Roddur Roy

Rupankar Bagchi & Roddur Roy: হুতোমি নকশার মতো এ কালের বাবু-বিবিরা মেতেছেন কেচ্ছায়, হাতের কাছেই রয়েছে ‘ভিলেন’!

রূপঙ্কর বা রোদ্দূরকে এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার কী? দরকার এই কারণেই যে, আমাদের হতাশা উগরানোর পাত্র এবং আমোদের আধার হিসাবে এমনই ‘ভিলেন’ প্রয়োজন।

Advertisement

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০২২ ১১:১৪
Share:

গ্রাফিকশৌভিক দেবনাথ

ঠিক হয়েছে! বেশ হয়েছে! এটা আরও আগে করা উচিত ছিল। রবীন্দ্রভারতীতে যখন ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’ হল, তখনই তো!

Advertisement

রেস্তোরাঁ ওর গান বাজানো বন্ধ করেছে। বেশ করেছে! ঠিক করেছে! কোত্থাও ওর গান বাজানো উচিত নয়! আরে, কোথায় কেকে, আর কোথায়…!

বঙ্গজনের সমীপে একটি নয়, আপাতত দু-দু’টি ভিলেন উপস্থিত! রূপঙ্কর বাগচি এবং রোদ্দূর (তিনি নিজে এই বানানই লেখেন) রায়। ফলে কেচ্ছার ঢি-ঢি। নেটপাড়া থেকে ফ্ল্যাটের আড্ডা, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, ট্রেন, মেট্রো, বাস— রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যেখানে যাবেন, সেখানেই দেখবেন তাঁদের মুণ্ডপাত হচ্ছে। কারণে না অকারণে, স্বতন্ত্র প্রশ্ন। কিন্তু হচ্ছে যে, সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। এ এক বীভৎস মজা!

Advertisement

আমোদপ্রিয় বাঙালি, তর্কপ্রিয় বাঙালি, কেচ্ছাপ্রিয় বাঙালি আমোদের এক নতুন উপকরণ পেয়েছে। এই যে গণখিল্লি, তার একটি ইতিহাস রয়েছে। যার কিঞ্চিৎ হদিস মেলে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ এবং হুতোম প্যাঁচার নকশায়।

হুতোম নিজে এ কথা না বললেও নকশার তিনটি বিভাগের মধ্যে অন্যতম হল ‘কেচ্ছা’। অরুণ নাগ লিখছেন, ‘কেচ্ছা হল কিস্‌সা কাহিনি ও কুৎসা কিংবা কুচ্ছোর মিলিত রূপ।’ তৎকালীন সমাজে মুদ্রিতাকারে যে সব কেচ্ছা প্রচারিত হত, তার সঙ্গে হুতোমি কেচ্ছার ফারাক বিস্তর। কলকাতার কুৎসা রটনার সূত্র ছিল তার গ্রামীণ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারে। বঙ্গীয় গ্রামীণ সমাজে কুৎসা ব্যক্তিবিশেষের রুচিবিকৃতি ছিল না। যৌথ প্রচেষ্টায় প্রচারিত এবং সময় সময় সৃষ্টও হত। হুতোমি কলকাতা ছিল আকারে ছোট, জনসংখ্যা ছিল কম এবং ‘নিষ্কর্মা’দের আধিক্য থাকায় সত্যমিথ্যা যা-ই হোক, কলঙ্কের খবর সকলেই অনায়াসে পেত। সে সময় নিন্দা করা বাবুদের নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছিল। এক পক্ষের নিন্দা অপর পক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো দূতেরও অভাব ছিল না। অরুণ নাগের বক্তব্য, ‘শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের নিন্দাযুদ্ধ পর্যবসিত হত অশ্লীল কুৎসা প্রচারে।’ হুতোম নিজেই ‘রামলীলা’ নকশায় বলেছেন, ‘আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা পরস্পর লড়াই করেচেন, আজকাল আমরা সর্ব্বদাই পরস্পরের অসাক্ষাতে নিন্দাবাদ করে থাকি, শেষে এক পক্ষের খেউড়ে জিত ধরাই আছে।’ অর্থাৎ, এক জনকে ভিলেন ঠাউরে কুৎসা করা এবং শেষে তার প্রতি যথেচ্ছ ‘খেউড়’-এই অপর পক্ষের জয়।

বস্তুত, সে কালে এ হেন রুচিবিকার এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, বাবুদের দেখাদেখি তাঁদের বংশধররাও এ খেলায় মেতেছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিতে পাই: ‘পূর্ব্বে বালকেরা পরস্পরের কুৎসা করিত। এক ধনীর পুত্র এক বালকের মানি ছাপাইয়া রাত্রিযোগে কালেজে যাইয়া থামেতে মারিয়া দেয়। হেয়ার সাহেব এই সংবাদ পাইয়া এক লাঠান হাতে করিয়া উপস্থিত হইয়া কাগজ খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন…।’

উল্লেখ্য, সে যুগের প্রায় সব কুৎসাই ছিল যৌন ব্যভিচার সংক্রান্ত। ভাষা নিতান্ত অশ্লীল। রচনায় সাহিত্যগুণের লেশমাত্র পাওয়া যেত না এবং তা প্রকাশে কেউ লজ্জিত হত না।

সাংবাদিক বৈঠকে কোনও প্রশ্ন নিলেন না রূপঙ্কর বাগচি। ফাইল চিত্র

খেয়াল করলে দেখা যায়, যেখানেই কেচ্ছা, সেখানেই এক জন ভিলেন হাজির। বস্তুত, কেচ্ছার কেন্দ্রে সেই ভিলেন। হুতোম লিখছেন, ‘…কিছু দিনের মধ্যে পদ্মলোচন কলিকাতা সহরের একজন প্রধান হিন্দু হয়ে পড়েন— তিনি হাই তুল্লে হাজার তুড়ি পড়ে— তিনি হাচ্‌লে জীব! জীব! জীব! শব্দে ঘর কেঁপে ওঠে...। ক্রমে পদ্মলোচন নানা উপায়ে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় কত্তে লাগলেন, অবস্থার উপযুক্ত একটি নতুন বাড়ি কিনলেন, সহরের বড় মানুষ হলে যে সকল জিনিসপত্র ও উপাদানের আবশ্যক, সভাস্থ আত্মীয় ও মোসাহেবরা ক্রমশ সেই সকল জিনিস সংগ্রহ করে ভাণ্ডার ও উদর পুরে ফেল্লেন, বাবু স্বয়ং পছন্দ করে (আপন চক্ষে সুবর্ণ বর্ষে) একটি রাঁড়ও রাখলেন...।’

পদ্মলোচন এখানে সেই ‘ভিলেন’। যে ‘ভিলেন’ সে যুগে যেনতেনপ্রকারেণ প্রচার চেয়েছিলেন। যে কারণেই তাঁর ওই বড় বাড়ি কেনা এবং যৌনকর্মী রাখা।

তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, রূপঙ্কর এবং রোদ্দূরও একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে। যে (অব) স্থানটির নাম ‘প্রচারের অলিন্দ’। লক্ষ করে দেখুন, কেকে-কে নিয়ে ভিডিয়োটির আগে রূপঙ্করের কোনও ভিডিয়োর এত ‘ভিউ’ হয়নি। কেকের প্রয়াণ এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জানান দিচ্ছে, রূপঙ্কর জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও এত প্রচার পাননি। অন্তত তাঁকে জনপরিসরে একটি সাংবাদিক বৈঠক করে কোনও প্রশ্ন না-নিয়ে লিখিত বিবৃতি পাঠ করতে হয়নি।

প্রচার বস্তুত, অতি বিষম বস্তু। একটি কেক প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের বিজ্ঞাপনী জিঙ্গল থেকে রূপঙ্করের গান বাদ দেওয়া নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, একটি রেস্তরাঁ সম্প্রতি লিখিত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, তারা আর রূপঙ্করের গান বাজাবে না। কেক প্রস্তুতকারী সংস্থাটি তাদের বিজ্ঞাপনী জিঙ্গল থেকে রূপঙ্করের গান বাদ দেওয়ার চিন্তার কথা সর্বসমক্ষে জানিয়ে কি আসলে প্রচারের আগুনে রুটি সেঁকতে চায়নি? তারা দাবি করবে, না! কিন্তু অন্তর্লীন এক গুঞ্জন কানে-কানে বলে যাবে, এ সবেরই আসল লক্ষ্য কিন্তু প্রচার। যত বার জনপরিসরে এই ঘটনা আসবে, খিল্লিপ্রিয় বাঙালি তত বারই বলবে, ‘‘ঠিক হয়েছে! একেবারে ঠিক করেছে!’’

সেই গুঞ্জনই বলছে, রূপঙ্কর খানিক প্রচার পেতেই হতাশা (এবং নাকি অভিমান) থেকে গায়ক কেকে-কে নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন (এ-ও ঠিক যে, রূপঙ্কর মাঝেমধ্যেই তাঁর ভিডিয়ো ফেসবুকে পোস্ট করে থাকেন)। ঘটনাচক্রে, রূপঙ্করের কেকে-ভিডিয়ো জনসমক্ষে আসার কয়েক ঘণ্টা পরেই প্রয়াত হন কেকে। নাটকীয় ভাবে। কিন্তু সে তো একেবারেই ঘটনাচক্র। নিছক কাকতালীয় কোনও ঘটনাকে এত গুরুত্ব দিতে হবে কেন?

একই কথা কি খাটে না রোদ্দূরের ক্ষেত্রেও? তাঁর নিজস্ব একটা ‘মোক্সাবাদ’ আছে বটে। কিন্তু তিনি কি মূলত প্রচারের জন্যই এ সব করেন না? যাতে বাঙালি কিঞ্চিৎ খিল্লির রসদ পায়? তাঁর সাম্প্রতিক ভিডিয়োর ‘ভিউ’ও তো সে কথাই বলছে। এক সাক্ষাৎকারে রোদ্দূর বলেছিলেন, তিনি অভিনেতা। তিনি একটি লোকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যে লোকটি চূড়ান্ত বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত।

আদালত চত্বরে রোদ্দূর রায়। ফাইল চিত্র

কিন্তু বিভ্রান্ত তো ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র ঋত্বিকও ছিলেন। শেষ দৃশ্যে গ্লাসের মদ ঢেলে দিয়েছিলেন ক্যামেরার লেন্সে। কিন্তু তাঁকে তো এমন করে রবীন্দ্রনাথকে বিকৃত করতে হয়নি। তা হলে রোদ্দূরকে কেন এ পথে যেতে হল? তাঁর যুক্তি, রবীন্দ্রনাথ–রবীন্দ্রনাথ করলে, তাঁর দর্শন, তাঁর ব্রহ্মসঙ্গীত, তাঁর গানে আমি–তুমির স্থান ঠিক কোথায়, তা বুঝতে পারা যায় না। তাঁর গানের ব্রহ্মভাব উনি সংগ্রহ করেছিলেন চারপাশের দৃশ্যগ্রাহ্য জগৎ থেকে। সেখান থেকে বিষয়টাকে মননগ্রাহ্য জগতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য— এই মানবতা, প্রেম আমরা ছুঁতে পারিনি। রোদ্দূরের মতে, আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ শুধুই ‘ব্যবসায়িক বস্তু’। কিছু মুষ্টিমেয় লোকের সম্পদ।

একই যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছেও কি ‘ব্যবসায়িক বস্তু’ নন? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বা সলিল চৌধুরীর লেখা কোনও গান এ ভাবে বিকৃত করে গাইলে রোদ্দূর এই বিপুল ‘ভিউ’ পেতেন? এত বিতর্ক হত? হত না। এত প্রচারও জুটত না। বাক্-স্বাধীনতা এক, আর ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’-র আগে অশালীন শব্দ বসিয়ে রোদ্দূর যাকে আঘাত করতে চেয়েছেন, তা স্বতন্ত্র বিষয়।

আসলে এখানে রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্যবস্তু নন। নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এমন ‘মার্কেট ভ্যালু’ থাকলে রোদ্দূর বা তাঁর মতো কেউ সেই সব গান নিয়ে এমনটাই করতেন।

স্মর্তব্য, ষাটের দশকে আমেরিকা জুড়ে ‘সিভিল রাইটস আন্দোলন’-এর অন্যতম পুরোধা ছিলেন পিট সিগার। আমেরিকার সরকারের জনবিদ্বেষী নীতি এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং প্রতিবাদী মানুষের পক্ষে ছিলেন এই নাগরিক কবিয়াল। ভুললে চলবে না, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে আমেরিকার জনগণকে প্রতিবাদের ভাষাও দেন তিনিই। যুদ্ধের বিপক্ষে মানুষকে সচেতন করতে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেন। কই, তিনি তো রোদ্দূরের মতো বেসুরে তাঁর যন্ত্র বাজাননি! বা এমন গালাগালও জুড়ে দেননি কোনও কবির প্রচলিত গানে!

আসলে কিংবদন্তি কোনও শিল্পীকে নিয়ে ‘খেউড়’ করতে পারলে সহজে জনপ্রিয় হওয়া যায়। তা হয়ে ওঠে প্রতিস্পর্ধার প্রতীক। জনতার একাংশ ভাবে, আহা, সত্যিই ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে’র আগে এমন পুরুষলিঙ্গবোধক শব্দ তো কেউ ব্যবহার করার সাহস দেখায়নি! এমনকি, ‘শনিবারের চিঠি’র হোতা সজনীকান্ত দাসও নন‍। আবার সেখানেই রোদ্দূর এক শ্রেণির লোকের কাছে ‘ভিলেন’ হয়ে ওঠেন।

রূপঙ্কর বা রোদ্দূরকে এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ছিল কি? ছিল। কারণ, আমাদের হতাশা উগরানোর পাত্র এবং আমোদের আধার হিসাবে এমন ‘ভিলেন’ প্রয়োজন। যে ভিলেন থাকলে ‘খিল্লি’ করা যায়। নেটপাড়া থেকে পাড়া— কিছু ক্ষণ দুর্দান্ত সময় কাটে। রোদ্দূর জেল হাজতে গেলেন না পুলিশি হেফাজতে, তা নিয়ে আগ্রহ থাকে। চ্যানেলের টিআরপি বাড়ে। বাড়ে ওয়েবসাইটের পেজ ভিউ এবং কাগজের পাঠক।

অতএব, আমাদের মাঝে-মধ্যে দু’এক খানি ভিলেন চাই। নইলে এ কালের বাবু-বিবিরা আমোদে মাতবেন কী করে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement