Novak Djokovic

নামভূমিকায়: জুন ২০২৩

প্রবল হাঁপানিতে ভুগতেন। বোমারু বিমানের হামলা থেকে রক্ষা পান ছোটবেলায়। ইস্পাতকঠিন মনের জোরে ২৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক নোভাক জোকোভিচ।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩ ০৫:০৬
Share:

নোভাক জোকোভিচ। —ফাইল চিত্র।

কয়েক দিন আগের রলঁ গারস। তিনি এইমাত্র ফরাসি ওপেন জিতলেন। ২৩ নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম। রাফায়েল নাদালকে টপকে পুরুষদের টেনিসে সর্বাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। স্বপ্নপূরণের এমন মঞ্চে উচ্ছ্বাস দেখাবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু জেতার পরে নোভাক জোকোভিচ যা করলেন, অবিশ্বাস্য!

Advertisement

গ্যালারিতে উঠে পরিবারের সঙ্গে আলিঙ্গন সেরে কোর্টে ফিরে এলেন। গায়ে চাপানো বিশেষ জ্যাকেট। ক্যামেরা ফোকাস করল ডান কাঁধের নীচের দিকে। জ্বলজ্বল করছে সংখ্যাটা— ২৩। তার মানে? এতটাই নিশ্চিত ছিলেন তিনি জেতার ব্যাপারে যে, আগে থেকেই জ্যাকেট তৈরি করে নিয়ে এসেছিলেন! মনের ভিতরে দৃশ্যগুলো তার মানে পর পর সাজানো ছিল। ফরাসি ওপেন জিতবেন। গ্যালারিতে উঠে যাবেন। ২৩ লেখা জ্যাকেট পরে এসে রাজার মতো দাঁড়াবেন। অবিকল সে রকমই ঘটল।

ভাবুন, পেলে, দিয়েগো মারাদোনা বা লিয়োনেল মেসি বিশ্বকাপ খেলতে রওনা হওয়ার সময় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন ‘উই আর দ্য চ্যাম্পিয়ন্স’ লেখা জার্সি! উসেন বোল্ট অলিম্পিক সোনা জেতার আগে ঠিক করে রেখেছেন কোন জ্যাকেট পরে পোজ় দেবেন! সচিন তেন্ডুলকর শততম শতরানের জন্য ১০০ লেখা জার্সি অর্ডার দিয়ে রেখেছেন। কখনও হয়েছে?

Advertisement

বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, চোটের জন্য নাদাল ছিলেন না তাই। না হলে ফরাসি ওপেন জয় এত মসৃণ হত না। প্যারিসে চোদ্দো বার জিতেছেন নাদাল। অন্য কেউ এখানে জেতা মানে নাদালের বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে ফ্রিজ থেকে পানীয় বার করে সোফায় বসে পড়ার সমান। কিন্তু জোকোভিচ যে তর্কটা তুলে দিয়েছেন— সর্বকালের সেরা কে? ২০ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা ফেডেরার? মুকুটে ২২ মুক্তো থাকা নাদাল? না কি আরও পিছিয়ে যাওয়া উচিত? রড লেভার? ফেডেরার, নাদালকে পাশাপাশি রেখে তা-ও কাটাছেঁড়া করা সম্ভব কারণ তাঁরা মোটামুটি সমসাময়িক। জোকোভিচের সেরা সময় এসেছে অনেক পরে। লেভার তো সম্পূর্ণই অন্য যুগের। এখনকার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করা যায় নাকি যে, সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ালে কেমন ফল করতেন?

কেউ কেউ বলবে, ফেডেরারের সৌন্দর্য নেই নোভাকের খেলায়। ফেডেরার টেনিসের হ্যারি পটার। র‌্যাকেটকে তাঁর হাতে জাদুদণ্ড মনে হয়। সেই সম্মোহনী আকর্ষণ কোথায় নোভাকের খেলায়? ট্রফিই জিতবেন, হৃদয়ের সেন্টার কোর্টে কখনও জিতবেন না রজারের মতো। নাদালের টপ স্পিন শিল্পই বা কোথায়? পরিসংখ্যান দেখাবে, ২০১৮-র পর থেকে ১৩টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন জোকোভিচ। যে সময় থেকে রজার-রাফা সাম্রাজ্যের পতনের শুরু। ঠিক তেমনই পরিসংখ্যান বলবে, মুখোমুখি দ্বৈরথে দু’জনের চেয়ে বেশি জিতেছেন জোকোভিচ। জিমি কোনর্স বলেছিলেন, “টেনিসে হয় তুমি গ্রাস কোর্ট খেলোয়াড় বা হার্ড কোর্টে বেশি জেতো বা ক্লে কোর্ট বিশেষজ্ঞ। নয়তো তুমি রজার ফেডেরার।” এখন? নোভাকই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামই তিন বার করে জিতেছেন।

ফিট থাকার জন্য আপনি কী করেন? জন ম্যাকেনরোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এক সাংবাদিক। ম্যাকেনরোর জবাব, “টেনিস খেলি।” সেই যুগে চলত, এখন আর নয়। জোকোভিচ নতুন ‘টেনিস ম্যানুয়াল’ লিখে দিয়ে যাচ্ছেন। চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর জীবনের লক্ষ্য নয়। চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাই জীবন। তিনি নিজে যেমন। চার বছর বয়স থেকে নকল ট্রফি বানিয়ে বলতেন ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’। ফরাসি ওপেনে ২৩ নম্বর জ্যাকেট পরা দেখে টেনিস দুনিয়া অবাক হতে পারে। তিনি এমন বিজয়োৎসবের মোড়কেই নিজেকে তৈরি করেছেন। উদ্ধত? না, দুঃসাহসিক। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে এখন আর ম্যাকেনরোদের মতো শুধু খেললে হয় না। অভিযাত্রী হতে হয় যে!

ক্রমাগত লড়েছেন হাঁপানির সঙ্গে। বেশি ক্ষণ ম্যাচ চললেই বেদম হয়ে পড়তেন। ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে গ্লুটেন আর ল্যাকটোজ় ছেঁটে ফেলেন খাদ্যাভ্যাস থেকে। বাবার পিৎজ়া-প্যানকেকের রেস্তরাঁয় বড় হওয়া কারও পক্ষে খুব সহজ কাজ নয়। ঠান্ডা জল ছুঁয়েও দেখেন না। পরিপাকে সমস্যা করে বলে।

এগারো বছর বয়সে বেলগ্রেডে বোমারু বিমানের হানা থেকে ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান তিনি এবং তাঁর পরিবার। কাছের হাসপাতাল উড়ে যায় মিসাইল হানায়। হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে বাঙ্কারে পৌঁছন। তিন মাসের উপর আটকে ছিলেন বাঙ্কারে। জল নেই, খাবার নেই, শিশুরা কাঁদছে। সন্ধের পরে আলো জ্বালানো যাবে না। সেই সব আতঙ্কের রাতই তৈরি করে দিয়ে যায় ইস্পাতকঠিন মানসিকতার চ্যাম্পিয়নকে। বাঙ্কারের অন্ধকার তিনি অনেক দেখেছেন, এখন সূর্যালোক উপভোগ করার সময়।

তিনি নোভাক জোকোভিচ। না-ই বা জিতলেন ফেডেরারের মতো জনতার হৃদয়। না থাকুক রজারের ফোরহ্যান্ড জাদু বা নাদালের মায়াবী টপস্পিন। জীবনযুদ্ধে জিততে জিততে এগিয়ে যাওয়া এমন কারও ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় দেখে মনে হবে না ইনি সুপারহিরো? মনে হবে না সেরা অনুপ্রেরণা? টেনিস কী, জীবনের জাদুঘরেও তো জ্বলজ্বল করবে ২৩ লেখা জ্যাকেটটা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement