বাড়ি বা স্কুলের মতো ‘নিরাপদ’ পরিসরেও বাচ্চারা আর নির্বিঘ্নে থাকতে পারছে কোথায়? খবরের কাগজ খুললেই এখন যে-সব ঘটনা চোখে প়ড়ে, তাতে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট, ২০১২ নামক আইনটি (চলতি কথায় যা পক্সো আইন নামে পরিচিত) বহু আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন, যৌন হেনস্তা, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য আইনটি তৈরি হয়েছে। এই গোত্রের অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত এবং শিশুবান্ধব আইনি প্রক্রিয়ারও ব্যবস্থা হয়েছে। এই আইনের ২৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে: ‘কোনও ব্যক্তি যদি এই আইনের দফা ৩ (পেনিট্রেটিভ সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট), ৫ (অ্যাগ্রভেটেড পেনিট্রেটিভ সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট), ৭ (সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট) ও ৯ (অ্যাগ্রভেটেড সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট)-এর অধীনে বর্ণিত অপরাধগুলি করার, অথবা সাহায্য করার অথবা অপরাধের চেষ্টা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তবে যতক্ষণ অবধি সেই ব্যক্তি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত না করতে পারেন, ততক্ষণ বিশেষ আদালত ধরে নেবে যে সেই ব্যক্তি সত্যিই এই অপরাধ করেছেন, অথবা তাতে সাহায্য করেছেন, অথবা অপরাধের চেষ্টা করেছেন।’
অর্থাৎ, যাঁর বিরুদ্ধে কোনও শিশুকে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ উঠবে, ভারতের ফৌজদারি আইনের মৌলিক রক্ষাকবচটি— অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া অবধি অভিযুক্তকে নিরপরাধ বিবেচনা করা— তাঁর থাকছে না। অন্য ক্ষেত্রে সংশয়াতীত ভাবে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব বাদী পক্ষের, কিন্তু এই আইনে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের। কাজেই, এই আইনটি ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠিত দর্শনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, সেই প্রশ্নটি ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
ভারতীয় বিচারব্যবস্থা দার্শনিক ভাবে অ্যাংলো-স্যাক্সন আইনি ধারার অনুসারী, যা ‘কমন ল’ হিসাবে পরিচিত। বিচারব্যববস্থার এই দর্শন বলবে, প্রতিটি অপরাধের দুটি ভাগ আছে— অপরাধমূলক কাজ, এবং অপরাধের অভিসন্ধি। অভিযুক্তকে অপরাধী প্রমাণ করতে হলে, এবং তাঁর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হলে বাদী পক্ষকে যেমন অপরাধমূলক কাজটিকে যুক্তিসংগত সংশয়ের ঊর্ধ্বে প্রমাণ করতে হবে, তেমনই তার পিছনে থাকা অভিসন্ধিও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সহানুভূতির পাল্লা অভিযুক্তের দিকেই ঝুঁকে থাকে, অস্বীকার করার উপায় নেই— তিনি যে নির্দোষ, সেই পূর্বানুমান থেকে তাঁর নীরবতার অধিকারের স্বীকৃতি, অনেক কিছুই অভিযুক্তের পক্ষে থাকে। এর দার্শনিক ভিত্তি ১৭৬০-এর দশকের ব্ল্যাকস্টোন ফর্মুলেশন— ‘এক জন নিরপরাধকে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে দশ জন অপরাধীর ছাড়া পেয়ে যাওয়া বেশি গ্রহণযোগ্য।’
এই ব্যবস্থার যে একটি দার্শনিক মূল্য আছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু, সেই দর্শনকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে এনে দেখলে বোঝা যায়, ভারতে কেন যত অভিযুক্তের শাস্তি হয়, তার চেয়ে ঢের বেশি অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়ে যান। এবং, খালাস পাওয়ার সবচেয়ে পরিচিত কারণ হল, পুলিশ যুক্তিসংগত সংশয়ের ঊর্ধ্বে অপরাধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রমাণ জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। কিছু বিশেষ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা যাতে এ-রকম ভাবে প্রমাণের অভাবে ছাড়া না পেয়ে যান, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা আইনপ্রণেতারা বহু বারই অনুভব করেছেন। সেই ভাবনা থেকেই কিছু বিশেষ অপরাধকে আলাদা করে দেখার ধারা তৈরি হয়েছে, বিশেষ প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে— ভারতীয় বিচারব্যবস্থার প্রচলিত রীতি থেকে এই বিশেষ ব্যবস্থার দূরত্ব অনেকখানি। তেমনই কয়েকটা উদাহরণ দিই।
নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্স অ্যাক্ট, ১৯৮৫-র ৩৫তম ধারায় ধরে নেওয়া হয়, এই আইনে অভিযুক্তদের অপরাধের অভিসন্ধি ছিলই। অর্থাৎ, অভিযুক্ত যদি তর্কাতীত ভাবে প্রমাণ না করতে পারেন যে এই অপরাধের কোনও অভিসন্ধি তাঁর ছিল না, তবে পুলিশের কাজ শুধু তাঁর অপরাধমূলক কাজটিকে প্রমাণ করা। এই ধরনের অপরাধকে বলা হয় ‘স্ট্রিক্ট লায়াবিলিটি অফেন্স’— যে বিশেষ আইনগুলির কথা বলছি, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধকে স্ট্রিক্ট লায়াবিলিটি অফেন্স হিসাবে দেখা হয়, যেখানে অপরাধের অভিসন্ধি প্রমাণ করার দায় বাদী পক্ষের থাকে না। ১৮৮১ সালের নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট-এ যেমন চেক বাউন্স করা এই ধরনের অপরাধ। কাজটি কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছেন কি না, প্রশ্নটিই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়।
বিয়ের সাত বছরের মধ্যে যদি কোনও বধূর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, এবং সেই মৃত্যুর সঙ্গে যদি স্বামী বা তাঁর পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের যৌতুকের দাবির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং হিংস্রতা ও নিগ্রহের ঘটনার প্রমাণ মেলে, তা হলে ধরে নেওয়া হবে, এই মৃত্যুটি ‘পণের জন্য মৃত্যু’, এবং স্বামী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি অপরাধী। ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৩০৪বি ধারা ও ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২-এর ১১৩বি ধারায় এই ব্যবস্থা রয়েছে। এই গোত্রের অভিযোগে খুনের অভিসন্ধি প্রমাণের কোনও দায়িত্ব বাদী পক্ষের নেই। অভিযুক্তেরও অপরাধ প্রমাণ হওয়ার আগে অবধি নিরপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার রক্ষাকবচটি নেই। বহু-বিতর্কিত ৪৯৮-এ ধারার ক্ষেত্রেও ছবিটা কতকটা এই রকম। অর্থাৎ, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সাধারণত যে-নীতি মেনে চলে, বেশ কিছু বিশেষ গোত্রের অপরাধের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রমও ঘটে।
পক্সো আইনকে এই প্রেক্ষিতে দেখাই বিধেয়। কেউ বলতেই পারেন, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সাধারণ নীতি এবং দর্শন থেকে বিচ্যুত হলে আইনটির অপব্যবহারের সম্ভাবনাও বাড়ে। যে শিশুটি যৌন নিগ্রহের শিকার বলে অভিযোগ, তার বক্তব্যের ওপর এই আইন গভীর আস্থা রাখে। আদর্শ পরিস্থিতিতে শিশুটির বিবৃতি বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করার কোনও কারণ থাকা উচিত নয়। কিন্তু, একটা কথা ভুললে চলবে না। এই আইনে আঠারো বছরের কমবয়সিরা ‘শিশু’ হিসাবে বিবেচিত হয়। যেখানে শুধুমাত্র অবাঞ্ছিত স্পর্শের অভিযোগেই কাউকে যৌন নিগ্রহের দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় (এবং, এই ধরনের অভিযোগ অপ্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন), সেখানে কোনও টিনএজারের বক্তব্যের মধ্যে কল্পনা বা অন্য কিছুর মিশেল থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া চলে কি? আবারও ৪৯৮-এ ধারার কথা আসবে— এই ধারাটির অপব্যবহার এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহারের যত অভিযোগ উঠেছে, এবং তার সূত্র ধরেই আইনটির উদ্দেশ্য এবং কার্যকারিতাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, পক্সো-র ক্ষেত্রেও কি সেই সম্ভাবনা থেকে যায় না? বিচারব্যবস্থার অভীষ্ট কী? প্রতিশোধ নেওয়া, না অপরাধীর সংশোধন? ভারতীয় বিচারব্যবস্থা দার্শনিক ভাবে দ্বিতীয় অভীষ্টতেই বিশ্বাসী। সেই কথাটি মাথায় রাখলে সন্দেহ হয়, কোনও আইন যদি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এতখানি কঠোর অবস্থান নেয়, তা হলে তার মূলে রয়েছে ‘চোখের বদলে চোখ’-এর মনোভাব।
এই উদ্বেগগুলি থাকছে। কিন্তু, বিচারব্যবস্থার চালু দর্শন থেকে কোনও আইনের বিচ্যুতিকে সেই দর্শনের লঘু হয়ে যাওয়া ভাবলে ভুল হবে। যাতে ন্যায্য, সমদর্শী এবং দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তার জন্যই এই আলোচ্য আইনগুলি তৈরি হয়েছে। তার অপব্যবহার যাতে না হয়, সে-দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কিন্তু, কেন এমন আইন তৈরি করতে হল, সে-কথাও ভুললে চলবে না।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস, কলকাতা-য় আইনবিদ্যার শিক্ষক