শেষ পাঁচ দশক সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব খুব স্পষ্ট। চৌত্রিশ বছরের কমিউনিস্ট শাসন ছিল একটি মিথ্যে দরিদ্রদরদি শাসনকাল। তার পর নয় বছরের পরিবর্তনের সরকারও পশ্চিমবঙ্গের জন্য কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিতে ব্যর্থ। ইতিহাস-বিস্মৃত রাজনীতির সঙ্গে হিংসা এবং শোষণ যুক্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি শক্তিশালী রাজ্যে সুযোগ ও সম্ভাবনা সীমিত হয়ে গিয়েছে রাজ্যে উন্নয়ন এবং বিকাশের সূচনা ঘটার আগেই। কয়েক দশকের অদূরদর্শী বাম শাসন, কংগ্রেসের দ্বিমুখিতা এবং বাম-রাজনীতির সঙ্গে আপস, পাশাপাশি তৃণমূলের দিশাহীন রাজনীতি— পশ্চিমবঙ্গের উৎকর্ষ এবং শক্তিটুকু শুষে নিয়ে উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে, স্বাধীন ভারতের প্রথম শিল্পমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন রাজ্যের ভিতরের উন্নতির পাশাপাশি ভারতের উন্নয়নেও পশ্চিমবঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক। অনেক দিন পরে আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘সোনার বাংলা’র সূত্রে এই স্বপ্ন ও এই লক্ষ্যের কথা শুনছি আমরা। এই স্বপ্নের একটা বড় ধাপ রাজ্যের ‘সোনালি অতীত’।
কী সেই অতীত? যা এক সময় বাংলার সংস্কৃতি, ধর্মীয় উৎকর্ষ, শিল্প এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভারত-সহ সারা বিশ্বে ছাপ ফেলতে সমর্থ ছিল। দেশের প্রথম সারির রাজ্যগুলির একটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ। যখন বাঙালি সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কালিদাস নাগ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিনয় কুমার সরকার, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো অগণিত কিংবদন্তি। এই সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার এবং সোনালি অতীতের স্মৃতি কি বাঙালি মনে রেখেছে, সেই অভিমুখে কাজ করেছে? উত্তরটা পাওয়া কঠিন নয়।
সুতরাং, ‘সোনার বাংলা’ পরিকল্পনার মূল কথা হল হৃতগৌরবের পুনরুদ্ধার, এবং ভারতে তা মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম দরকার, নানা রকম নতুন কাজের উদ্যোগ দরকার। কেবল বিরোধিতার রাজনীতি করলে চলবে না। ‘নতুন ভারত’-এর ন্যায়সঙ্গত, প্রগতিশীল, স্পন্দনশীল অংশীদার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরার পথে অনেক কাজ বাকি। মনে রাখা ভাল, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত কতটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে দক্ষিণ এশিয়ায়। ভারত মহাসাগর ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমি বিশ্বের সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে। আমাদের অতীতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বিষয়টি বুঝে তা পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহার করার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি সামনে, পশ্চিমবঙ্গেরও। এই সময় একটু লাভক্ষতির হিসেব কষা ভাল। পঁচাত্তর বছর অনেক সময়— তার মধ্যে ঠিক কী পেয়েছে এই রাজ্য, কী ভাবে সে নিজের একশোতম জন্মদিনে পদার্পণ করবে বলে ভাবছে। ভারতের উন্নতিতে তার অবদানই বা কী হবে। প্রশ্নগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমেই একটা নতুন অভিমুখে যাত্রা শুরু করা যেতে পারে।
‘সোনার বাংলা’ গঠনের ভিত তৈরির প্রথম ইটটিই হল একটি সহানুভূতিশীল সরকার তৈরি করা, যারা নিশ্চিত করবে পশ্চিমবঙ্গের চিরস্থায়ী শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তৈরি হবে একটি নির্দিষ্ট সময় অনুসারে ‘রোডম্যাপ’, রাজ্যের জন্য বিশ্বমানের পরিকাঠামো তৈরির দূরদৃষ্টি, যুবসমাজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ, যার মাধ্যমে তাদের পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে যাওয়া আটকানো সম্ভব। সুনিশ্চিত হবে একটি বিস্তৃত এবং সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যব্যবস্থা। ঘটবে নারীশক্তির ক্ষমতায়ন। সমস্ত কাজ ও স্বপ্নের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সঙ্কল্প থাকবে, যেটা আজও আমাদের অধিগত হয়নি। হয়নি, কেননা যে রাজনৈতিক নেতাদের উপর এটা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব ছিল, যাঁদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল, তাঁরা আগাগোড়া ব্যর্থ হয়েছেন, চিন্তাবিযুক্ত ও কল্পনাশক্তিহীন বিশ্ববাংলা ‘উপহার’ দিয়েছেন আমাদের।
ক্রমাগত হিংসা ও বিরোধিতার রাজনীতি, চুরিচামারি দুর্নীতির মাধ্যমে সরকার চালিয়ে যাওয়ার কথা যাঁরা ভাবেন, তাঁদের পক্ষে সদিচ্ছার রাজনীতি করা সম্ভব নয়। এই সব ভ্রান্ত পথ পরিহার করে সেবা ও সংগঠনের রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গ ফিরবে কি না, সেটা তাকেই ভাবতে হবে। দীর্ঘ সময়কাল ধরে এই সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে।
ডিরেক্টর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রিসার্চ ফাউন্ডেশন, দিল্লি