জনচৈতন্য: সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর বিরুদ্ধে জনমিছিল, রাঁচি, ৮ জানুয়ারি। পিটিআই
দিল্লির শাহিনবাগে এক অবস্থানরত মহিলাকে সাংবাদিক প্রশ্ন করছেন, এই শীতের রাতে শিশুকোলে বসে কী ভাবছেন? আপনাদের দাবি কি পূর্ণ হবে? উত্তর— সরকার এ দেশ থেকে চলে যেতে বললে যাব কোথায়? এ তো আমার দেশ! পঞ্চাশ বছরের ওপর এই শহরের মেয়ে আমি, আমার বাবাও এখানে মানুষ, কী কাগজ দেখাব? কেন দেখাব? পরের প্রশ্ন: কিন্তু অম্বেডকরের ছবি কেন? উত্তর: সংবিধানকে আমরা সামনে রেখেছি। বাবাসাহেবের ছবি আমাদের হাতে হাতে, দেখেছেন?
অন্য আর এক ছবি। দিল্লিতে জামা মসজিদের বিশাল সিঁড়িতে মানুষের ভিড়। তার মধ্যে ক্যামেরায় ধরা পড়ছে ভীম বাহিনির নেতা চন্দ্রশেখর আজাদের হাতে একটা মোটা বই, দেশের সংবিধান। আজাদ পড়ছেন সংবিধানের মুখবন্ধ। গ্রেফতার হওয়ার পরও তাঁর হাতিয়ার ছিল সংবিধানের মুখবন্ধের সেই বিখ্যাত শব্দগুলি, ‘‘আমরা, ভারতের জনগণ ...’’।
এই সব নানা ঘটনার একটিই দ্যোতনা। আমরা রাষ্ট্র উৎখাতের পথে নামিনি, আমরা রাষ্ট্রের সংবিধানকে আশ্রয় করে বাঁচতে চাই। মর্যাদার ভিত্তি এই সংবিধান। বৈষম্য-বিরোধী ধারাগুলি, যেমন ১৬ ও ২১ নং ধারা। স্বাধীনতার জন্য ১৯ নং ধারা। যাঁরা সংবিধান পড়েননি বা জানেন না, তাঁরাও সংবিধান তুলে ধরছেন। সংবিধানের মুদ্রণের সংখ্যা বেড়েছে। কোথাও প্রচ্ছদে অম্বেডকরের মুখ। কোথাও জাতীয় পতাকা। কেউ বলছেন, আদালতে নিশ্চয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রত্যাখ্যাত হবে, এটা সংবিধানের মুখবন্ধের বিরোধী। কূটযুক্তি এসেছে, মুখবন্ধ তো সংবিধান নয়। প্রত্যুত্তর এসেছে, মুখবন্ধ যদি নাকচ হয়ে যায়, তবে গোটা সংবিধানই নাকচ হয়ে যাবে।
প্রাতিষ্ঠানিক পথেও সংবিধান নতুন করে উঠে আসছে। কোথাও রাজ্য সরকার সর্বোচ্চ আদালতে হাজির হয়েছে এই আইনকে সংবিধানের ভিত্তিতে নাকচ করার দাবিতে। কোথাও প্রাদেশিক বিধানসভা বা মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করছেন, এই আইন অসাংবিধানিক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ-জনপথ— সর্বত্র অসহযোগের নতুন বাণী। এত দিন জানা ছিল সংবিধান জনজীবনে ছাপ ফেলে আইনের মাধ্যমে। এখন আইন অমান্য চলছে সংবিধানের নামে। যেন এক নতুন সাংবিধানিক চৈতন্য, কিংবা জনতার নতুন সংবিধানবোধ। যে ভাবে দীর্ঘ কালের ক্ষোভ দেশ জুড়ে নানা ভঙ্গিতে প্রকাশিত, তাতে বলা চলে এ হল অভ্যুত্থানমূলক সাংবিধানিকতা, বা দ্রোহকালের সংবিধানবোধ।
এই সংবিধানবোধের সূচনা অনেক দিন আগে। বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার, ভগবতী, আইনজ্ঞ উপেন্দ্র বক্সীর মতো চিন্তাবিদ নতুন পথের ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বক্সী প্রশ্ন তোলেন, স্বাধীন জনসাধারণের অধিকারকে কি আমরা সাধারণ অধিকারতত্ত্ব দিয়ে বুঝতে পারব? ভগবতী প্রশ্ন করেন, সাধারণ মানুষের ন্যায়ের স্বার্থে বিচারালয়ের দরজায় সরাসরি ধাক্কা দেওয়া যাবে না কেন? অবশ্যই, তাঁদের এই সব প্রশ্ন সাংবিধানিকতাকে বিচারব্যবস্থা-কেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। সেই উদ্দেশ্যও হয়তো ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল রক্ষণশীল বিচারপ্রতিষ্ঠানকে প্রগতিশীল করে তোলা। আর ঠিক এইখানেই আজকের সাংবিধানিক ভাবনার বৈশিষ্ট্য, যার জন্ম রাস্তায়। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর তত্ত্ব হয়তো রাস্তায় নামা মানুষ জানে না। ক্ষমতার বিভাজন, স্বতন্ত্রীকরণ ইত্যাদিও অজানা। কিন্তু এই বিদ্রোহী সাংবিধানিকতার কেন্দ্রে একটিই প্রশ্ন, তা হল— ন্যায়ের কী হবে? সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক ন্যায় বাদ দিয়ে আইনি ন্যায়ের আর কী অর্থ থাকে? রাজনৈতিক ন্যায়েরই বা মানে কী, যদি মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা নিশ্চিত না হয়?
যে তীব্র জন-অসন্তোষ ঘটছে, তাতে চোখে পড়ার মতো উপাদান: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ, তার প্রতি দলিত শ্রেণির মানুষের ব্যাপক সমর্থন। স্মরণ করুন সংবিধান পরিষদে নেহরু-পটেল দু’জনেরই বক্তব্য যে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সদিচ্ছার উপরই নির্ভরশীল। ভারতীয় সংবিধান সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য কোনও বিশেষ পরিচ্ছেদ রাখার ধারণাও কিন্তু শেষে ত্যাগ করেছিল। আজ যে নতুন সাংবিধানিক চৈতন্যের প্রকাশ আমরা দেখছি, তা-ও সংখ্যালঘুর অধিকারের ধারণাকে ঘিরে ঘটছে না, ঘটছে বৈষম্যের বিরোধিতায়, ন্যায়ের দাবিতে।
জনতার এই সংবিধান বোধের চারটি বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, সংবিধান আইনের শাসনের প্রতীক নয়, সংবিধান দেশের প্রতীক। সংবিধানের মুখবন্ধ দেশের আদর্শের প্রতীক। একে জাতীয়তাবাদ বলা যাবে না। এ এক নতুন ধরনের সংহতির দিশারি।
দ্বিতীয়ত, এই নতুন সংহতি নির্মাণে জাতীয় আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে: জনতার সার্বভৌমত্ব, আলাপচারিতার রাজনীতি, আইন অমান্যের ঔচিত্যবোধ— এই ধরনের যা যা বিষয় স্বদেশি যুগের আমরা দেখেছিলাম। আইন অমান্যের কোন পথ সঙ্গত, রাজ্যের অধিকার, দলিত-সংখ্যালঘু ঐক্য, যুক্তরাষ্ট্রিক ভাবনা: এই সবই সে দিন ছিল জাতীয় আন্দোলনের সামনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, জাতীয় আন্দোলনের যুগে ১৯২৮ সালে সংবিধান তৈরির উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। সেই উদ্যোগের শরিক ছিলেন জওহরলাল নেহরু, সুভাষ বসু। ১৯২৯-এ লাহোর অধিবেশনে গৃহীত হল পূর্ণ স্বরাজ প্রস্তাব। দেশের সংবিধানের মর্ম রূপে ঘোষিত হল পূর্ণ স্বাধীনতা। এর পরের সাংবিধানিক মুহূর্ত ১৯৪৬-৪৯-এর সংবিধান পরিষদকে ঘিরে। মতের বহুত্ব এবং আলোচনার তীব্রতার কথা স্মরণ করলে এইটুকু বলাই যায় যে আজ সংবিধান পরিষদ গঠিত হলে সম্ভবত এই পরিমাণ মতবৈচিত্র পাওয়া যেত না। পরবর্তী মুহূর্ত ১৯৭৪-৭৮ সাল। জনতা সরকারের ধারণা, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিচার, আরও কিছু সাংবিধানিক মূল্যবোধ বা ঔচিত্যবোধ সেই বছরগুলির সৃষ্টি। আর আমাদের এই সময় হল দেশের জীবনে চতুর্থ সাংবিধানিক মুহূর্ত। এই প্রথম আইনজ্ঞ আর বিচারজ্ঞরা এই নতুন সাংবিধানিক ভাবনার জন্ম দিচ্ছেন না। তাঁদের স্থান নিয়েছে পথের রাজনীতি, ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষার জনবাদী অভিব্যক্তি।
চতুর্থ ও শেষ বৈশিষ্ট্য: এই নতুন সাংবিধানিক চিন্তা যে ভাবে সংবিধান ও আইনের মাঝের সম্পর্ককে নতুন ভাবে ভেবেছে। এত দিন ভাবা হত, আইনের মাধ্যমে সংবিধান মূর্ত হয়। এখন আওয়াজ উঠেছে, যে আইন সাংবিধানিক ঔচিত্য মানে না, সে আইনের মর্যাদা নেই। ‘আজাদি’ কথাটির অর্থ কী? শুধুই স্বাধীনতা, না কি এক প্রতিবাদস্পৃহা? এক নতুন আদর্শের ইঙ্গিত? এক ধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণবোধ?
একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই জনবাদী সাংবিধানিক চিন্তা এল কী করে? প্রজাতন্ত্রের ৭০তম বার্ষিকীতে প্রশ্নটা বিশেষ গুরুতর।
কিছু বছর বাদ দিলে স্বাধীন ভারতে আইনের অনুশাসন মিশ্রিত হত নমনীয়তার সঙ্গে। শাসকদের ক্রমশ ধারণা হল যে এতে দেশ বিশৃঙ্খলায় ভরে যাচ্ছে। অর্থনীতি এগোচ্ছে না। মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ দিক থেকেই ফৌজি কর্তা, শিল্পপতি, পুলিশের কর্তা, বিচারক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একাংশের মনে হতে লাগল আইনের অনুশাসন দৃঢ় করা দরকার। নৈরাজ্য বরদাস্ত করা হবে না। দেশের অখণ্ডতা ও সংহতি বজায় রাখতে প্রয়োজনে সব পদক্ষেপ করা হবে। বর্তমানে এই প্রশাসনিক বোধই চরম মাত্রা ধারণ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতিবোধ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। এর বিপরীতেই উঠে এসেছে নতুন সংবিধানবোধ। আইন অমান্য ও প্রতিরোধের আবহে জন্ম হওয়া এই সাংবিধানিকতা হল এক বিদ্রোহী সংবিধানবোধ। আইনের অনুশাসন ত্রাস সৃষ্টি করলে তাকে বাধা দেওয়া যাবে কোন পথে? নব্য সাংবিধানিকতার প্রাসঙ্গিকতা এইখানেই।
প্রশাসন ভাবছে, আইনি পথে কী ভাবে সমাজকে একটা ছাঁচে ফেলা যায়। আর জনতা সন্ধান করছে, কী ভাবে আইনের ত্রাসের মোকাবিলা করা যায়। লক্ষণীয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলি জনতার পিছনে চলেছে। আজ তাদের কাজ জনবাদী সাংবিধানিক চৈতন্যের স্বরূপ উপলব্ধি করা। প্রশাসনের সমস্যা তাই রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ে নয়— জনবাদী রাজনীতি নিয়ে। প্রতিবাদ আজ দেশদ্রোহিতা শাসকের কাছে: এই দুর্ভাবনা নিয়েই চলতে হবে তাকে। এরই নাম দ্রোহকাল।
আমরা কেউ জানি না আইন অমান্যের স্ফুলিঙ্গগুলি কোথা থেকে এসে শুকনো পাতায়, ঘাসে আগুন লাগিয়েছে। আমরা জানি না, নতুন কোনও জয়প্রকাশ নারায়ণ ছাড়া এই প্রতিরোধ এত বড় আকার ধারণ করল কী ভাবে। হয়তো এর উত্তর অজানা থাকবে, হয়তো উত্তরের প্রয়োজনও নেই। হয়তো এইটুকু লক্ষ করাই যথেষ্ট যে প্রতিরোধের রণধ্বনিটি হল— আমরা সবাই নাগরিক। দ্রোহকালের সংবিধানবোধই এই ধ্বনির জনক।