অলোক রায়। ফাইল চিত্র
বঙ্গীয় বিদ্যাচর্চায় তাঁর অবাধ বিচরণ। কিন্তু উনিশ শতকের ইতিহাসচর্চায় তাঁর আত্মপরিচয় নানা ভাবে বিকাশিত হয়েছে। তিনি অলোক রায় (১৯৩৬-২০১৯)। উনিশ শতকচর্চায় স্বনামধন্য মনস্বী গবেষক ও প্রাবন্ধিক। সম্প্রতি তিনি চলে গেলেন। উনিশ শতকের ঠিকানার জন্য আর তাঁকে আর পাওয়া যাবে না।
পারিবারিকসূত্রেই ইতিহাসচর্চার প্রতি আগ্রহ। তাঁর পিতা নৃপেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী রীতিমতো ইতিহাসচর্চা করেছেন। তাঁর মাতামহ প্রখ্যাত জীবনীকার মন্মথ ঘোষের প্রেরণাতেই তাঁর ইতিহাসযাপন সক্রিয়তা লাভ করে। অন্য দিকে, অলোক রায় আবার বিশিষ্ট মননশীল লেখক শিবনারায়ণ রায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র। সে দিক থেকে তাঁর বিগত শতকের হাতছানিতে মননশীল হয়ে ওঠাটা ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র।
স্কটিশ চার্চ কলেজে সুদীর্ঘকাল (১৯৬০-১৯৯৮ পর্যন্ত। অবসর গ্রহণের পরেও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এমিরিটাস প্রফেসর পদে মনোনীত করেছিলেন) ধরে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। অবশ্য তিনি কর্মজীবনের সূচনায় স্বল্পকালের জন্য মেদিনীপুরের ঘাটালে স্কুলের শিক্ষকতাও করেছিলেন। মাঝে মাস কয়েকের (১৯৬৬-এর জানুয়ারি থেকে জুলাই) জন্য উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তা ছাড়া আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছেন।
বাঙালির জীবনে পালাবদলের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুদীর্ঘকাল পরে মধ্যযুগীয় চেতনার অবসানে উনিশ শতকীয় নবচেতনার আলো শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি প্রভৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে। সেই ইতিহাসচর্চায় অলোক রায় উত্তরসূরি থেকে আলোকদিশারি হয়ে ওঠেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পাশ করেই তিনি প্রমথনাথ বিশীর অধীনে ‘রেনেশাঁস ও বাঙালি সমাজমন’ বিষয়ে গবেষণা শুরু করবেন ভেবেছিলেন। শেষে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের পরামর্শে রেনেশাঁসের পটভূমিতে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের উপরে গবেষণা করেন। তারই ফসল তাঁর ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’ (১৮৬৯) বইটি। অবশ্য তার পূর্বে তাঁর ‘প্রবন্ধকার বঙ্কিমচন্দ্র ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ মন’ (১৯৬৭) বইটি প্রকাশিত হয়। এ ভাবে তাঁর উনিশ শতক চর্চা এগিয়ে চলে। অলোক রায়ের স্বকীয় মনীষার অনন্য ফসল ‘আলেকজান্ডার ডাফ ও অনুগামী কয়েকজন’ (১৯৮০), ‘বাঙালি কবির কাব্য চিন্তা: উনিশ শতক’(১৯৮১), ‘শাশ্বত কলকাতা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ (১৯৮৯), ‘উনিশ শতক’(১৯৯৫) থেকে ‘উনিশ শতকে নবজাগরণ/ স্বরূপ সন্ধান’ (২০১৯)। শুধু তাই নয়, অলোক রায় তাঁর উনিশ শতক চর্চাকে গবেষণা পত্রিকা ‘Nineteenth Century Studies’র (১৯৭৩-৭৫), ‘Counterpoint’ (১৯৯৭-৯৮) প্রভৃতির সম্পাদনারও করেন। অবশ্য সুদীর্ঘকাল উনিশ শতকের চর্চায় নিজেকে সঁপে দেওয়ায় তাঁর পরিচয়েও সীমাবদ্ধতা এসে যায়।
অলোক রায় তাঁর মননশীল চর্চাকে বিশ শতকেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে উনিশ শতকের মতো ক্রমে বিশ শতকের পরিসরেও নিজেকে বিস্তার করেন। বিশ শতকের কবিতা নিয়ে তিনি যেমন আলোকপাত করেছেন ‘সন্ধিক্ষণের কবিতা’কে (২০০২), তেমনই বিশ শতকের চর্চাকেও ‘বিশ শতক’ (২০১৩)-এর মধ্যে তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, বিশ শতকের বাংলা কথাসাহিত্য নিয়ে ‘কথাসাহিত্যজিজ্ঞাসা’ (১৯৯২), একশ বছরের ছোটগল্প নিয়ে তাঁর ‘ছোটগল্পে স্বদেশ-স্বজন’ (২০১০) প্রভৃতিতে তাঁর বিশ শতকের চর্চার পরিচয় প্রতীয়মান। তাঁর প্রথম বই ‘যতীন্দ্রমোহন বাগচী: কবি ও কাব্য’ (১৯৬৪) থেকে ‘ধূর্জটিপ্রসাদ: জীবন ও গ্রন্থপঞ্জী’, ‘বাংলা উপন্যাস: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ (২০০০), ‘তারাশঙ্কর দেশকাল’ (১৯৯৮), ‘কালান্তরের কথাকার তারাশঙ্কর’ (২০০৯) প্রভৃতির মতো বিচিত্র বিষয়ে অসংখ্য বই ছাড়াও মন্মথ ঘোষ, কালিদাস রায়, দিলীপ রায়, সুকুমার সেন প্রমুখের জীবনী রচনা করে বাংলার বিদ্যাচর্চার বনেদিয়ানাকে সম্প্রসারিত করেছেন। সেইসঙ্গে অসংখ্য বই সম্পাদনা করে বিদ্যানুরাগীদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন অবলীলায়। তাঁর সম্পাদিত ‘সাহিত্যকোষ: নাটক’(১৯৬৪), ‘সাহিত্যকোষ: কথাসাহিত্য’(১৯৬৭) বইদুটি পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে আজও বহালতবিয়তে।
অন্য দিকে, উনিশ শতকের চর্চায় তাঁর আত্মপরিচয় আবর্তিত হওয়ার অবকাশে তাঁর বহুধাবিস্তৃত মনীষার পরিচয় সে ভাবে নিবিড় হয়ে ওঠেনি। অথচ তাঁর অবকাশ ছিল। অলোক রায়ের ‘বিশ শতক’ বইটির সমালোচনায় তাঁরই সমকালীন স্বনামধন্য গবেষক-প্রাবন্ধিক বারিদবরণ ঘোষ অকপটে জানিয়েছেন (‘বুদ্ধিমুক্তির সঙ্গে মানবমুক্তির বন্ধন’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ জুন ২০১১): ‘বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক অলোক রায় রচিত কয়েকটি বই পড়ার-ভাবার সুবাদে যখন এমনতর একটা ভাবনা আক্রমণ করেছিল যে, অধ্যাপক রায় উনিশ শতক নিয়ে যতখানি ভাবনা করেন, সাম্প্রতিক কাল নিয়ে ততখানি নয়। কথাটা সাহসভরে বলতে পারা যাচ্ছিল না, কারণ ইতস্তত তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধের বিষয় দেখা গেল বিশ শতক কেন্দ্রিক। সব লেখা চোখে পড়ে না বিভিন্ন কারণে। এ হেন সময়ে গোটা বিশ শতক নামে তাঁর একখানি বই পড়ার অবকাশ ঘটে গেল।’ আর সেই বইটি সম্পর্কে সমালোচকের সুদৃঢ় অভিমত, ‘‘বিশ শতক’ শব্দটি সাধারণ অর্থে তিনি প্রয়োগ করেছেন কালের নিরিখে, কিন্তু মেজাজে আর মর্জিতে এরা বাস্তবিকই বিশ শতকের।’
অভিভাবকের আসনেও সমাসীন হয়েছেন তিনি। উনিশ শতকের ইতিহাসচর্চায় তাঁর গভীর তন্বিষ্ঠা ও অভিনব মূল্যায়ন প্রকৃতি গুণীজনের শ্রদ্ধা আদায় করেছে। সেখানে রমেশ্চন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে শঙ্খ ঘোষ সকলেই রয়েছেন। স্থান-কাল-পাত্রের ত্রিবেণীসঙ্গমে অলোক রায়ের ইতিহাসচর্চা সেদিক থেকে মূল্যায়নের অভিমুখটিকেই তীব্র আবেদনক্ষম করে তুলেছে।
সাধারণত ইতিহাসচর্চায় ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ ও তার প্রভাবের বিষয়টিই প্রাধান্য লাভ করে। অথচ সেখানে তথ্যের মধ্যে তত্ত্বের ফাঁক থেকে যায়। সেই আধারে তার মূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গি ভেদে আপেক্ষিকতাও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বিশ শতকে এসে উনিশ শতকের নবজাগরণের মূল্যায়নের পরিচয়ে তা প্রকট মনে হয়। সে ক্ষেত্রে অলোক রায় যুগের প্রবণতা বা সমাজ ও মনের প্রভাব বিষয়ে আমাদের সচেতন করে তোলেন। মননের প্রবণতায় ভ্রান্তিবোধের অন্তরায়গুলিকে আন্তরিক করে অলোক রায় তাঁর উনিশ শতকের চর্চায় নবদিগন্তের সূচনা করেছিলেন। তাঁর অবর্তমানে সেই অলঙ্কারগুলিই আমাদের ঠিকানা, আমাদের আশ্রয়।
লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক