বিচ্ছেদ-পথের পথিক
Akali Dal

ভাইরাসের মতোই, বিজেপি রাজনীতি এড়িয়ে চলছে কিছু শরিক

বিহারে নির্বাচন এই মাসেই। কিন্তু জোটসঙ্গী বা ‘বন্ধু’দের মধ্যে অস্বস্তি প্রবল। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জেডিইউ দলকে সামনে রেখে এত দিন পিছনের আসন থেকে রাজ্যের গাড়ি চালিয়েছে বিজেপি।

Advertisement

সুমিত মিত্র

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২০ ০২:২৫
Share:

অ-সহচর: কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সরব শিরোমণি অকালি দল প্রেসিডেন্ট সুখবীর সিংহ বাদল ও তাঁর সঙ্গীরা, অমৃতসর, ১ অক্টোবর। পিটিআই

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি যখন ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে দ্বিতীয় বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন মনে হয়েছিল গত বারের মতো এবারও শাসক ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়ান্স রইবে হিমালয়ের মতো অনড়। এত মানুষ যখন দু’হাত তুলে গ্রহণ করেছেন বিজেপির সঙ্গে তার সহচরদের, তখন তা নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়। জোটটি টেকসই হবে।

Advertisement

কিন্তু কয়েক মাস কাটতে না কাটতেই দেখা গেল বিজেপি সম্পর্কে অস্বস্তিতে ভুগছে এনডিএ-র মধ্যে তার বন্ধুরাই। পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, বিহার— সব রাজ্যেই বিজেপির সঙ্গীরা দলটির মধ্যে কিছু একটা লক্ষ করেছে— হতে পারে অন্যকে থোড়াই কেয়ার করার প্রবণতা, যা তাদের ইতিমধ্যেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছে। তা ছাড়া অর্থনীতিতে মন্দা ও করোনা অতিমারি সামাল না-দিতে পারার প্রেক্ষাপটে মোদী সরকারের যোগ্যতা সম্পর্কেও তারা নিশ্চিত নয়। ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’, এই মন্ত্রটি নিয়ে তো সন্দেহ জন্মাচ্ছেই। আরও গভীর সন্দেহ তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

বিহারে নির্বাচন এই মাসেই। কিন্তু জোটসঙ্গী বা ‘বন্ধু’দের মধ্যে অস্বস্তি প্রবল। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জেডিইউ দলকে সামনে রেখে এত দিন পিছনের আসন থেকে রাজ্যের গাড়ি চালিয়েছে বিজেপি। নইলে উচ্চবর্ণের ঘাঁটি এই দলটির পক্ষে দলিত ও মহাদলিত-অধ্যুষিত বিহারে স্বীকৃতি পাওয়া অসম্ভব ছিল। কিন্তু নীতীশের অদক্ষ পরিচালনার জন্য দলিত ও ওবিসি-রা খুঁজছে বিকল্প। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান তা বুঝতে পারেন প্রথম। তিনি আজ না থাকলেও তাঁর পুত্র চিরাগ তাঁদের দল এলজেপি-কে নিয়ে লড়ছেন অর্ধেকের বেশি আসনে। লক্ষ্য, বিজেপির খুঁটি হিসেবে নীতীশকে স্থানচ্যুত করা। তার নির্বাচনী ফল যা-ই হোক, বিজেপির বোঝা কাঁধে আর বইতে পারবে কি না, সেই সম্পর্কে নিম্নবর্ণের সমাজ সন্দিহান। প্রসঙ্গত, সে রাজ্যে উচ্চবর্ণের অনুপাত মাত্র ১৫ শতাংশ।

Advertisement

ও দিকে পঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দলের সঙ্গে বিজেপির গঠবন্ধন চব্বিশ বছরের পুরনো কাহিনি। আজ হঠাৎ তাদের বিচ্ছেদ। সম্প্রতি সংসদে কৃষি সংক্রান্ত যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আইন পাশ করিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, তার জন্য বিজেপির জোটসঙ্গী এবং পঞ্জাবের চাষিদের নিজস্ব দল অকালিদের সঙ্গে এক বার কথাটিও বলেনি কেউ। কিন্তু সেটাই বিজেপি-অকালি বিচ্ছেদের একমাত্র হেতু নয়। মোদীর উত্থানের পর প্রয়াত অরুণ জেটলি ছাড়া কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপিতে অকালিদের সঙ্গে কথা বলার লোক পর্যন্ত ছিল না। দিল্লি নির্বাচনের সময়ে অনেক কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও বিজেপি একটি আসনও দেয়নি অকালিদের। তাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও পুনর্বিবেচনা করা হয়নি ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধন বিল। ও দিকে শিরোমণি অকালি দলের এক দলছুট অংশের অশীতিপর নেতা সুখদেব সিংহ ধিন্ডসা হয়ে উঠলেন মোদীর প্রিয়পাত্র। রাজ্যসভার এই সাংসদ গত বছর ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পেতেই বাদল-গৃহে বেজে ওঠে অ্যালার্ম ঘণ্টা।

প্রকাশ সিংহ বাদল (বর্তমান অকালি প্রধান সুখবীর বাদলের পিতা) বিজেপির সঙ্গে জোট গড়েছিলেন, কারণ রাজ্যের ৫৮ শতাংশ শিখ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সঙ্গে বাকি হিন্দুদের সমন্বয়-সেতু প্রয়োজন ছিল। সুখবীরদের ধারণা, মোদীর আমলে পঞ্জাবের হিন্দুদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ফিকে হয়ে গিয়েছে। সুখবীর সম্প্রতি রাজ্যে নিঃশব্দে এক জনমত সমীক্ষা করিয়েছিলেন। তাতে জানা যায়, পন্থ-বিশ্বাসী শিখেরা বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীকে ঘোর অপছন্দ করেন, অথচ তাঁরাই কিন্তু অকালি দলের মূল সমর্থক। এবং, শহুরে হিন্দুরা সুখবীর বাদলের থেকে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহকে পছন্দ করেন অনেক বেশি। তাই বিজেপিকে বিদায় জানানো অকালির পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। বিজেপির অভিভাবক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সমিতি অবশ্য পঞ্জাবে গড়ার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গত। ভবিষ্যৎই বলবে আরএসএস-এর ঝুলিতে এমন কোনও রাজনৈতিক ভোজবাজি আছে কি না, যার বলে সে এক একেশ্বরবাদী, অপৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসী সমাজের অভ্যন্তরে ‘অনুপ্রবেশ’ করতে পারে।

জোটসঙ্গীদের মধ্যে জল ফুটে বাষ্প জমে ছিল মহারাষ্ট্রেও। তার চাপের তীব্রতা অনুভূত হয় গত বছর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের পর। বিগত অনেক দশকের মতো সে-বারও বিজেপি এবং শিবসেনা ছিল জোটসঙ্গী। ২৮৮ আসন বিশিষ্ট কক্ষের ১০৫টি আসন পেল বিজেপি, সেনা ৫৬টি। বিধানসভাতেও দুই দলের আসন অনুপাত ছিল মোটামুটি একই। কিন্তু ক্ষমতা ছিল বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসের মুঠোয়। সেনার উদ্ধব ঠাকরে ছিলেন— বিমান-যাত্রার ভাষায়, কো-পাইলট।

শিবসেনা হল মহারাষ্ট্রের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল। তার নির্মাতা প্রয়াত কার্টুন শিল্পী বালাসাহেব ঠাকরে (উদ্ধবের পিতা) জানতেন নাগরিক আক্রোশকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার কৌশল। তখনকার বম্বে শহরের মাদ্রাজি চাকরিজীবী, উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত ফ্যাক্টরি শ্রমিক, এবং মুসলমান সমাজ, এঁদের উপর ‘দাদাগিরি’ ফলিয়ে ঠাকরে পত্তন করেন শিবসেনা দলটির। তা এখন ‘মরাঠি মানুস’-এর দল, আঞ্চলিক পরিচয়ে আবদ্ধ। এখন উদ্ধব ও তাঁর বুদ্ধিমান, শিক্ষিত পুত্র আদিত্য সম্ভবত অনুমান করেছেন, এত দিন বিজেপি তাঁদের স্কন্ধে আরোহণ করে শুধু মুম্বই পুণে নাগপুরে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রচারই করেনি, তারা ‘মরাঠি মানুস’কে কাছে টেনে নিয়েছে গ্রামাঞ্চল থেকে।

