উচ্চশিক্ষার উন্নতি কাকে বলে, আগে জানতে হবে

‘বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়’

সম্প্রতি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ঘোষণা করে, দেশের দশটি সরকারি ও দশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান’ (ইনস্টিটিউশন অব এমিনেন্স) আখ্যা দেওয়া হবে।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৮ ২৩:৫৩
Share:

খড়্গপুর আইআইটি।

সাড়ে সাতশো বছর আগে টমাস আকুইনাস একটা মজার কথা বলে গেছেন। একটি দেবদূত অবশ্যই একটি পাথরের চেয়ে বেশি ভাল, সৃষ্টির উন্নততর প্রকাশ; কিন্তু দু’টি দেবদূতের চেয়ে একটি দেবদূত ও একটি পাথর বেশি ভাল। ব্যাখ্যাটা মোটামুটি এই যে, দেবদূত আর পাথরের যুগলবন্দি বৈচিত্র ও পরিপূর্ণতার লক্ষণ, অতএব ঈশ্বরের সর্বময় সৃষ্টিশক্তির আরও ব্যাপক ও সার্থক অভিব্যক্তি।

Advertisement

কেন্দ্রের শাসক দল ও তাদের সঙ্ঘ খ্রিস্টান ধর্ম-দর্শনের দিকে ঝুঁকছে বলে শুনিনি, কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের হালের বিজ্ঞপ্তি ধন্দে ফেলেছে। তা হল, দেশের দশটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তিনটি রীতিমতো শ্রেষ্ঠ, দু’টি কমবেশি শ্রেষ্ঠ, ও একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি বেশি ভাল। শেষ সংযোজনটির সূত্র আকুইনাসে মিলবে না, খুঁজতে হবে বেদান্তের ঈশ্বরতত্ত্বে: নেতি, নেতি, নেতি।

সম্প্রতি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ঘোষণা করে, দেশের দশটি সরকারি ও দশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান’ (ইনস্টিটিউশন অব এমিনেন্স) আখ্যা দেওয়া হবে। সম্মানের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি প্রত্যেকে পাবে পাঁচ বছরে হাজার কোটি টাকা। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, এই দশ-দশ ভাগ কেন? যদি দেখা যায়, শ্রেষ্ঠ কুড়িটি প্রতিষ্ঠানের পনেরোটি সরকারি, তবে কি পাঁচটিকে বাদ দিয়ে তুলনায় নিরেস পাঁচটি বেসরকারি সংস্থাকে বাছা হবে? আরও একটা চমক ছিল। বেসরকারি ক্ষেত্রে আদৌ অস্তিত্ব নেই, প্রস্তাবিত মাত্র, এমন হবু-বিশ্ববিদ্যালয়ও স্বীকৃতির দাবিদার হতে পারে। অন্য সব প্রতিযোগীদের যেখানে অনেক বছরের কাজের খতিয়ান, ধাপে ধাপে গড়ে-তোলা পরিকাঠামোর বিবরণ দিতে হবে, এই প্রস্তাবিত সংস্থাগুলিকে দিতে হবে কেবল কিছু প্রতিশ্রুতি।

Advertisement

সফল বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ হয়েছে। নির্বাচন কমিটির সভাপতি ছিলেন এক প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। আর ছিলেন আমেরিকায় স্থিত দুই বিশিষ্ট ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও ভারতে স্থিত এক জন প্রবীণ ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ। তাঁদের রিপোর্ট পড়লে মনে হয়, একটা কঠিন কাজ তাঁরা যথাযোগ্য নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন, ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু মূল্যবান সাধারণ পর্যবেক্ষণও করেছেন; কিন্তু সরকারের মূল প্রস্তাবের কাঠামোয় আবদ্ধ থাকায়, সুপারিশগুলি নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।

সুপারিশে আছে কুড়িটি নয়, এগারোটি নাম। (কম মাত্রায় সাহায্যের যোগ্য বিবেচিত আরও আটটি প্রতিষ্ঠান আছে দ্বিতীয় সারিতে— গুণগত ঘাটতির জন্য নয়, পঠিত বিষয় অপেক্ষাকৃত সীমিত বলে।) এগারোটি প্রতিষ্ঠানের আটটি সরকারি: বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, চারটি আইআইটি (দিল্লি, বম্বে, মাদ্রাজ ও খড়্গপুর), এবং কেন্দ্রীয় স্তরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য স্তরে যাদবপুর ও তামিলনাড়ুর আন্না বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি সংস্থা আছে পিলানির বিড়লা ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি, মণিপাল অ্যাকাডেমি, আর সেই সঙ্গে একটি নেই-সংস্থা, প্রস্তাবিত জিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়।

এই শেষ নামটি নিয়ে বহু ব্যঙ্গবিতর্ক হয়েছে, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়েছে। তারা এক বার দায় চাপাচ্ছে কমিটির সদস্যদের উপর, এক বার ইউজিসির উপর। ইউজিসি মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা, মন্ত্রকের ছাড়পত্র বিনা তারা একতরফা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে তা অবিশ্বাস্য। তা ছাড়া এই নিরাবলম্ব প্রতিষ্ঠানগুলি আদৌ বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত তো স্বয়ং মন্ত্রকের। বলা হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে তিন বছরের মধ্যে সব কিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে চালু করে ফেলতে হবে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় সত্যিই তা ঘটবে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ইটও অদ্যাবধি গাঁথা হয়নি, ছাত্র-শিক্ষকের আগমন দূরস্থান, তা কী করে ওই সময়ের মধ্যে স্থান অর্জন করবে বিশ্বমানের একটি ‘বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান’ হিসাবে?

আরও গুরুতর প্রসঙ্গে আসি। কমিটির সুপারিশ সত্যিই শিরোধার্য হলে নির্দিষ্ট এগারোটি প্রতিষ্ঠানকেই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। ইউজিসির বিজ্ঞপ্তিতে কিন্তু নাম আছে সগুণ-নির্গুণ মিলিয়ে উক্ত তিনটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সরকারি মাত্র তিনটির: বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি, এবং দিল্লি ও মুম্বইয়ের আইআইটি। সংস্থা তিনটি বাছা হয়েছে কোয়াক্করেল্লি সিমন্ডস-এর আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন-তালিকা অনুসারে। (সমান প্রামাণ্য টাইমস হায়ার এডুকেশন-এর তালিকা ধরলে দিল্লির বদলে আসত খড়্গপুরের আইআইটি।) খড়্গপুরের সঙ্গে বাদ গেছে মাদ্রাজ আইআইটি, দিল্লি, যাদবপুর ও আন্না বিশ্ববিদ্যালয়। বর্জনের কারণ হিসাবে প্রকল্পের প্রস্তাবে দশটি সরকারি ও দশটি বেসরকারি সংস্থার সংখ্যাগত সমতাকে হঠাৎ ‘নীতি’র (প্রিন্সিপল) মর্যাদা দিয়ে বলা হচ্ছে, বেসরকারি নাম যেখানে তিনটির বেশি পাওয়া গেল না, সরকারির তালিকাও হতে হবে সমসংখ্যক।

এ বড় বিচিত্র যুক্তি। এক শ্রেণিতে যথেষ্ট উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নেই বলে অপর শ্রেণির যোগ্য নামগুলি বাতিল হয়ে যাবে? প্রকল্পের ঘোষিত লক্ষ্য তো বেসরকারি সংস্থার মানরক্ষা নয়, দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিকাশ এবং তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ত্বরায়িত করা। এমন সম্ভাবনাময় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সুযোগ রদ হলে কি দেশের উচ্চশিক্ষার বিকাশটাই বিঘ্নিত হবে না, ব্যাহত হবে না মানবসম্পদ সৃষ্টি? এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সামনে অবশ্য একটা খুড়োর কল ঝোলানো হচ্ছে: ভবিষ্যতে তাদের দাবি বিবেচনা হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও গুরুতর চাপ বোধ না করলে তা যে অচিরে হবে, এমন আশা করতে ভরসা হয় না। বরং ভয় হয়, ব্যাপারটা অনির্দিষ্ট কাল মুলতুবি থাকবে, লোকে ভুলে যাবে বা হাল ছেড়ে দেবে, নয় নতুন কোনও মাপকাঠিতে এই সংস্থাগুলির (বিশেষত রাজনৈতিক ভাবে অপছন্দের রাজ্য বা সংস্থাগুলির) দাবি খারিজ করে দেওয়া হবে।

