সুপ্রিম কোর্টের ৫০তম প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়। ফাইল চিত্র।
অনেকেরই মনে পড়তে পারে উত্তমকুমার-অভিনীত অগ্নীশ্বর ছবিটির কথা। তাতে একটি সভায় যেতে ডাক্তারবাবুর আধঘণ্টা দেরি হয়েছিল। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, বাড়ির ‘প্রিয় অতিথি’ তাঁর স্ত্রী সে দিন চলে গেলেন। দাহ করে আসতে দেরি হল।
বম্বে হাই কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়ের স্ত্রী রশ্মি ক্যানসারে মারা যান। দু’এক দিনের মধ্যেই তাঁকে ফের বিচারপতির এজলাসে দেখা গিয়েছিল। আইনজীবীদের বলতেন, মামলায় ভাল করে শুনানি চাইলে বেলা ১১টায় আদালত খোলার দু’ঘণ্টা আগে চলে আসুন। তিনি সকাল ন’টা থেকে মামলা শুনবেন।
বম্বে, ইলাহাবাদ হাই কোর্ট পেরিয়ে চন্দ্রচূড় এখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। আদালতের প্রাচীন প্রবাদ, তিনি নাকি রাত সাড়ে তিনটেয় ঘুমোতে যান। কখনও মেজাজ হারান না। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, মুখে সব সময় এক চিলতে হাসি লেগে থাকে।
পিতামহ বিষ্ণু চন্দ্রচূড় ছিলেন মহারাষ্ট্রের সাওন্তওয়াড়ি-র রাজার দেওয়ান। বাবা যশবন্ত চন্দ্রচূড় প্রায় সাত বছর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। পিতা-পুত্রের দেশের প্রধান বিচারপতি হওয়ার নজির ভারতে এই প্রথম। বাবা ছেলেকে শর্ত দিয়েছিলেন, যত দিন না তিনি প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন, তত দিন ছেলে ওকালতি শুরু করতে পারবেন না। চন্দ্রচূড় তাই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাশ করে হার্ভার্ডে এলএলএম পড়তে গেলেন। পিএইচ ডি-ও সেরে ফেললেন।
প্রথমে অবশ্য আইন নিয়ে পড়ারই কথা ছিল না। বাবার সঙ্গে ১২ বছর বয়সে দিল্লির তুঘলক রোডের সরকারি বাংলোয় এসে ওঠেন। স্কুল শেষ করে ভর্তি হন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। বিষয় অর্থনীতি। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই দিল্লি স্কুল অব ইকনমিকস-এ স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্লাস শুরু হতে কয়েক দিন দেরি ছিল বলে আইনের ক্লাসের অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন। জীবনের মোড় ঘুরে গেল। আইনের প্রেমে পড়ে গেলেন।
ওকালতির শুরু বম্বে হাই কোর্টে। প্রথম ওকালতির ফি হিসেবে একশো টাকাও জোটেনি। প্রবীণ আইনজীবীদের কাছে ছাত্রের মতো শিখতেন। আদালতে আসা-যাওয়ার পথে তাঁদের নিজের অ্যাম্বাসাডরে বসিয়ে ঘুরপথ ধরতেন, যাতে একটু বেশি সময় ধরে তাঁদের থেকে শেখা যায়। এখন নিজে তরুণ আইনজীবীদের সঙ্গে কথাবার্তায় প্রায়ই শিক্ষকের ভূমিকা নেন। তাঁদের আইনি যুক্তি ধৈর্য ধরে শোনেন। নিজের হাতে নোট করে নেন। তার পরে রায়ে তা এমন সুন্দর ভাবে তুলে ধরেন যে, আইনজীবীরাই অবাক হয়ে ভাবেন, ‘আমি এত ভাল সওয়াল করেছিলাম!’
এখানেই দেশের পঞ্চাশতম প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মানবিক মুখ ফুটে ওঠে। ব্যক্তিগত জীবনে। আইনি বিচারেও। দুই ছেলে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে অভিনব বম্বে হাই কোর্টের আইনজীবী। ছোট ছেলে চিন্তন ব্রিটেনে ল ফার্মে চাকরি করেন। প্রথম স্ত্রী রশ্মির মৃত্যুর কয়েক বছর পরে কল্পনা দাসের সঙ্গে বিয়ে হয়। কল্পনাও পেশায় আইনজীবী। দু’জনে বিশেষ ভাবে সক্ষম দুই বালিকা, মাহি ও প্রিয়াঙ্কাকে দত্তক নিয়েছেন। মামলার কেস-ফাইলের বাইরে চন্দ্রচূড় মগ্ন থাকেন গানবাজনায়। মা প্রভা দেবী অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর শিল্পী ছিলেন। বাড়িতে প্রায়ই আসতেন কিশোরী আমনকর। ছোটবেলায় নেওয়া তাঁর অটোগ্রাফ এখনও সযত্নে রাখা তাঁর আলমারিতে। বব ডিলান থেকে কোল্ডপ্লে-র সুরও শোনা যায় তাঁর বৈঠকখানায়।
বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড়ের একের পর এক রায়ে সাংবিধানিক অধিকার ও মহিলাদের সমান অধিকারের কথা উঠে এসেছে। ব্যক্তি পরিসরের অধিকার, আধার মামলা, ভীমা কোরেগাঁওয়ের ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছেন। প্রয়োজনে অন্য বিচারপতিদের থেকে ভিন্ন মত জানিয়েছেন। শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশাধিকার, গর্ভপাতের অধিকার, মহিলাদের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে আইনি অপরাধের তকমা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আবার লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
প্রায় দু’বছর প্রধান বিচারপতির পদে থাকবেন ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়। আদালতের করিডরে যাঁর নাম ‘ডিওয়াইসি’। তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশা তুঙ্গে। একই সঙ্গে স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কাও। ২০১৯-এর অক্টোবরে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ অযোধ্যায় রামমন্দিরের পক্ষে রায় দেয়। নিন্দুকেরা বলেন, এই রায়ের সুবাদেই গগৈ রাজ্যসভায় জায়গা পেয়েছিলেন। কৌতূহল ছিল, কে এই রায় লিখেছেন। বাবরি মসজিদ ভাঙা ভুল হয়েছিল বলেও রামমন্দিরের পক্ষে সেই রায় পড়ে সকলেই নিশ্চিত হয়েছিলেন, এতে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের আঙুলের ছাপ। তিনিই ৯২৯ পৃষ্ঠার অযোধ্যা রায় লিখেছিলেন।