নির্বাচন অতি বিচিত্র এক রসায়ন। কখন কোনটার সঙ্গে কোনটা মিলে কী চেহারা নেবে, সব সময় সেটা আগাম বোঝা না-ও যেতে পারে।
চোর এবং চরিত্রহীন অপবাদগুলির সামাজিক অভিঘাত খুব বেশি। কারও বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে সমাজ, পারিপার্শ্বিক কেউ তাকে সহজ নজরে দেখে না। অভিযোগ প্রমাণ হলে তো কথাই নেই। এমনকী, আইন-আদালতে প্রমাণ করা না গেলেও জনমন থেকে সন্দেহের ছায়া চট করে সরে না।
রাজনীতির লোকেদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও মারাত্মক। তাঁদের গায়ে এমন কালি লাগলে শুধু ব্যক্তিতেই তা থেমে থাকে না। বহু সময় দলকেও তার জন্য ভুগতে হয়। বিশেষ করে ভোটের সময় প্রার্থী বা তাঁর দলের বড়, ছোট নেতাদের বিরুদ্ধে এই রকম অভিযোগ সামনে এলে প্রচারে তা অন্য অনেক বিষয়কে পিছনে ফেলে দিতে পারে। সত্যাসত্য নির্ধারণ পরের কথা।
তবে সব সময় সেগুলি যে ভোটের ফলে ঠিক এই ভাবেই প্রতিফলিত হয়, তা নয়। যদি কখনও তার চরমতম প্রকাশ ঘটে, তখন ‘রাজীব গাঁধী চোর হ্যায়’-এর মতো স্লোগানে দেশের রাজনীতির অবয়ব হঠাৎ পাল্টে যায়। আবার বড় বড় নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠা, সিবিআই জেরা ইত্যাদির পরেও সংশ্লিষ্ট দলের ভোট-কপালে জয়ের তিলক একই রকম উজ্জ্বল থাকে, সবই প্রমাণিত সত্য।
আরও পড়ুন: আগ্রাসনকারীর আক্রমণ রুখতে যে যার জায়গা থেকে প্রতিরোধ
আসলে নির্বাচন অতি বিচিত্র এক রসায়ন। কখন কোনটার সঙ্গে কোনটা মিলে কী চেহারা নেবে, সব সময় সেটা আগাম বোঝা না-ও যেতে পারে। কিন্তু ভোটের বাজারে ছোট থেকে বড় নেতা-মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধিদের সততা, ব্যক্তিগত চরিত্র ইত্যাদি প্রসঙ্গ সামনে এলে মানুষ সে সব নিয়ে আলোচনা করতে অবশ্যই বেশ উৎসাহ পায়। আর জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভিযোগগুলি যেখানে মিলে যায়, সেখানে ধাক্কা আসাও স্বাভাবিক। নিজস্ব ‘শক্তি’তে কেউ তা সামলাতে পারে, কেউ ততটা পারে না। এই রাজ্যেও এমন উদাহরণ কম নেই।
আরও পড়ুন: স্বপ্ন দেখব বলে কাজও করব
সবাই জানেন, সিপিএম-এর কয়েক দশকের একাধিপত্যের পিছনে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে রাখা ছিল বড় সহায়ক। তখন বামেদের বিরুদ্ধেও পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, সন্ত্রাস করে ভোটে জেতার খবর হত। হাতে মারা, ভাতে মারা কিছুই বাদ ছিল না। ভুয়ো মাস্টার রোল তৈরি করে টাকা চুরি থেকে শুরু করে ঠিকাদারের থেকে কাটমানি নেওয়া, নিম্নমানের কাজ করিয়ে বেশি টাকার বিল পাশ করানো— কী হয়নি তখন! খয়রাতির চাল-ডাল পঞ্চায়েত প্রতিনিধির বাড়ির ভাঁড়ারে ঢুকিয়ে নেওয়ার বা বাজারে বেচে দেওয়ার মতো অভিযোগও উঠত আকছার। তোলাবাজ, অসৎ পঞ্চায়েত নেতাদের জন্য গ্রাম বাংলায় সেই সময় ‘পঞ্চুবাবু’ বলে একটা বিশেষ ডাকও চালু হয়ে গিয়েছিল।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে পঞ্চায়েতের রং বদলেছে। তবে চরিত্র বদলায়নি। ফলে আগের মতোই অভিযোগ আজও প্রচুর। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে হারিয়ে বিজেপি-র আঠারোটি আসন পাওয়ার পিছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে দল বুঝতে পারে, অন্যান্য বিষয় ছাড়াও নিচুতলায় অর্থাৎ পঞ্চায়েত ও পুর-এলাকায় শাসক তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের একাংশের অসাধুতা এর পিছনে অনেকটা দায়ী। জনমতের বিশ্লেষণে বসে উঁচুতলার নেতারা যেখানে পৌঁছলেন, তাতে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের দলের ‘কাটমানি’ খাওয়া জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেই আঙুল তুলতে হল। রাজ্য জুড়ে কাটমানি-রাজনীতি এবং অবৈধ ভাবে আদায় করা টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে শোরগোলের সেই সব দিন সবার মনে এখনও টাটকা।
এই বারও ঘটনাচক্রে বিধানসভা ভোটের আগে করোনার ত্রাণ ও আমপানের ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিয়ে গ্রামবাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ফের ছড়িয়ে পড়েছে। তবে উনিশের ‘শিক্ষা’ বিশে কাজে লাগিয়ে শাসক-নেতৃত্ব এখন গোড়াতেই রাশ টানতে তৎপর হয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কোপে পড়তে হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিডিও বা সরকারি লোকেদেরও। উদ্দেশ্য, ভোটের আগে অন্তত দল ও সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্নের পরিসর কমানো। জনমনে এর একটা ইতিবাচক ছাপ পড়া অসম্ভব নয়।
তবে এ হল মুদ্রার একটি দিক। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তাদের অবস্থান থেকে বিষয়টি দেখা। কারণ এই সব দুর্নীতি সবটাই সরকারি টাকা বা সামগ্রী নিয়ে। আগে ক্ষমতাসীন সিপিএম করেছে, এখন ক্ষমতার পার্টি তৃণমূল করছে। বিরোধীদের কাছেও সর্বদা এগুলি আক্রমণের লক্ষ্য হয়। তখনও ছিল। আজও তাই।
কিন্তু বাংলার রাজনৈতিক বাজারে চুরি-চামারি, চরিত্রহীনতা ইত্যাদির আর এক রকম প্রকাশ ক্রমশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে। আর সেটা প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-কে ঘিরে। রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য যে দল ওত পেতে রয়েছে, শাসক ও অন্য বিরোধীদের থেকে যারা নিজেদের ‘আলাদা’ হিসাবে চিহ্নিত করতে চায় এবং ‘আদর্শ’ বিকল্পের স্বপ্ন দেখায়, ক্ষমতায় আসার আগেই যদি সেই দলের ভিতরকার দগদগে চেহারাটি বেরিয়ে পড়ে, তা হলে সেই আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। কারণ যা রটে, তার কিছু তো বটে।
প্রথমে রাজ্য বিজেপি-র এক জাঁদরেল নেতা ও পদাধিকারীর কথা বলা যাক। তাঁর সম্পর্কে কিছু দিন ধরে অভিযোগের বন্যা বইছে। সবই চরিত্র-দোষ এবং বিবিধ অসততার। অভিযোগকারীদের কয়েকজন ওই নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কেউ বা তাঁর দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে নিজেদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে নালিশ জমা পড়েছে থানা-পুলিশ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত।
কারও ব্যক্তিগত জীবনযাপনকে প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় করে তোলা হয়তো উচিত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে অভিযোগের তিরে একটি বড় দলের বিশিষ্ট নেতা। আর এই ধরনের ব্যক্তিদের একটি সামাজিক প্রভাব থাকে বলেই তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনধারা লাগামছাড়া হতে পারে না।
তবু চারিত্রিক কুকর্মের অভিযোগগুলি আপাতত আলোচনায় না এনে বরং এটুকুই জানানো যাক, নেতা-ভদ্রলোকটির বিরুদ্ধে তাঁর পরিবারের লোকেদের সই জাল করে সম্পত্তি আত্মসাৎ করা থেকে শুরু করে অন্যের সম্পত্তি জোর করে ভোগদখল করার মতো বেশ কয়েকটি নালিশ রয়েছে। তাঁর দল এ সব জানে না, তা-ও নয়। কিন্তু কারও মুখে টুঁ শব্দটিও নেই! নেতাও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অভিযোগ যে শুধু ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধেই উঠছে, তা নয়। অভিযোগের মাছি ভনভন করছে রাজ্য বিজেপি-র অন্দরেও। সেখানে কান পাতলে শোনা যায় জেলায় জেলায় দলীয় কার্যালয় তৈরিতে আর্থিক অনিয়মের কথা। শোনা যায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বার্তা সম্বলিত কোনও লিফলেট ছাপাতেও নাকি কাটমানির খেলা জমে উঠেছিল। খরচ হয়তো ত্রিশ পয়সা, বিল তৈরি হয়েছে সত্তর পয়সার! কেন্দ্র থেকে ‘কাজ করিয়ে’ দেওয়ার জন্য নজরানার ধারাবাহিক অভিযোগ
তো আছেই।
তবে আগেই বলেছি, শাসক বা বিরোধী যে-ই হোক, অভিযোগের সত্যাসত্য সবার ক্ষেত্রেই প্রমাণসাপেক্ষ। তা ছাড়া কোনও দলের নিজস্ব তহবিল আর সরকারের অর্থাৎ জনগণের টাকা অবশ্যই এক মাপকাঠিতে বিচার্য নয়। অতএব বিজেপি-র ক্ষেত্রে কেউ বলতেই পারেন, দলের টাকা দলের লোকেরা নয়ছয় করলে সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
কিন্তু আসল শঙ্কা অন্য জায়গায়। সন্দেহ হয়, ক্ষমতা না পেয়েই যে দলের গায়ে এত রকম সন্দেহের কালি, এত রকম পাপাচার ও আর্থিক নয়ছয়ের অভিযোগ, ক্ষমতায় বসলে তারা আরও কত কী না করতে পারেন! রাতারাতি তাঁদের সবাই স্বভাব পাল্টে ‘ধর্মপুত্তুর’ হয়ে যেতে পারেন বলে তো মনে হয় না। তা হলে মানুষ কি বুঝবে? সুচের বিকল্প চালুনি?