কোনটি অধিক জরুরি— অতিমারি পরিস্থিতিতে বেসরকারি স্কুলগুলির ফি কমানো, না কি নানাবিধ ব্যয়ে স্কুলগুলির বাধ্যবাধকতার কথা ভাবিয়া তাহা অপরিবর্তিত রাখা? আপাতত, কলিকাতা হাই কোর্ট তো বটেই, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও ফি হ্রাসের দিকেই ঝুঁকিয়াছে। ইতিপূর্বে ফি-সংক্রান্ত হাই কোর্টের রায়টিতে যে সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করিবে না, তাহা শেষ অক্টোবরের অন্তবর্তিকালীন আদেশেই স্পষ্ট হইয়াছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট সেই আদেশটি আরও সম্প্রসারিত করিল। অর্থাৎ, অতিমারি পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি এবং চার্চ পরিচালিত স্কুলগুলিতেও টিউশন ফি ২০ শতাংশ মকুব করিতে হইবে, এবং স্কুল বন্ধ থাকিবার কারণে অন্য যে সকল পরিষেবা মিলিতেছে না, তাহার জন্য কোনও ফি লওয়া চলিবে না।
বস্তুত এই আইনি লড়াই কয়েক মাস ধরিয়া চলিতেছে। দু’পক্ষেরই যথেষ্ট যুক্তি আছে। লকডাউনে বহু মানুষ কর্মহীন। আয় কমিয়াছে বহু পরিবারের। সুতরাং, স্কুল ফি অবিলম্বে কিছু না কমাইলে অনেকের সন্তানের শিক্ষা হয়তো মাঝপথে থামিত। অপর পক্ষে, বেসরকারি স্কুলগুলিও সরকারি আনুকূল্য পায় না। পড়ুয়াদের প্রদেয় ফি হইতেই কর্মীদের বেতন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় চালাইতে হয়। লকডাউনেও তাহাদের খরচ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে নাই। ফি কমানো হইলে তাহারাই বা চালাইবে কী উপায়ে? আরও একটি যুক্তি আছে। বস্তুত সর্বাপেক্ষা জোরালো যুক্তি— বেসরকারি এবং চার্চ পরিচালিত স্কুলের ফি সংক্রান্ত বিষয়ে সরকার হস্তক্ষেপ করিবে কেন? ইতিপূর্বে সর্বোচ্চ আদালতেরই একাধিক রায়ে বলা হইয়াছিল, বেসরকারি স্কুল সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে নিজেদের পরিচালিত করিবে। তাহাদের কার্যে সরকার হস্তক্ষেপ করিবে না। সুতরাং স্কুলগুলির প্রশ্ন, এই নির্দেশ কি সেই সকল রায়ের পরিপন্থী নহে? উত্তরে বলা চলে, না, পরিপন্থী নহে। কারণ, সেই রায়ের সময় অতিমারি আসে নাই। কোভিড-১৯’এর আগমনকে জরুরি অবস্থার সঙ্গে তুলনা করিলে অত্যুক্তি হয় না। এমন অনেক সিদ্ধান্ত এই সময় লওয়া হইতেছে, বা আগামী দিনেও হইবে, যাহা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অকল্পনীয় ছিল। সুতরাং, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্বের রায় আঁকড়াইয়া থাকিলে চলিবে না। এই জরুরি পরিস্থিতিতে শিক্ষার অধিকারটি যাহাতে ব্যাহত না হয়, সুলভে সকলের কাছে পৌঁছাইতে পারে, ইহা সুনিশ্চিত করাই আপাতত সকল পক্ষের কর্তব্য।
লক্ষণীয়, ফি মকুবের পরেও অভিভাবকেরা ব্যক্তিগত ভাবে আরও কিছু অতিরিক্ত ছাড়ের আবেদন জানাইতে পারেন, এবং স্কুল তাহাতে কর্ণপাত না করিলে কমিটির দ্বারস্থ হইতে পারেন— হাই কোর্টের রায়ের এই অংশটিতে স্থগিতাদেশ দিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, অতিরিক্ত ছাড়ের বিষয়টি বিদ্যালয় এবং অভিভাবকদের পারস্পরিক আলোচনার উপরই ছাড়িয়া রাখা হইল। আদালত সেখানে হস্তক্ষেপ করিবে না। সিদ্ধান্তটি যথোপযুক্ত। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দান ও গ্রহণের ক্ষেত্র নহে। শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়ের মধ্যকার সম্পর্কটি তাহা অপেক্ষা অনেক গভীর। বিদ্যালয়কে পড়ুয়ার দ্বিতীয় গৃহ অকারণে বলা হয় না। এই বিপদকালই তো পরস্পরের প্রয়োজনকে বুঝিয়া লইবার শ্রেষ্ঠ সময়। সেখানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন কী?