আবার নির্বাচন— ফের কি শুরু হবে ‘চায়ে পে চর্চা’? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গর্ব করে বলেন, তিনি রেল স্টেশনে চা বিক্রি করতেন। এর সত্যতা জানতে চেয়ে ২০১৫ সালে তথ্যের অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন এক কংগ্রেস সমর্থক। উত্তরে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে পারেনি রেল বোর্ড কর্তৃপক্ষ। আশ্চর্য নয়। স্টেশনে বা চলন্ত রেলগাড়িতে কিছু বিক্রি করা বেআইনি, তাই রেল কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও ‘রেকর্ড’ থাকে না হকারদের।
কিন্তু এই যে ‘চায়েওয়ালা’ পাঁচ বছর থাকলেন ক্ষমতায়, রেলের হকারদের কী হল তাতে?
কিস্যু না। ‘বেআইনি’ পেশার চাপ, আর জরিমানার ভয় নিয়ে ক্রমাগত এক কামরা থেকে অন্য কামরা বদলে চলেছেন তাঁরা। স্বল্প কিংবা দীর্ঘ রেলযাত্রায় ঝালমুড়ি, সাবুর পাঁপড়, চা, আর বিচিত্র সব পণ্যের জোগানদার মানুষগুলো সরকারি খাতায় আজও সমান অবৈধ। শিয়ালদহ সাউথ লাইনের রেলের হকাররা নিজেদের বলেন ‘রানিং হকার’। পেশার এমন সার্থক নামকরণের উদাহরণ কমই আছে।
বারুইপুর জংশনের হকারদের আড্ডায় দোকানদার বোঝাচ্ছিলেন, সমাজে যেমন নারীপুরুষ আছেন, আর তাঁদের মাঝে আছেন হিজড়ে, তেমনই চাকরিজীবী আর শ্রমিক আছেন, তাঁদের মাঝে আছেন হকাররা। সকলে সমস্বরে সমর্থন করলেন।
লোকাল ট্রেনে যাঁরা উঠেছেন, হকারদের পসরার বিপুলতা তাঁদের অজানা নয়। লাইন অনুযায়ী তার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। শিয়ালদহ সাউথ লাইনে যেমন ‘ফটাস জল’। লোকাল সুগন্ধি সোডা কোলা-জাতীয় ঠান্ডা পানীয়ের পুরানো বোতলে বিক্রি হয়। ছিপি খোলার সময় ‘ফটাস’ করে শব্দ না হলে ক্রেতারা সন্তুষ্ট হন না। ‘ফটাস জল’ এই লাইন ছাড়া বিক্রি হয় না। শিয়ালদহ মেন লাইনে গ্রীষ্মকালে আমপোড়ার শরবত হাঁড়িতে নিয়ে ওঠেন হকাররা।
এক এক জন হকার যেন বাচিক শিল্পী। রেলের ঝমাঝম শব্দ আর যাত্রীদের কথাবার্তার ক্যাকোফনি, সেই আবহে অবিচল ভাবে পণ্যের গুণাগুণ বলে যান তাঁরা। নানা স্ক্রিপ্ট থাকে। যেমন, কলম বিক্রি করার জন্য মহারাজ মণ্ডল যাত্রীদের বোঝান, ‘‘পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি অস্ত্র হল কলম। রাষ্ট্রপতিও ব্যবহার করেন, মুখ্যমন্ত্রীও। দশ টাকা।’’ আবার সুজল নস্কর কলম বিক্রি করতে গিয়ে জোর গলায় বলেন, এই কোম্পানি ‘গভর্নমেন্ট রেজিস্টার্ড’।
এই হকারই যখন ‘গাছগাছড়ায় রোগমুক্তি’-র বই বিক্রি করবেন, তখন ধনতান্ত্রিক বিজ্ঞাপনের মায়াজালের বিরুদ্ধে, গ্রামবাংলার লোকায়ত চিকিৎসার সপক্ষে দুর্দান্ত পাল্টা আখ্যান হাজির করবেন। ‘‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে মুক্তি’’ এই বলে কুইজ়ের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করান তাঁরা। গ্যাস-অম্বল-বুকজ্বালা তাঁদের ভাষ্যে দেশের ‘জাতীয় রোগ’। ছোটখাটো সমস্যা ধরে সহজ ভাষায় কার্যকর গল্প করতে এঁরা ওস্তাদ। বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলি বাজার সমীক্ষা করে প্রচারের অভিমুখ স্থির করে। হকাররা জীবন থেকে তাঁদের রসদ সংগ্রহ করেন। লক্ষ লক্ষ কর্মসন্ধানী মানুষের সঙ্গে ওঠাবসার সুবাদে, এবং তাঁদেরই গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার জন্য, সমস্যার খোলনলচে চেনা হয়ে গিয়েছে হকারদের।
রেলের হকার তাঁরাই হন, যাঁদের পুঁজি সবচেয়ে কম। পাঁচশো টাকা জোগাড় করেও এই ব্যবসা শুরু করা যায়। স্টেশন বা রাস্তার স্থায়ী হকাররা মহাজনের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকার মাল তুলে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা করেন। রানিং হকারদের কাঁধের ব্যাগ ঢাউস হলেও হাজার টাকার বেশি মাল থাকে না। কেউ স্টেশনের স্থায়ী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি দিন বিক্রির পণ্য নেন। কেউ শিয়ালদহ আর বড়বাজার থেকে সপ্তাহের মাল কেনেন। মহাদেব মণ্ডল যেমন সপ্তাহে তিন হাজার টাকার পেন কেনেন। মাসের শেষে আট-নয় হাজার টাকা হাতে থাকে।
২০১৯ সালের বাজেটে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মোট জাতীয় উৎপাদনের অর্ধেক আসে বিয়াল্লিশ কোটি অসংগঠিত শ্রমের ঘাম-রক্তের বিনিময়ে। এঁদের মধ্যে আছেন হকার, রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, এমন বহু পেশার মানুষ। অর্থমন্ত্রী এঁদের প্রধানমন্ত্রী মেগা পেনশন যোজনা, আর ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে স্বাস্থ্যবিমার সুবিধে দেবেন বলেছেন। অথচ হকারদের কাছে এই সব প্রকল্পের ছিটেফোঁটাও পৌঁছয় না।
রেলের হকারদের মাঝেমধ্যেই জিআরপি কিংবা আরপিএফ আটক করে। কিছু দিন আগে মাঝেরহাট স্টেশনে অভিযান চালিয়ে হকারশূন্য করা হয়েছিল। রেল কর্তৃপক্ষের চোখরাঙানি থেকে বাঁচতে হকাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইউনিয়নের কার্ড করান। এক প্রবীণ হকার বলেছিলেন, কংগ্রেসের সময় কংগ্রেসি ইউনিয়ন করেছেন, সিপিএমের সময়ে সিটু, এখন আইএনটিটিইউসি করছেন। ‘‘জল যে দিকে গড়াবে ছাতা সেই দিকে ধরতে হয়।’’
হকারদের কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। ব্যাঙ্কের চেয়ে বেআইনি লগ্নি সংস্থা অনেক বেশি ধরাছোঁয়ার মধ্যে। সারদার এজেন্ট হয়ে কাজ করেছেন তাঁরা। এমন ব্যবস্থায় তাঁরা বাস করেন, যেখানে নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র জোগাড় করতে হয়, আবার সেই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রমাগত কুস্তিও লড়তে হয় কাজের স্বীকৃতির জন্য। রাষ্ট্রের সঙ্গে এঁদের সম্পর্ক টম ও জেরির মতো। কখনও মধুর উপাখ্যান, বিশেষত নির্বাচনের আগে বা উগ্র জাতীয়তাবাদের মুহূর্তে। আবার কখনও তাড়া খেয়ে চলা।
শিয়ালদহ, হাওড়া, বালিগঞ্জ, মাঝেরহাট-সহ নানা স্টেশন কিছু দিনের মধ্যেই ‘আধুনিক’ হবে। বিমানবন্দরের মতো সুরক্ষায় মুড়ে যাবে চত্বরগুলি, এই হল রেলনীতি আয়োগের সিদ্ধান্ত। হকাররা আরও গ্রামের দিকে সরে যাবেন। কেউ কেউ স্বাধীন ব্যবসা ছেড়ে এজেন্টদের অধীনে হীন শর্তে ‘বাঁধা ডিউটি’ করবেন। ব্র্যান্ডেড পণ্য বেচবেন। তাঁদের অবৈধ পেশার ভার গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্রের কর্ণধারের ‘চায়েওয়ালা’ ব্র্যান্ডিং সত্ত্বেও।