গত বছরের নির্বাচনের পরে উদ্ধব একটি বোমা ফাটান। বলেন, এই বারে মুখ্যমন্ত্রিত্ব হোক ঘূর্ণায়মান, আড়াই বছর আমার আর আড়াই বছর ফডণবীসের। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলেন নাগপুরে আরএসএস-এর কর্তারা। বিজেপির কাছে ‘না’ জবাব পেয়েই উদ্ধব এক অচিন্তনীয় জোট তৈরি করলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস ও শরদ পওয়ারের সঙ্গে। মহারাষ্ট্রের ছোট শহর ও গ্রামে মরাঠারা অধিকাংশ বিজেপির দিকে ঝোঁকা, কিন্তু প্রবীণ খেলোয়াড় পওয়ার এবং কংগ্রেসের কাছেও ছিল অনেক মরাঠি তাস, যার জোরে তৈরি হয় উদ্ধবের নকশিকাঁথা কোয়ালিশন। সেই সরকারই এখনও ক্ষমতায়। জোটটি ভাঙার চেষ্টা করেও ফডণবীস সফল হননি।

মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা দখলে রাখতে বিজেপির মরিয়া হওয়ার কারণ আছে। তার শুরু ২০১৭ বছরশেষে পুণে থেকে অদূরে ভীমা-কোরেগাঁও গ্রামে ঘটে যাওয়া জাতিভিত্তিক আন্দোলন। রাজ্য জনসংখ্যার এক বড় অংশ মাহার শ্রেণির দলিত। সংবিধান-প্রণেতা ভীমরাও অম্বেডকর ছিলেন মাহার। ১৮১৮ সালে ইঙ্গ-মরাঠা যুদ্ধের শেষ ধাপে ক্যাপ্টেন স্টনটনের অধীন মাহারদের বাহিনী পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়েছিল এক অসম যুদ্ধ, যা দলিত ইতিহাসে এক জ্বলন্ত অধ্যায়, যদিও ব্রিটিশ পতাকার তলায় মাহারদের এই বিজয় কখনও মেনে নেননি উচ্চবর্ণের জাতীয়তাবাদীরা। ২০১৭ সালের শেষ দিন ওই লড়াইয়ের ২০০ বছর উদ্যাপিত করে ‘এলগার পরিষদ’ নামে প্রায় ২৫০টি সমাজসেবী সংস্থা। পুণের পেশোয়াদের প্রাসাদের সামনে সেই বক্তৃতায় অংশগ্রহণকারীরা ফ্যাসিবাদেরও ঘোর বিরোধী। পরের দিন ভীমা-কোরেগাঁওতে হয় বিশাল দলিত জমায়েত এবং তার উপর চড়াও হয় সঙ্ঘ-সমর্থক সশস্ত্র বাহিনী। বিজেপি-শাসনাধীন রাজ্য সরকার বলে, ওই ঘটনা নাকি ছিল নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ‘মাওবাদী’ পরিকল্পনা, যে সব বুদ্ধিজীবী পুণের সভায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা ‘আরবান নকশাল’। সেখানে নাকি নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার পরিকল্পনা চলছিল। অভিযুক্তদের কেউ অধ্যাপক, কেউ কবি, কেউ আইনজীবী। পাঁচটি শহর থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁদের। আজও তাঁরা বিনা বিচারে বন্দি।

এলগার পরিষদ মামলার তাৎপর্য হল, দেশে মানবাধিকার আইনকে ভোঁতা করে হিটলারি শাসন কায়েম করা, যেখানে সরকারের সমালোচনা আর দেশদ্রোহে প্রভেদ নেই। এমন একনায়কতান্ত্রিক দলের ‘জোটসঙ্গী’ হয়ে কী লাভ? ঠাকরে পরিবার ব্যাপার বুঝেই ‘পদ্ম’-এর আখড়া থেকে সরে আসে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুহাস পালসিকারের মতে, বিজেপি হল ‘ডমিন্যান্ট পার্টি’, যার উগ্র গণতন্ত্র-বিরোধী ভাবনাধারার ছোঁয়া লাগতে পারে ছোটখাটো দলেও। ঠিক যেমন ভাইরাস নিজের আদল ঢুকিয়ে দেয় সুস্থ দেহকোষে। বিজেপির জোটসঙ্গীরা তাই আতঙ্কিত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement