রোহিত ভেমুলার ছবি কোলে তাঁর মা। ফাইল চিত্র
১৭ জানুয়ারি ২০১৬। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র রোহিত ভেমুলা আত্মঘাতী হলেন। কারণ, তিনি দলিতদের ন্যায্য সম্মান এবং অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। আর সেই আন্দোলনের ‘ফল’ তাঁকে নানা ভাবে ভুগতে হচ্ছিল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষিকার ক্লাস বয়কট করা হয়েছিল কারণ, তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের। এখনও উচ্চবর্ণের মহিলা নিম্নবর্ণের কোনও পুরুষকে বিয়ে করলে ‘অনার কিলিং’ বা ‘সম্মানরক্ষায় খুন’-এর মতো ঘটনা ঘটে। এখনও কোনও কোনও গ্রামে ব্রাহ্মণ পাড়া দিয়ে দলিত ও শূদ্রকে (তথাকথিত) পার হতে হলে জুতো পায়ে রাখা যায় না। এক পুকুরে স্নান করা যায় না বা এক কুয়োর জল খাওয়া যায় না।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে তৎকালীন বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ/ সাহিত্য থেকেও এই রকম বর্ণভেদের কিছু ছবি আমরা উল্লেখ করতে পারি। যেমন, মহাভারতে একলব্যের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া বা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় কর্ণকে স্থান না দেওয়া। যেহেতু, কর্ণ এবং একলব্য ছিলেন শূদ্রজাত।
আবার বিপরীত ছবিও দেখা গিয়েছে। রামের অচ্ছ্যুৎ বর্ণের শর্বরীর ফল গ্রহণ। বেদব্যাস ও বাল্মিকী শূদ্রজাত হয়েও যথাক্রমে মহাভারত ও রামায়ণ রচনা কিংবা চাণক্যের শূদ্রজাত (তথাকথিত) চন্দ্রগুপ্তকে সাম্রাজ্যের অধিকার দেওয়ার জন্য লড়াই করা। তাহলে এই ভেদাভেদ বা বর্ণব্যবস্থা কেন করা হয়েছে?
চাণক্য এ বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তার মর্মার্থ হল— ‘বর্ণ কখনও জন্মসূত্রে লাভ করা যায় না। তা কর্মসূত্রে অর্জন করে নিতে হয়।’ যাজ্ঞবল্ক্য রাজা কোহিল (কুশীপুত্র)কে বলছেন ব্রাহ্মণ সেই-ই যে ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয় (ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে)। অর্থাৎ, যিনি ধনকামনা, যশকামনা, মৃত্যুভয় ও লোভ থেকে মুক্ত হতে পারেন তিনিই ব্রাহ্মণ। চাণক্যও একই কথা বললেন— গীতায় ১৮ অধ্যায় এবং মহাভারতের শান্তি পর্বে মানুষের বর্ণভেদের মূল কারণ জন্ম নয়, তার কর্ম, তার গুণ দ্বারা বিচার্য। এই গুণগুলিকে স্বতঃ, রজঃ ও তমঃ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাঁরা স্বতঃগুণ ধারী তাঁরা জ্ঞানী, দূরদর্শী, নির্লোভ, কামনা ও মৃত্যুভয়রহিত, অহিংস। রজঃগুণধারী যুদ্ধ ও অনুশাসন পারদর্শী সঙ্গে জ্ঞানীও। তমঃ ধারীরা হিংসাপরায়ণ, লোভী, পরশ্রমী, কুশাসক ইত্যাদি। এগুলি কম বেশি সকলের মধ্যেই আছে। যাঁরা বেশি স্বতঃধারী তাঁরা ব্রাহ্মণ, যাঁরা রজঃ ও স্বতঃ দুই গুণের অধিকারী তাঁরা ক্ষত্রিয় ও তমঃধারীরা শূদ্র শ্রেণির।
একজন ব্রাহ্মণ তমঃ গুণদ্বারা শূদ্রে আবার একজন স্বতঃগুণ দ্বারা ব্রাহ্মণ বর্ণে পরিণত হতে পারেন। ফলে মহাভারতের বেদব্যাস, বাল্মিকী (রামায়ণ) এমনকি, বিদুর ও কর্ণ শূদ্র হলেও ক্ষত্রিয়তে উন্নীত হয়েছিলেন। তাই চাণক্য বলেছিলেন— ‘ব্রাহ্মণ বংশজাত হয়েও আপনারা ব্রাহ্মণ নন আবার চন্দ্রগুপ্ত শূদ্রজাত হয়েও ক্ষত্রিয়গুণধারী।’ প্রকৃতপক্ষে জন্মের সময় সকল শিশুই শূদ্রবর্ণধারী পরবর্তীকালে তার কর্ম ও গুণের দ্বারা বর্ণ নির্ধারিত হয়। বর্ণ কখনও জন্মসূত্রে লব্ধ হয় না বলে তাঁর মত।
কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজের একটা অংশ এবং তৎসহকারী ক্ষত্রিয় শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে জন্মসূত্রের এই বর্ণভেদকে বাঁচিয়ে রাখে। আজও একই ভাবে ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রগুলির যথার্থ উপলব্ধি না করে মানবসমাজের এই বর্ণ বিভাজন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ রয়েছে। ফলে তৎকালীন সমাজে যশ, শিক্ষা, ধন, আত্মসম্মান থেকে শূদ্র শ্রেণিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আজও অনেকটা সে ব্যবস্থাই রয়ে গিয়েছে।
আমরা যে সকলেই একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত তার প্রমাণ দিচ্ছেন হিউম্যান জিনোম গবেষণারত বিজ্ঞানীরা। আফ্রিকা থেকে ৭৫ হাজার বছর আগে এশিয়া ও ইউরোপে মানবজাতি ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে একটা জাতি যারা আদিবাসী হিসাবে জঙ্গলে বসবাস করত মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকায় গুহাচিত্রে এর প্রমাণ রয়েছে। সেখান থেকে আদিবাসী ও দ্রাবিড় সভ্যতা পরবর্তীতে সিন্ধু সভ্যতা ও সর্বশেষে বৈদিক সভ্যতার সূচনা করে। বৈদিক যুগের সূচনায় ভারতবর্ষের দ্রাবিড় ও আদিবাসীদের আর্যরা দস্যু ও দাস হিসাবে আখ্যা দেওয়া শুরু করে।
বৈদিক যুগে প্রথমাবস্থায় বর্ণভেদ থাকলেও তা কর্মের ভিত্তিতেই মান্যতা পেত। ফলে যেমন অন্য বর্ণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত তেমনই শূদ্র তার গুণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হতে পারত এমন উদাহরণও রয়েছে। একই ব্রাহ্মণের তিন ছেলে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয় বা কেউ শূদ্র আখ্যা পেত। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণেরা জন্ম ভিত্তিক ভেদাভেদ চালু করল কেবলমাত্র অন্যের উপার্জন, ধন শোষণ করার অছিলায়।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে এই নিম্নবর্ণের লোকেরা যখন আবার জ্ঞান ও ধনের আলো দেখতে পেল তখনও ব্রাহ্মণেরা ছলে-বলে তার বিরোধিতা করল। এখানে কুমারিল ভট্টের কথা বলা যেতে পারে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পিছনে কিছুটা হলেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছায়া রয়েছে একথা বলা হয়ে থাকে। পুষ্যমিত্র সুঙ্গ এসে অবশেষে বৌদ্ধধর্মে শেষ পেরেক গেঁথেছিলেন।
যে ভারতবর্ষ চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য, শৈল্পিক বিকাশে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সভ্যতার মর্যাদা পেয়েছিল, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে ও বর্ণভেদের অত্যাচারে চা নষ্ট হল। শেষ ষড়যন্ত্র হল ব্রিটিশ শাসনে। এতদিন ভেদাভেদ থাকলেও তার মধ্যে কিছুটা ঐক্য ছিল। কিন্তু ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি ভারতকে টুকরো টুকরো করে দিল। প্রথমত, তাঁরা দার্শনিক ম্যাক্সমুলার দ্বারা এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করল যে, আর্যরা ইউরোপীয় জাতিরই অংশ। অনার্যরা ভারতের অংশ। দ্বিতীয়ত, মনুস্মৃতি যা অন্ধকারে ছিল, তাকে তুলে এনে ‘হিন্দু ল কোড’ চালু করল ও ভেদাভেদ চরম জায়গায় নিয়ে গেল। উচ্চবর্ণের জন্য চাকুরি, স্কুলশিক্ষা, ভূমির অধিকার দিলেও নিম্নবর্ণের কোনও অধিকার রইল না। এর জন্য মনুস্মৃতির ব্যাখ্যা দেওয়া হল। আমাদের দেশের উচ্চবর্ণের লোকেরা পদবির লোভে, শিক্ষা ও ধন অর্জনের লোভে ইংরেজদের দাসত্ব স্বীকার করে নিল।
মাঝে যখন আদিবাসী আন্দোলন শুরু হল তখন সংরক্ষণ প্রথা (১৯২০) চালু করে মুখ বন্ধ করা হল। আর আজও দেখছি এই সংরক্ষণ চালু হলেও এর উপকার তথাকথিত বঞ্চিত, শোষিত নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে পৌঁছল না। এই সংরক্ষণের সুযোগ তাঁরা নিচ্ছেন যাঁরা সুযোগ পেয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছেন এবং নীচের দিকের মানুষেরা প্রতারিত হয়েই থাকছেন। ফলস্বরূপ তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না। এমনকি, ওই নিম্নবর্ণের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা তাঁদের সমাজের মানুষকে তুলে আনার তেমন কোনও চেষ্টা দেখাচ্ছেন না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মনে হয় রাষ্ট্রকে ভেদাভেদের রাজনীতি ভুলে মানবিক ধর্ম দিয়ে বিচার করতে হবে সমস্ত দিক। নিম্নবর্ণের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষেরা যাতে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো প্রাথমিক সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি প্রতি উচ্চবর্ণের মানুষকে ধর্মশাস্ত্রের মূল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
লেখক চিকিৎসক এবং পুরুলিয়া বিজ্ঞানমঞ্চের সম্পাদক