খেউড় তাঁর ভিত্তি। খ্যাতি তাঁর ভবিষ্যৎ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ইদানীং এক সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। কথায়-লেখায় ভদ্দরজনদের পুচুপুচু ছেলেরা চারটি গালি দিয়ে ‘সাবঅল্টার্ন’ সাজতে যায়। এই সব গালিগালাজ ও খেউড়ে আমার কোনও অ্যালার্জি নেই। কিন্তু প্রশ্ন আছে। নবারুণ ভট্টাচার্য বা তাঁরও আগের হাংরি জেনারেশনের লেখকদের, এমনকি, সমরেশ বসু বা আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের লেখাতেও গালিগালাজ ও খেউড় ছিল। কিন্তু ও সবের প্রাবল্য ছাপিয়ে সেই সব চরিত্রদের যে তীব্র সামাজিক সঙ্কট পাঠককে গ্রাস করে, তা অনুধাবন না করে শুধু গালিগালাজ ও খেউড় দিয়ে কি তাঁদের সমকক্ষ হওয়া সম্ভব? রোদ্দূর রায়ের প্রসঙ্গেই প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিল ফের।
আমার ছেলেবেলা যে জনপদে কেটেছে, আক্ষরিক অর্থেই ‘শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে। শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর।’ ভোর থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়া অবধি গালাগালির ঢেউ বইত। বাবা ছেলেকে, ছেলে মাকে, মা বোনকে, বোন বাবাকে, বন্ধু বন্ধুকে গালাগালিই করত। কিন্তু সেগুলি ছিল সাময়িক ক্রোধ আর ক্ষোভের তীব্রতার বহিঃপ্রকাশ। কেউ ভেবেচিন্তে, অর্থবহ গালিগালাজ করছে— এটা ভদ্রলোকের পাড়ায় এসে প্রথম শুনেছিলাম। রূপঙ্কর বাগচিকে গালিগালাজ করে রোদ্দূর একটি লাইভ করেছিলেন। ওই একই লাইভে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে করা বিশেষ এবং বাছা গালি-শব্দের ব্যবচ্ছেদ করে রোদ্দূর আমাদের সেটাই জানালেন, যা আমরা প্রত্যেকে গত ৫০ বছর ধরে জানি!
বৃহস্পতিবার আদালতে চত্বরে রোদ্দূর রায়। ছবি: অভিষেক মিত্র।
রোদ্দূরের ‘মোক্সাগীতি’ আমি নিয়মিত শুনি। বেশ কয়েক বছর ধরেই। ছ্যাবলামিরও একটা বিনোদনমূল্য আছে। আলজিভ অবধি দর্শনীয় করে তুলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গাওয়া সহজ নয়। অনেকে আমায় বলেছেন, এটা একটা অসুখ। নাম ‘অ্যাটেনশন সিকিং বিহেভিয়ার’। অর্থাৎ মনোযোগ আকর্ষণকারী আচরণ। সে হোক গে! আমরা সবাই কম বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে তো চাই-ই। তার জন্য যখন তখন লক্ষ্মণগণ্ডি পেরিয়েও যাই। পরিচিত এক জন সে দিন জিজ্ঞাসা করল, কোনটা লক্ষ্মণগণ্ডি, সেটা কে ঠিক করে দিল? আমি বললাম, নাগরিক সমাজই ঠিক করে দিয়েছে। সেই নাগরিক সমাজেই রোদ্দূরের জন্য জায়গা ‘সংরক্ষণ’ করতে তাঁর অনুগামীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে চলেছেন।
রোদ্দূর তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বড় চাকরি করেন। উচ্চশিক্ষিত। উপন্যাস লিখেছেন। কবিতা লেখেন। মনস্তত্ত্বের উপর বইও লিখছেন। তিনি ‘আইকনোক্লাস্ট’। তিনি থাঙ্কোমণি কুট্টিকে চেনেন। অতএব, তিনি সুশীল। খেউড় তাঁর ভিত্তি। খ্যাতি তাঁর ভবিষ্যৎ। খেউড় অশ্লীল নয়। কারণ খেউড় এবং গালিগালাজ জনগণের মুখের ভাষা। রোদ্দূরের এমনই ব্যক্তিত্ব যে, কেউ প্রশ্ন তোলে না— কলঘরের নগ্ন স্নান আর শোওয়ার ঘরের মৈথুন বাস্তব হলেও জনগণ সর্বসমক্ষে তা করে না কেন? রোদ্দূর বিখ্যাত হতে চেয়েছিলেন। রোদ্দূর বিখ্যাত হতে পেরেছেন। মনে রাখতে হবে, তাঁর গাওয়া ‘…চাঁদ উঠেছিল’ বিকল্প জাতীয় সঙ্গীতও হতে পারে!
কেউ ভেবেচিন্তে, অর্থবহ গালিগালাজ করছে— এটা ভদ্রলোকের পাড়ায় এসে প্রথম শুনেছিলাম।
আমরা যখন কলেজছাত্র, তখন হস্টেলগুলিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ‘খিল্লি’ করার রেওয়াজ ছিল। অসম থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিহার পর্যন্ত বাঙালি অধ্যুষিত হস্টেল মানেই আবেগ জড়ানো খেউড়-গান আবশ্যিক। মনে আছে, দ্বারভাঙায় রামকৃষ্ণ’দা খালি গলায় নিখুঁত সুরে রবীন্দ্রনাথের ‘নদী আপন বেগে…’ শুনিয়েছিল। শুধু শুরুর ‘ওগো’ শব্দটিকে একটি প্রচলিত ‘গালি’তে বদলে দিয়েছিল। শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নয়, লোকগীতি, কীর্তন— কিছুই রেহাই পেত না মধ্যরাতের সেই প্যারডি-জলসার হাত থেকে। কাজেই রোদ্দূর নতুন কিছু করেননি। তাই ‘...চাঁদ উঠেছিল’ গানের জন্য তাঁকে কোনও অতিরিক্ত পয়েন্ট দিতে পারিনি।এ হেন রোদ্দূরকে গোয়া থেকে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করে এনেছে। তাঁর পুলিশ হেফাজতও হয়েছে কয়েক দিনের।
কিন্তু রূপঙ্করকে গালিগালাজ করা রোদ্দূরের লাইভ ভিডিয়োটি দেখে প্রথমেই হোঁচট খেয়েছিলাম। রোদ্দূর, পরম বিপ্লবী রোদ্দূর, লাইভটি শুরু করেছিলেন রূপঙ্করকে গাল দিয়ে। কিন্তু লাইভের প্রায় শেষ পর্বে আক্রমণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রূপঙ্করের ভিডিয়োটি মনে করে দেখুন। তিনি তিনটি পয়েন্ট বলেছেন। এক, ‘‘কেকে এক জন ওয়ান্ডারফুল গায়ক, প্রতি অনুষ্ঠানে প্রচুর টাকা পান, যা বাংলার শিল্পীরা কল্পনাতেও আন্দাজ করতে পারেন না।’’ দুই, ‘‘কে কেকে? আমরা বাংলার এত সব গায়ক কেকে-র থেকে ভাল গাই।’’ তিন, ‘‘কত দিন বম্বের মুখ চেয়ে থাকবেন? সাউথ ইন্ডিয়া, পঞ্জাব, ওড়িশাকে দেখুন। বাংলার শিল্পীদের কথা ভাবুন, বাঙালি হোন।’’ রূপঙ্করের ফেসবুক পেজে গিয়ে আমি দেখেছি, তাঁর বেশির ভাগ পোস্টেই ২৫, ৪৫, ২০০, ৫০০ ‘লাইক’ পড়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুহূর্তের মধ্যে সে পোস্ট ভাইরাল হল আর গালাগালির বন্যা বইতে শুরু করল।
এক শিল্পীর অন্য এক শিল্পীকে এ রকম বলা নাকি ‘পাপ’! আগুনে ঘৃতাহুতি দিল কেকে-র হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। রূপঙ্কর মুহূর্তে ভারত-কুখ্যাত হয়ে গেলেন। কেউ এ প্রশ্ন তুললেন না, বাঙালিয়ানার প্রশ্নটি ময়দান থেকে উবে গেল কী করে? কেউ এ প্রশ্ন তুললেন না, বলিউড ভার্সেস টলিউডের যে বিরোধাভাস রূপঙ্কর তুলেছিলেন, তা কোথায় গায়েব হয়ে গেল? কেউ এ প্রশ্ন তুললেন না, এই গণহিস্টিরিয়ার পিছনে কোনও সংগঠিত শক্তি কাজ করল কি? যারা হিন্দি বলয়ের প্রচার ও প্রসার এই বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী— তারা কি কোনও ভাবে... । এটা হিন্দি বনাম বাংলার লড়াই নয় তো? সর্বভারতীয় বনাম আঞ্চলিকের লড়াই নয় তো? হিসাবটা মিলছে না।
গত ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, পেশাদার বাঙালি গায়ক, শিল্পী, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্রকর্মী, সাহিত্যিক, ভাস্কর, সংবাদকর্মীদের গরিষ্ঠ অংশ কখনও প্রকাশ্যে, কখনও গোপনে স্বপেশার অন্যদের সম্পর্কে এমন শব্দ ও বাক্য প্রয়োগ করেন যা শুনে রোদ্দূরও লজ্জা পাবেন। সদ্যপ্রয়াত এক বাঙালি চলচ্চিত্র-নায়ক কিছু দিন আগে অভিযোগ করেছিলেন, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা কলকাঠি নেড়ে তাঁর কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছেন। সে সময় বাঙালি তারিয়ে তারিয়ে ওই কেচ্ছাকাহিনি উপভোগ করেছে। ‘পরিবর্তন’-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে টিভি বিতর্কে অংশ নিয়ে তৎকালীন বামপন্থী এক কবি এক বর্ষীয়ান শিল্পীকে পরস্বপহারী এবং আত্মহত্যায় প্ররোচক বলেও অভিযুক্ত করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা দু’জনেই এখন একই দলে। বাংলা গানের মোড় ঘোরানো দুই মহান শিল্পীর মধ্যে চানাচুর-ঠোঙা বিতর্ক আজও অমলিন।
রূপঙ্কর যাঁদের নাম করে বলেছিলেন কেকে-র থেকে ভাল গান, তাঁরা সবাই ‘ওটা ওঁর ব্যক্তিগত মত’ বলে মই কেড়ে নিয়েছেন। আর রোদ্দূর কেকে-র শোকে এক্সপ্রেশন দিচ্ছেন! যে হেতু ভারতীয় রাষ্ট্রের দমনপীড়ন বিধি ভুবনবিদিত, তাই বাক্স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠাই যে কোনও সুনাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। পাশাপাশি, আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান সব চাইতে ‘ভালনারেব্ল’ বলে তাদের সম্বন্ধে আদিরসাত্মক মন্তব্য, স্থূল জোকস, ধর্ষকামের প্রাবল্য। নারীর অবমাননার বিরুদ্ধে সংবেদনশীল মানুষ মাত্রেই তাই গর্জে ওঠা উচিত। কিন্তু সমস্যা হল, এই বিশেষ ক্ষেত্রে মমতা নিজেই রাষ্ট্রের প্রতীক। আবার একই সঙ্গে পুরুষাঙ্গ প্রতীক (ফ্যালাস সিম্বল) নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ‘মিসোজিনিস্ট’ এক ‘অ্যাটেনশন সিকার’-এর শিকারও তিনি। যদিও মমতা কেন, যে কোনও সাধারণ মহিলাকে (তিনি গৃহকর্ত্রী বা জননেত্রী যা কিছু হতে পারেন) এ ভাবে বাক্যধর্ষণ করলেই রোদ্দূরের ‘মি টু’ কেস খেয়ে যাওয়ার কথা!আসলে সমাজবিপ্লবীদের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর দ্বিচারিতা কাজ করে— আমি আইন ভাঙব, কিন্তু আইনের কাছে সুরক্ষা দাবি করব। সমাজের প্রতিটি নিয়ম ভাঙব। আর চাইব, সমাজ আমায় সুরক্ষা দেবে। রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করার ষড় করব। আর রাষ্ট্রের কাছেই মানবিকতা প্রত্যাশা করব।
রোদ্দূর তো জানতেন, ওই ভিডিয়ো প্রচারের ফলে তাঁর উপর রাষ্ট্রের আক্রমণ নেমে আসতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলি যে যার নিজের মতো করে ফয়দা তুলছে। পয়েন্ট বাড়াচ্ছে। সর্বভারতীয়েরা এককাট্টা হয়ে আঞ্চলিকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করছে। এই পশ্চাৎপটে প্রার্থনা করি, রোদ্দূরের প্রকাশিতব্য উপন্যাসের লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হোক। তাঁর মনস্তত্ত্বের বই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যপাঠ্য হোক। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের পেশাদার হিসাবে তাঁর উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হোক। রোদ্দূর বেশি দিন কারান্তরালে থাকবেন না নিশ্চয়ই। আর বেরোলেই তো তিনি হিরো! গালিগালাজ-খেউড়ই হবে প্রতিবাদের ভাষা। আসলে বিপ্লব শনৈঃ শনৈঃ এগোচ্ছে।
(লেখক চলচ্চিত্রকার ও প্রাবন্ধিক। মতামত নিজস্ব)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।