আরও একটা কথা। ভারতে আজ উচ্চশিক্ষার স্তরে দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্র পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। (সরকারি বিশ্ববিদ্যালেয়ের অধীনস্থ বেসরকারি কলেজ এই হিসাবে ধরা হয়নি।) তাদের অধিকাংশই বিশাল দক্ষিণার বিনিময়ে কেবল ক’টা অর্থকরী বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে— প্রকট বা প্রচ্ছন্ন ভাবে এগুলি ব্যবসায়ী সংস্থা। কমিটির রিপোর্টে মোলায়েম কিন্তু ইঙ্গিতবহ ভাষায় সে কথা বলা হয়েছে। কয়েকটি সম্মাননীয় ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তার দু’টি ‘এমিনেন্স’-এর মর্যাদার জন্য সুপারিশও করা হয়েছে। আর ক’টি অপেক্ষাকৃত নতুন সংস্থার উদ্যোগ মহৎ কিন্তু সেগুলি এখনও তেমন দানা বাঁধেনি। তাদের মূল্যায়নের জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

মোটের উপর বলতে হয়, বিপুল অর্থাগম সত্ত্বেও ভারতের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তানের কেরিয়ারের পথ সুগম করলেও বৃহত্তর বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে তেমন দাগ কাটতে পারেনি; ভারতকে যথার্থ আন্তর্জাতিক বিদ্যাভূমি করে তোলার প্রচেষ্টায় তাদের বলার মতো অবদান নেই। ৭৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটি কমিটির অনুমোদন পেয়েছে, সে জায়গায় চালু বেসরকারি সংস্থার ২৯টির মধ্যে দু’টি অর্থাৎ অনেক কম অনুপাতে। অন্য ক্ষেত্রে যতই সফল হোক, বেসরকারি ও বিশেষ করে কর্পোরেট জগৎ ভারতে উচ্চশিক্ষার প্রসারে ও প্রকৃত উন্নয়নে বহুলাংশে ব্যর্থ। এ বার দেখা গেল, সেই ব্যর্থতার মাসুল সরকারি ব্যবস্থার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘সমতা’র খাতিরে উচ্চমানের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবনমনের চেষ্টা হচ্ছে। সংখ্যায় ও মানে বেসরকারি সংস্থার সাফল্যই বৃদ্ধির উচ্চসীমা বলে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে— সরকারিগুলিকে তার উপরে মাথা তুলতে দেওয়া হবে না।

সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হিসাবে একটা স্থানীয় অনুযোগ জুড়তে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণে দু’টি রাজ্য প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ আর তামিলনাড়ু। উভয় স্থানেই বঞ্চিত হয়েছে একটি করে আইআইটি ও রাজ্য স্তরের বিশ্ববিদ্যালয়। তামিলনাড়ুতে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কাছে সুবিচারের দরবার করছে। বাংলায় কর্তৃপক্ষ যে বিষয়টি নিয়ে আদৌ অবগত, তার লক্ষণ নেই। হয়তো তাঁরা ভাবছেন দু’টি প্রতিষ্ঠানের একটির এমনিই শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকবে; অন্যটির ঢের বাড় বেড়েছে, আর আশকারা দিয়ে কাজ নেই। আরও দুঃখের বিষয়, বাংলার সংবাদমাধ্যম ও সুধীসমাজে যাদবপুরের ঘরোয়া বিষয় নিয়ে যত চর্চা হচ্ছে, তার ক্ষুদ্র অংশও হচ্ছে না তার বৃহত্তর সারস্বত স্বীকৃতি, উন্নয়ন ও বঞ্চনা নিয়ে। যদি হত, অশেষ বাধার মধ্যে যে ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকরা সারস্বত সাফল্য অব্যাহত রেখেছেন তাঁরা বল পেতেন; বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিই যে ত্রুটি ও সমস্যা আছে, সেগুলি দূর করার পথ সুগম হত, আপনিই দূর হত কিছু মাত্রায়।

হিসাবটা শেষ অবধি যা-ই দাঁড়াক, কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পের জন্য মাঠে নেমেছিল ১০,০০০ কোটি টাকার সংস্থান মাথায় রেখে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য ভাবেও খরচ করা যেত, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না রেখে দেশ জুড়ে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য। তার বদলে কয়েকটি সেরা সংস্থার অসামান্য উন্নতির জন্য টাকাটা বরাদ্দ করে সরকার একটা মস্ত বাজি রেখেছে। মাঝপথে ভোল পাল্টে এখন যদি সে পিছিয়ে আসে, তবে জাতও যাবে, পেটও ভরবে না।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement