অরক্ষিতের দায়

বিরোধিতারও যে মতাদর্শ থাকে, সৌজন্য থাকে, এই হিংস্র ও সশস্ত্র সমর্থকদের বুঝাইবে কে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৪
Share:

শিক্ষিকাকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত পড়ুয়া। —ফাইল ছবি

দিবালোকের ন্যায় প্রকাশ্য হইয়া উঠিয়াছে দমন-পীড়নের স্বরূপ। চরাচরে ঘনাইয়া উঠা অসহিষ্ণুতার বাতাবরণের জোরে হিংসাও পার পাইয়া যাইতেছে, সাক্ষী কলিকাতা। যাদবপুরে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিক পঞ্জির সমর্থক সভামঞ্চ হইতে যুগপৎ মুসলমান-বিদ্বেষ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে উস্কানির প্রতিবাদ করায় উন্মত্ত সমর্থকদের হাতে প্রহৃত হইলেন এক শিক্ষিকা। সমাজমাধ্যমে তাঁহার আতঙ্কিত অভিজ্ঞতার বর্ণনার প্রেক্ষিতেও ধাইয়া আসিয়াছে অযুত বিদ্রুপ ও গালাগালি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই অপর এক শিক্ষককে সমাজমাধ্যমে ‘চিনিয়া রাখিবার’ হুমকি দেওয়া হইয়াছে, তাঁহার অপরাধ— তাঁহার ছাত্ররা সিএএ ও এনআরসি-র বিরোধী। বিরোধিতারও যে মতাদর্শ থাকে, সৌজন্য থাকে, এই হিংস্র ও সশস্ত্র সমর্থকদের বুঝাইবে কে? এনআরসি-সিএএ বিরোধী মিছিল হইতে যে মানুষটি দিনান্তে একাকী ঘরে ফিরিতেছেন, সকালে বাজার যাইতেছেন বা পথে যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছেন, তিনি অতর্কিতে আক্রান্ত হইলে কী হইবে? জীবনসংশয়ের ঝুঁকি যেখানে, একাকী নাগরিকের সেখানে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকাই কর্তব্য, বোধ হইতেছে।

Advertisement

কিন্তু নাগরিকের শারীরিক সুরক্ষার দায় কি প্রশাসনের নহে? যে সমাজে নিরাপদে বাঁচিয়া থাকিবার ভার নাগরিকের উপরেই বর্তায়, তাহা অপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক কি আর কিছুই হইতে পারে? মনে রাখিতে হইবে, আক্রমণের ঘটনাগুলি দিল্লি বা উত্তরপ্রদেশের নহে, কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের। এমন এক রাজ্যের, যাহার সরকার ঘোষিত ভাবে এনআরসি ও সিএএ বিরোধী। এমন এক শহরের, যাহার রাজপথে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এনআরসি-সিএএ লইয়া বিজেপির আগ্রাসনের মোকাবিলায় নাগরিক সমর্থন আদায়ে দীর্ঘ পদযাত্রা করিয়াছেন। সেই শহরেই যখন এনআরসি বা সিএএ বিরোধিতা করিয়া কোনও নাগরিক আক্রান্ত হন, তাহা প্রশাসনের দায়িত্ববোধে বড়সড় ফাঁক দেখাইয়া দেয়। শিক্ষিকার আক্রান্ত হইবার ঘটনাটি শহরতলিতে বা তথাকথিত নির্জন স্থানে ঘটে নাই, ঘটিয়াছে যাদবপুরে বাসস্ট্যান্ডের নিকটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনতিদূরে। প্রশ্ন: এনআরসি-সিএএ লইয়া উত্তপ্ত শহরে অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মোকাবিলায় পুলিশ কত দূর প্রস্তুত ও তৎপর। আদ্যন্ত প্ররোচনাময় সভাস্থল যে সাধারণ নাগরিকের পক্ষে সম্ভাব্য নিগ্রহের অকুস্থলও, পুলিশ তাহা আর কবে বুঝিবে?

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একাকী নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতাই কি তাহা হইলে ভবিতব্য? উগ্র সমষ্টিকে রুখিতে কি তাঁহাকেও দল পাকাইতে হইবে? না কি তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছেন দলীয় পতাকার মাহাত্ম্য, যাহার আশ্রয়ে থাকিলে হয়তো তাঁহার নিরাপত্তা নিশ্চিত হইত? যিনি সিএএ-র বিরোধিতা করিতেছেন, তাঁহার কোনও দলীয় পরিচয় না-ই থাকিতে পারে। হইতেই পারে, তিনি বিশেষ ভাবে সক্ষম এক জন নাগরিক, বা প্রান্তিক যৌনতাবলম্বী, অথবা নারীবাদী, কিংবা নাস্তিক। ইহাও হইতে পারে, তিনি সিএএ-বিরোধিতায় এই রাজ্যের শাসক দলের সহমর্মী, কিন্তু ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাসে অন্য পথের পথিক। ইঁহাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের। অন্যথায় ধরিয়া লইতে হয়, নাগরিক আসলে সুবিধাবাদী রাজনীতির অসহায় শিকার বই অন্য কিছু নহেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement