সম্পাদকীয় ১

পরিচয়

কোনও এক জন মানুষ একই সঙ্গে পুরুষ, বাঙালি, ভারতীয়, মুসলমান, অধ্যাপক, লেখক, ক্রিকেটপ্রেমী, নিরামিষাশী, মার্কিনপ্রবাসী, গা়ড়ি চালাইতে অপটু এবং আরও অনেক কিছু হইতে পারেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০৮
Share:

কথা বলে মুখ। কিন্তু, কথা ভাবে মন। কাজেই, অনন্তকুমার হেগড়ের কটূক্তিতে উত্তেজিত না হইয়া তাঁহার মনের খবর লওয়া ভাল। তাঁহার মন ভাবিয়াছে, যাঁহারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, তাঁহারা নিজেদের পিতৃপরিচয় সম্বন্ধে অবহিত নহেন। কারণ, তাঁহারা বলেন না যে তাঁহারা মুসলমান, অথবা খ্রিস্টান, লিঙ্গায়েত, ব্রাহ্মণ বা হিন্দু। অতএব, শ্রীহেগড়ের মন সিদ্ধান্তে পৌঁছাইয়াছে যে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরা নিজেদের পরিচয় জানেন না। কথাগুলি তিনি যে ভঙ্গিতে বলিয়াছেন, তাহা কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পক্ষে শোভন কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতে পারে। কিন্তু, অনন্তকুমার হেগড়ের ইতিহাস বলিবে, প্রশ্নটি অর্থহীন। তাঁহার মন যাহা ভাবে, তিনি সেই কথাগুলি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করিতেই অভ্যস্ত। ইতিপূর্বে তিনি কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অপমানজনক উক্তি করিয়াছেন, মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছেন। তাঁহার বিরুদ্ধে একাধিক বার ‘হেট স্পিচ’-এর অভিযোগ দায়ের হইয়াছে। তিনি থামেন নাই। কারণ, তিনি সম্ভবত জানেন, এই কথাগুলি তাঁহার রাজনৈতিক জীবনের কোনও ক্ষতি করিবে না— হয়তো লাভই হইবে। অতএব, অনন্তকুমার হেগড়েদের কথার শোভনতা বিচার করা, অথবা তাঁহাদের সেই কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া নিতান্তই পণ্ডশ্রম।

Advertisement

বরং, তাঁহাদের মনগুলির কথা ভাবা যাইতে পারে। সংঘের পাঠশালার ছাত্রদের মনের নিকট ধর্মের বাড়া পরিচিতি নাই। তাঁহারা জানেন, জন্মসূত্রে মানুষের একটি ধর্ম হয়, এবং আজীবন সেই ধর্মই তাঁহার প্রথমতম পরিচয়। সংঘের মন ধর্মের পরিচয়েই বন্ধু বাছে, শত্রু চিহ্নিত করে। ধর্মের পরিচয়েই জাতিকে চিনিয়া লইতে চাহে, রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত করিতে চাহে। অতএব, কেহ নিজের জন্মসূত্রে লব্ধ ধর্মীয় পরিচয়টিকে অস্বীকার করিতে চাহিলে অনন্তকুমার হেগড়েদের নিকট তাহা অলীক ঠেকিবে বইকি। তাঁহারা ভাবিয়া লইবেন, সেই ব্যক্তি নিজের পরিচয় জানেন না। বস্তুত, হেগড়ে হয়তো উদার হইবারই চেষ্টা করিতেছিলেন— ধর্মীয় পরিচয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছেন, কেহ নিজেকে ‘মুসলমান’ হিসাবে পরিচয় দিলে তিনি খুশি হন। এতখানি উদার হইবার পরও এত সমালোচনা কেন, ভাবিয়া হেগড়ে অবাক হইবেন। অথবা ফের স্মরণ করাইয়া দিবেন, আগামী দিনে তাঁহারা সংবিধান বদলাইয়া ফেলিবেন— ভারতের সহিত আর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি থাকিবেই না।

নাগপুরের পাঠশালায় অমর্ত্য সেন পড়াইবার চল নাই। থাকিলে, তাঁহারা জানিতেন, পরিচিতি কখনও একক নহে, একমাত্রিক নহে। কোনও এক জন মানুষ একই সঙ্গে পুরুষ, বাঙালি, ভারতীয়, মুসলমান, অধ্যাপক, লেখক, ক্রিকেটপ্রেমী, নিরামিষাশী, মার্কিনপ্রবাসী, গা়ড়ি চালাইতে অপটু এবং আরও অনেক কিছু হইতে পারেন। প্রতিটি পরিচয়ই গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটির পরিসর পৃথক। ভোজসভায় আমন্ত্রিত হইলে তাঁহার মুসলমান বা ভারতীয় পরিচয়ের তুলনায় নিরামিষাশী পরিচয়টি অনেক বেশি জরুরি। এবং, প্রতিটি পরিচিতিকেই অস্বীকার করিবার, না মানিবার, অধিকারও তাঁহার আছে। তিনি শরীরে পুরুষ, কিন্তু মনে নারী হইতেই পারেন এবং নারীত্বকে নিজের পরিচয়ের অঙ্গ জ্ঞান করিতে পারেন। তিনি ভারতীয় বলিয়াই অন্য ভারতীয়দের সহিত তাঁহাকে মিশিতেই হইবে, এমন কোনও দাবিও পেশ করা চলে না। এই পরিচিতিগুলি যেমন, ধর্মের গুরুত্বও তাহার অধিক নহে। জন্মসূত্রে কেহ কোনও একটি বিশেষ ধর্মভুক্ত বলিয়াই সেই পরিচয়টিকে বহন করিয়া চলিতেই হইবে, সেই দায় কাহারও নাই। ধর্মকে অস্বীকার করিলেও (পিতৃ)পরিচয়ের ইতরবিশেষ হয় না। অন্তত তাঁহাদের, যাঁহারা শুধুমাত্র ধর্মের পরিচয়েই বাঁচিয়া থাকেন না। কিন্তু, হেগড়েরা সেই কথা বুঝিবেন কী ভাবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement