘‘আমি অবশ্য তার আগে থেকেই ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনেছি। লেখালেখির যখন শুরু আমার তখন ‘উল্টোরথ’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ সেখানে আমাদের মতো তরুণ সাহিত্যিকদের ভাল একটা আড্ডা বসত। সেখানেই এক শনিবারে আমার এক বন্ধুর ছেলের চিকিৎসার জন্য পাঁচশো টাকা দরকার হয়ে পড়ল৷ শনিবার ততক্ষণে ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ অন্য প্রকাশকের দোকানও বন্ধ। অগত্যা প্রসাদ সিংহের কাছে গেলাম টাকা ধার করতে৷ প্রসাদ সিংহ ছিলেন সে কালের বিখ্যাত পত্রিকা ‘প্রসাদ’-এর সম্পাদক৷ মানুষটাও ছিলেন বড় ভাল। তখনই পাঁচশো টাকা দিয়ে দিলেন। অবশ্য শর্ত একটা রইল, তিন সপ্তাহের মধ্যে একটা লেখা দিতে হবে৷’’
সে গল্পটাই, ‘চেনামুখ’। বড় গল্প। আর সেটাই শক্তিপদ রাজগুরুর সাহিত্যজীবনের একটা দিকচিহ্ন হয়ে উঠবে। লেখা ছাপা হল৷ তার চার-পাঁচ দিন পরে প্রসাদ সিংহই শক্তিপদ রাজগুরুকে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন যে ঋত্বিক ঘটক তাঁকে খুঁজছেন। পরে চেনামুখ-এর উপন্যাস-রূপ প্রকাশিত হয় ডিএম লাইব্রেরি থেকে, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নামে।
‘‘গল্পের চরিত্রগুলোকে কিন্তু আমি আমার জীবনেই দেখেছি’’, খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন শক্তিপদ রাজগুরু, এই লেখককে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে কোনও যুগান্তকারী স্থান পাননি তিনি। তবু তাঁর গল্প এত মানুষের ভাল লাগে, তুমুল জনপ্রিয় হয় তাঁর গল্প থেকে তৈরি সিনেমা—এই রসায়নটা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম রায়পাড়া বাইলেনের সেই ছোট্ট ঘরটায় বসে। তখনই চমক লাগল লেখক হিসেবে তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখে। নব্বই ছুঁই ছুঁই সেই লেখক দাপটের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘বাংলা সাহিত্যকে আমি কী দিতে পেরেছি জানি না, কিন্তু যদি কিছু দিয়ে থাকি তা আমার সত্য অনুভব। আমি যা, যতটুকু, সেটুকুই থেকেছি, ইতিহাস সৃষ্টি করার ভান করিনি। বেলেঘাটায় একটা বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে বেশ কিছু কাল থেকেছি। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক একটু একটু করে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন৷ আমার দেওয়া ভাড়ার টাকাতেই সংসারটুকু চলত তাঁদের। তাঁর এক ছেলে, নাম বিনোদ, স্বপ্ন দেখত বিখ্যাত সরোদ বাজিয়ে হবে৷ পাগলের মতো ঘুরে বেড়াত সরোদ নিয়ে আর প্রায়ই রাত জেগে সম্মেলন শুনত৷ ওই বাড়ির একটি মেয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে শিক্ষিকার চাকরি পেল৷ তার সঙ্গে একটি ছেলের প্রেম ছিল। আমিই উদ্যোগী হয়ে তাদের বিয়ে দিই। এক দিন মেয়েটির মা আমাকে খুব আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘মেয়ে আমাকে দেখল? আজ এই অন্ধ স্বামী আর বেকার ছেলেদের আমি কী করে দেখব তার তো কোনও কিনারা পাচ্ছি না।’’
জীবনকে, জীবনের খুব কাছে থেকে এই ভাবেই দেখেছেন শক্তিপদ রাজগুরু। শক্তি সামন্তের ‘অমানুষ’ এক সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এ ছবির কাহিনিও শক্তিপদ রাজগুরুর। তাঁর ‘নয়া বসত’ উপন্যাসের কাহিনি ঘিরে তৈরি হয়েছিল এ ছবি। এ গল্প লেখার আগে সুন্দরবন অঞ্চলে একটানা ঘুরেছিলেন তিনি। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের কালিঝোরা অরণ্য অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন ‘অনুসন্ধান’ ছবির কাহিনি।
অরণ্যের জীবন নিয়েও লিখেছেন বেশ কয়েকটি বই। ‘দণ্ডকারণ্যের গহনে’, ‘দণ্ডক থেকে মরিচঝাঁপি’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ছোটদের জন্য তৈরি করেছেন ‘পটলা’ চরিত্র। এক সময় সম্পাদনা করেছেন ‘উল্টোরথ’ এবং ‘সিনেমাজগৎ’ পত্রিকা। বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। বেশ কিছু বই তাঁর অন্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নিজেও শিখেছিলেন মালয়ালি, তামিল, তেলুগু আর ওড়িয়া ভাষা। নব্বই বছরের জীবনে কলম থামেনি তাঁর। কিন্তু সে তুলনায় সম্মান কি পেয়েছেন সাহিত্যের খাসমহলে, প্রশ্নটা সে দিন করতে পারিনি চিরতরুণ মানুষটিকে।
আজ তাঁর মৃত্যুদিনে (১২ জুন) দাঁড়িয়ে মনে হয়, প্রশ্নটাই অবান্তর ছিল। সাহিত্যের আমদরবারে যে ভালবাসা পেয়েছেন বাঁকুড়ার এই জাতক, তাতে খাসমহলকে হয়তো থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি!
উপ-পরিচালক, গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী