ভোট বাতিল

রাজার ঘরে সম্পদের অভাব নাই। ক্ষমতাই সম্পদের উৎস। টুনির একটিই ধন— তাহার ভোট। তাহাও কাড়িয়া লইলে সন্দেহ হয়, রাজা কি তবে ভয় পাইল? পশ্চিমবঙ্গে ভোট স্থগিত রাখিয়া, কিংবা ভোটের ফল কার্যত বাতিল করিয়া, স্থানীয় প্রশাসনে প্রশাসক বসাইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে। এই বৎসর এগারোটি পুরসভায় নির্বাচন হইবার কথা ছিল। রাজ্য সরকার হইতে দেয় নাই। কেন ভোট হইবে না, তাহার কোনও ব্যাখ্যাও দেয় নাই। রাজ্যবাসী কেবল দেখিতেছেন, একের পর এক পুরসভার দায়িত্ব লইতেছেন সরকারি আধিকারিকেরা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪৩
Share:

রাজার ঘরে সম্পদের অভাব নাই। ক্ষমতাই সম্পদের উৎস। টুনির একটিই ধন— তাহার ভোট। তাহাও কাড়িয়া লইলে সন্দেহ হয়, রাজা কি তবে ভয় পাইল? পশ্চিমবঙ্গে ভোট স্থগিত রাখিয়া, কিংবা ভোটের ফল কার্যত বাতিল করিয়া, স্থানীয় প্রশাসনে প্রশাসক বসাইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে। এই বৎসর এগারোটি পুরসভায় নির্বাচন হইবার কথা ছিল। রাজ্য সরকার হইতে দেয় নাই। কেন ভোট হইবে না, তাহার কোনও ব্যাখ্যাও দেয় নাই। রাজ্যবাসী কেবল দেখিতেছেন, একের পর এক পুরসভার দায়িত্ব লইতেছেন সরকারি আধিকারিকেরা। আগামী দুই মাসে আরও ছয়টি পুরসভায় নির্বাচিত বোর্ডের সময়কাল শেষ হইবে। সঙ্কেত মিলিয়াছে, সেগুলিতেও আর নির্বাচনের হাঙ্গামা হইবে না। প্রশাসক বসিবে। রাজ্যবাসী মাথা চুলকাইয়া ভাবিতেছেন, নোট বাতিলের পর এই বার কি ভোট বাতিল হইল? ভোট দেওয়া হইলেও অবশ্য নিশ্চিন্ত হইবার উপায় নাই, ভোটের ফল বাতিল হইতে পারে। সত্তরটিরও অধিক গ্রাম পঞ্চায়েতে তাহাই হইয়াছে। নির্বাচন হইবার পরেও নির্বাচিত প্রার্থীরা পঞ্চায়েত গঠন করিতে পারেন নাই, প্রশাসক বসিয়াছে। বিরোধীদের দাবি, ওই সকল পঞ্চায়েতে শাসক দল বোর্ড গঠন করিতে পারিবে না বুঝিয়াছে সরকার। তাই বিরোধীদের হটাইবার অভিপ্রায়ে প্রশাসক বসানো হইতেছে। সরকারের বক্তব্য, দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে বোর্ড গঠন করা যায় নাই। সরকারের যুক্তিটি কিছু বিস্ময়কর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাই তো সরকারের কাজ। পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য জনগণের ভোটের ফল বাতিল হইয়া যাবে, এ কেমন সিদ্ধান্ত? পরিস্থিতি শান্ত করিয়া বোর্ড গঠন করা কি এতই কঠিন?

Advertisement

মানুষ ভূতকে ভয় পাইলে তাহা রোমহর্ষক কাহিনি হইতে পারে। কিন্তু ভূত ভূতের ভয় পাইলে তাহা প্রহসন। গণতন্ত্রে তেমনই তামাশা নিয়ত ঘটিতেছে। যাহারা নাগরিকের ভোটে জিতিয়া ক্ষমতা দখল করিতেছে, তাহারাই নির্বাচন আসিলে ভূত দেখিতেছে। কী করিয়া ভোট এড়ানো যায়, তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর হইতে তাহারই বিবিধ উপায় খুঁজিতেছে। ২০১৩ সাল হইতে সমবায়গুলিতে নির্বাচন কার্যত উঠিয়া গিয়াছে। প্রায় সকল সমবায় সমিতি প্রশাসকের অধীনে চলিতেছে। স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটিগুলিতেও নির্বাচনের পাট নাই। শিক্ষার অধিকার আইনে অভিভাবকদের মধ্য হইতে প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা বলা হইলেও, এই রাজ্যে সেই বিষয়ে উদ্যোগ করা হয় নাই, তাই কমিটি তৈরিও হয় নাই। এই ভাবে নির্বাচন এড়াইতে প্রতিনিধিত্বের ধারণাটাই কার্যত বানচাল হইতে বসিয়াছে। অবশ্য নির্বাচন হইলেও ভোট দেওয়া যাইবে কি না, তাহার নিশ্চয়তা নাই। এ বার পঞ্চায়েতে তিনটি আসনের একটিই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। বিরোধীদের মনোনয়ন দাখিল করিতে দেওয়া হয় নাই, বিরোধীদের সেই দাবির সপক্ষে যথেষ্ট সাক্ষ্য মিলিয়াছে।

স্থানীয় প্রশাসনে নির্বাচন না করিতে দিবার ধারাটি পশ্চিমবঙ্গকে বামফ্রন্ট-পূর্ববর্তী জমানায় ফিরাইয়া দিতেছে। স্বাধীনতার পর তিন দশক প্রায় কোনও রাজ্যে নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় নাই। আধিকারিক দিয়া কাজ চলিত। সত্তরের দশকের শেষে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসিয়া বামফ্রন্ট নিয়মিত নির্বাচনের নজির সৃষ্টি করিয়াছিল। তাহার পর নব্বইয়ের দশকে সংবিধান সংশোধন করিয়া পুরসভা ও পঞ্চায়েতে নিয়মিত নির্বাচনের আয়োজন আবশ্যক করা হইয়াছিল। আজ আবার সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে সেই সাংবিধানিক নির্দেশ উপেক্ষা করিতেছে তৃণমূল সরকার। গণতন্ত্রের বৃক্ষশাখায় একের পর এক কুঠার চালাইতেছেন নেতারা। রাজ্যবাসী কেবল আশায় বুক বাঁধিতেছেন যে, কালিদাসের উপমাটি কলিকালেও বৃথা হইয়া যায় নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement