আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
১৯৩৯। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রগতি সাহিত্য সম্মিলনে তরুণ কবি বুদ্ধদেব বসু ঘোষণা করলেন, যে সময় রবীন্দ্রনাথকে গড়ে তুলেছিল, সেই সময় অনেক দিন হল অতীত। সোজা কথা, রবীন্দ্রনাথের দিন ফুরিয়েছে, তরুণ কবির মতে, তিনি এ কালের আর কেউ নন। এই অস্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথের বুকে গভীর ভাবে বেজেছিল, দুঃখ পেয়েছিলেন, অভিমান হয়েছিল তাঁর। সেই অভিমান প্রকাশ করতে দ্বিধাও করেননি। ‘আকাশপ্রদীপ’ বইয়ের ‘সময়হারা’ কবিতায় তাঁর বেদনা ধরা পড়েছিল। এই কবিতার বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বুদ্ধদেবেরই সমকালীন আর এক জন কবিকে— সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে উৎসর্গ করার কারণ, সুধীন্দ্র অস্বীকৃতির আঘাত দেননি রবীন্দ্রনাথকে।
বুদ্ধদেব যা-ই বলুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে মোটেই গুরুত্বহীন অতীতের ছায়া নন। যুদ্ধের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। নেশনের দাঁত নখ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঘন করে তুলছে। মানবতা ধ্বংসের মুখোমুখি। রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সেই সঙ্কটে অসুস্থ শরীরেও বার বার সরব হয়ে উঠলেন। পাশ্চাত্যের নেশনের প্রতি তাঁর যে ভরসা নেই একেবারে, নির্দ্বিধায় তা জানালেন।
এ দেশের জাতীয়তাবাদীরাও যখনই পাশ্চাত্যের নেশন-জাগানিয়া মডেলে নিজেদের বিপ্লবকে বলশালী করতে চেয়েছেন তখনই কিন্তু প্রতিবাদী হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। স্বাজাত্যে ও স্বাদেশিকতায় তাঁর আস্থা ছিল, কিন্তু স্বাজাত্য ও স্বাদেশিকতা যেখানে উগ্র হয়ে অন্যকে মারে সেখানে তাঁর ঘোরতর আপত্তি। এই মারার কল তৈরি করার জন্য নেতারা অনেক সময় স্বাদেশিকতার নামে নানা জিগির তোলেন। কোনও মূর্তি বা মন্ত্রকে বড় করে তোলেন। সে কালে যেমন করতেন, এ কালেও তেমনই করেন।
তরুণ কবি বুদ্ধদেব বসু ঘোষণা করলেন, যে সময় রবীন্দ্রনাথকে গড়ে তুলেছিল, সেই সময় অনেক দিন হল অতীত
১৯৩৭-এ, বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রবিরোধী ঘোষণার বছর দু’য়েক আগে বুদ্ধদেবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র চালাচালি হয়েছিল ‘বন্দেমাতরম্’ বিষয়ে। সে চিঠিপত্র পড়লে বোঝা যায়, তরুণ বুদ্ধদেবের থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেশের মানুষকে অনেক বেশি চেনেন। কে বলে তাঁর দিন গিয়েছে? ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকার ১৯৩৭-এর নভেম্বর সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু ‘গান না শ্লোগান’ নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। তাঁর বক্তব্য, ‘দেশপ্রেম মূল্যবান, কিন্তু মাত্রাজ্ঞান বলেও একটা জিনিষ’ আছে। বুদ্ধদেব মাত্রাজ্ঞানের দোহাই দিলেও এই নিবন্ধে বন্দেমাতরমের গুণ গেয়েছিলেন নানা ভাবে। বুদ্ধদেবের যুক্তিগুলি প্রায়োগিকতার বিচারে সিদ্ধ, খানিক অসচেতন ভাবেই হয়তো নরম-হিন্দুত্বের গন্ধমাখা। জানিয়েছিলেন তিনি, ‘বন্দেমাতরম্ অতি চমৎকার শ্লোগান’। বিরতিহীন প্রচারকার্যের মাধ্যমে স্তিমিত দেশপ্রেমকে জাগানোর জন্য বন্দেমাতরম্ বিকল্পহীন। সংস্কৃত বলে আওয়াজটা জমকালো। মন্ত্রটি খুব ছোট। জমকালো আওয়াজে ছোট মন্ত্রটি উচ্চারণ করলে বেশ কাজ হয়। আর এর সর্বজনীনতা বুদ্ধদেবের মতে ‘অকাট্য। স্বদেশকে মা বলাতে কোনও পৌত্তলিকতা নেই, জাতিবিদ্বেষ নেই, প্রাদেশিকতা নেই।’
বুদ্ধদেবের এই লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ নিরুপায় হয়েই চিঠি লেখেন। অনুজ কবির এই যুক্তি সচেতন রবীন্দ্রনাথ মানতে পারছিলেন না। হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক যে তলানিতে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতেই পারছিলেন। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সামাজিক দায়িত্ব অনেক বেশি তা-ও মনে করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখলেন, ‘তুমি আমাকে গাল দাওনি। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয় তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও। তর্কটা হচ্ছে এ নিয়ে যে ভারতবর্ষে ন্যাশনাল গান এমন কোনো গান হওয়া উচিত যাতে একা হিন্দু নয় কিন্তু মুসলমান খ্রীষ্টান – এমন কি ব্রাহ্মও – শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তির সঙ্গে যোগ দিতে পারে। তুমি কি বলতে চাও, “ত্বং হি দুর্গা” “কমলা কমলদল বিহারিণী, বাণী বিদ্যাদায়িনী” ইত্যাদি হিন্দুদেবীর নামধারিণীদের স্তব, যাদের প্রতিমা পূজি [গড়ি] মন্দিরে মন্দিরে” সার্বজাতিক গানে মুসলমানদের গলাধঃকরণ করাতেই হবে।” ১৯৩৭-এ রবীন্দ্রনাথ যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে প্রশ্নের সদুত্তর সে দিন বুদ্ধদেব দিতে পারেননি সে প্রশ্নটা কালের সীমা অতিক্রম করে এ কালেও আমাদের কানে বাজে। নেশনের দোহাই দিয়ে হিন্দু আইডিয়ার দোহাই দিয়ে যে শুদ্ধিকরণের জিগির হালে এ দেশে তোলা হয় তা-ও তো আসলে উগ্র জাতীয়তাবাদেরই একেলে রূপ। বুদ্ধদেব বন্দেমাতরমের পক্ষে যে যুক্তিগুলি দিয়েছেন এ কালের হিন্দুত্ববাদী নেতারাও তো তেমন শ্লোগানই খোঁজেন। ছোট, সংস্কৃতগন্ধী, জমকালো আওয়াজের শ্লোগান। এই শ্লোগানে চরমপন্থী ও নরমপন্থী হিন্দুভারত জেগে উঠুক, এই তাঁদের উদ্দেশ্য। বুদ্ধদেব যা বুঝতে পারছিলেন না, রবীন্দ্রনাথ তা কিন্তু বুঝতে পারছিলেন। অথচ দু-বছর বাদে বুদ্ধদেবই কি না বলবেন রবীন্দ্রনাথের দিন গিয়েছে!
আরও পড়ুন:পিঠে হাত রেখে কবি বললেন...
বন্দেমাতরম্ নিয়ে এই বিপদের কথা তো রবীন্দ্রনাথ উত্থাপন করেছিলেন অনেক আগে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে নিখিলেশ আর সন্দীপের বন্দেমাতরম মন্ত্র নিয়ে তীব্র তর্ক হয়। সে তো ১৯১৬ সালের কথা। নিখিলেশ সন্দীপকে বলে, কোনও একটা মন্ত্রে দেশবাসীকে ভুলিয়ে জাগিয়ে তোলার রাজনীতিতে তাঁর বিশ্বাস নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসে যখন এই বিতর্কের উত্থাপন করছিলেন তখন বাস্তবে বন্দেমাতরম্ নিয়ে বিতর্ক তেমন তৈরি হয়নি। সে বিতর্ক তৈরি হল তিনের দশকে। সময়ের থেকে এগিয়ে দেখতে পান যে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সংবেদী মন বুঝতে পারে কী হতে চলেছে। তাই ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে এসেছিল সে কথা। ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’ দুই নাটকে যথাক্রমে বৃহৎ যন্ত্র ও খনিশহর কী ভাবে নিসর্গ ধ্বংস করে তার কথা লিখেছিলেন। ১৯২৩ ও ১৯২৪-এ লেখা এই নাটক দু’টি। প্রাকৃতিক সম্পদকে একটি ভূখণ্ড কী করে কুক্ষিগত করে অন্যদের বঞ্চিত করে তার বৃত্তান্ত ধরা পড়েছে মুক্তধারা-য়। এই সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা তো তখনও ভারতীয় রাজনীতিতে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে অনেক পরে। এখন সে সবের আঁচ টের পাওয়া যায়। ভারত-বাংলাদেশের জল-চুক্তি নিয়ে কথা ঘোরে। স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’। নেহরু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ দেখে থমকে গিয়েছিলেন মুহূর্তের জন্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মিত বৃহৎ যে সবসময় মহৎ হয় না এই উপলব্ধিই যেন হয়েছিল তাঁর। নেহরু তাঁর প্রকল্প থেকে পিছিয়ে আসেননি, তবে ভেবেছিলেন। একটি লেখায় নেহরুর এই প্রতিক্রিয়ার কথা খেয়াল করিয়ে দেন শঙ্খ ঘোষ। বুদ্ধদেবরা অবশ্য এই দুয়ের দশকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তরজায় মত্ত। রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে পুরনো, তাঁদের পথরোধ করে আছেন!
আরও পড়ুন: ভাষার প্রাণ
২২ শ্রাবণ চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সেই প্রয়াণ উনিশ শতকে জন্মগ্রহণ করা এক জন বৃদ্ধ মানুষের চলে যাওয়া নয়। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সমকালের স্পন্দন অনুভব করেছিলেন। নিজের সময়কে অতিক্রম করে সভ্যতার ভবিষ্যৎ সঙ্কট টের পেয়েছিলেন। সে বিষয়ে সাবধানও করেছিলেন। আমরা বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারেননি তরুণ বুদ্ধদেব ও তাঁর সহযোগীরা। প্রগতির তকমা আর আধুনিকতার দোশালা থাকলেই কি সবসময় প্রগতিশীল হওয়া যায়!