শেষ জন্মদিনে কবিগুরু। ছবি সৌজন্য - বিশ্বভারতী
আরও একটা বাইশে শ্রাবণ চলে গেল। ভেজা মাটিতে শিকড় ছুঁয়ে কচি পাতা সূর্যের আলো স্পর্শ করল। বৃক্ষরোপণ যেন কবির একটা নেশা হয়েছিল শেষ জীবনে। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ কবির ৬৪ বছরের জন্মদিনে ‘উত্তরায়ণে’র উত্তরে পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের হাতে। কবি রোপণ করেছিলেন অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক ও আমলকী— এই পাঁচটি গাছের চারা। প্রথম বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে ‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে’ গানটি গাওয়া হয়। সন্ধ্যায় অভিনীত হয় ‘নটীর পূজা’। পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী আশ্রমের প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসব উপলক্ষে একটি শ্লোকও রচনা করেন—
‘পান্থানাং পশুনাং পক্ষিনাং চ হিতেচ্ছায়া
এষা পঞ্চবটী রবীন্দ্রেনেহ রোপিতা।’
বাইশে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের দুপুর ১২টার কিছু পরে জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের ঘর থেকেই কবি চলে গেলেন। পরের দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, ‘কবির বর্তমান অসুস্থতার বহুপূর্বে কবি নাকি এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে তাঁহার অন্তেষ্টিক্রিয়া যেন তাঁহার প্রিয় আবাস শান্তিনিকেতনে সম্পন্ন করা হয়।’
রবীন্দ্রনাথ চাননি এমন যাওয়া। তাই তো ১৯৩০ সালের ২৫ অক্টোবর ইন্দিরাদেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আঢ়ম্বরে বিনা জনতায় হয় – শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্ম্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।’’
আর হল ঠিক উল্টোটা। নির্মলকুমারী মহলানবিশ (রানি) সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘যখন স্নান করানো হচ্ছে, নীচের জনতার মধ্যে একদল উপরে এসে বাইরে থেকে টান মেরে দরজার ছিটকিনি খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। কী দারুণ অপমান কবির চৈতন্যহারা এই দেহটার! যে মানুষের মন এত স্পর্শকাতর ছিল, যে মানুষ বাইরের লোকের সামনে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা কখনও প্রকাশ করতে পারতেন না, সেই মানুষের আত্মাহীন দেহখানা অসহায় ভাবে জনতার কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে পড়ে রইল। তাড়াতাড়ি তাঁকে ঢাকা দিয়ে সুরেনবাবুরা সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করলেন। এক-একটা দরজায় এক-একজন পাহারা। ভিতর থেকে দরজায় ছিটকিনি সত্ত্বেও হাত দিয়ে ঠেলে ধরে রাখা হয়েছে। তবু বাইরে থেকে প্রাণপণ ঝাঁকানি আর উন্মত্ত চিৎকার—দরজা খুলে দিন, আমরা দেখব। তাড়াতাড়ি করে আমরা কাপড় পরানো শেষ করলাম।...বেলা তিনটের সময় একদল অচেনা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষে আমাদের সামনে থেকে সেই বরবেশে সজ্জিত দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল। যেখানে বসেছিলাম সেখানে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। শুধু কানে আসতে লাগলো-‘জয় বিশ্বকবির জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়। বন্দেমাতরম।’
শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের কথা অনুযায়ী, ‘‘মৌলভী ফজলুল হক, স্যার সর্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু প্রভৃতি প্রধানেরা সকলেই সাড়ে বত্রিশ ভাজার মত জনতার মধ্যে মিশাইয়া গিয়াছিলেন।’’ সেটা যে কত মর্মস্পর্শী সত্যি ছিল তা প্রমাণিত হয়, ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর উক্তিতেও, ‘‘বাইশে শ্রাবণ আমার কাছে শুধু জাতীয় শোকের দিন নয় জাতীয় গ্লানির দিনও হয়ে আছে।’’
কবিরই দেওয়া নাম আকাশবাণী। রেডিও সে দিন শান্তিনিকেতনকে জানিয়েছিল কবির চলে যাওয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কবির মৃত্যু ও নিমতলায় দেহ সৎকারের ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের পশ্চিম তোরণের কাছে একটি ভবনে রেডিও ছিল। সে দিন যেন বিশ্বাস করতে পারেনি শান্তিনিকেতন আকাশবাণীর দেওয়া সেই সংবাদ। কিন্তু কবির শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছিল শান্তিনিকেতন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ-সহ অনেকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাঠভবন গ্রন্থাগার থেকে উপাসনা মন্দির পর্যন্ত ‘সমুখে শান্তি পারাবার-ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ --- গানটি সমবেত কন্ঠে গাইতে গাইতে গিয়েছিলেন। অথচ এই গানটা গাওয়ার কথা ছিল ডাকঘর নাটকেপ একটি বিশেষ প্রযোজনায়। ফকিরের চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কিন্তু সেই প্রযোজনা শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়নি। অমলের মৃত্যুর পরে এই গান গাওয়া হবে বলে ঠিক করেও কবিই নাকচ করে দিলেন। সে দিন তাঁরই চাওয়া ছিল, এ গান যেন তাঁর স্মরণসভায় গাওয়া হয়। সে দিন বিশেষ উপাসনা মন্দির পরিচালনা করেছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। সেখানেও এই গানটিই গাওয়া হয়। শালবীথিতে মৃত্যুর ইচ্ছে পূরণ না হলেও দিন কয়েকের মধ্যেই কবির স্নেহধন্য শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ কর পিতলের কলসিতে করে চিতাভস্ম নিয়ে শান্তিনিকেতনে আসেন। যা এখনও রবীন্দ্রভবনে সযত্নে সংরক্ষিত।
কবি চলে যাওয়ার দশ দিন পরেই ৩২ শ্রাবণ রবিবার, ইংরেজির ১৭ অগস্ট, ১৯৪১ সালে সকাল ৬.৩০ মিনিটে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাতিমতলায় ক্ষিতিমোহন সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রী আদি ব্রাহ্মসমাজ মতে শ্রাদ্ধবাসর পৌরহিত্য করেন। শ্রাদ্ধবাসরে কঠোপনিষদ থেকে যম ও নচিকেতার অংশটি পাঠ করেন মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী। পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদন করেন রথীন্দ্রনাথ ও সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। উপস্থিত সকলকে কবিগুরুর শেষ বয়সের ছবি, শেষ কবিতা ও সমুখে শান্তি পারাবার গানটি মুদ্রিত হরফে দেওয়া হয়। এর পরে বিশ্বভারতীর তরফ থেকে দরিদ্রদের অন্ন ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়।
৩০ জুলাই ১৯৪১, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ তিনটি পঙ্ক্তি রচনা করেন,
‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।’
নিজের মৃত্যুকেও যে স্বপ্ন দিয়ে বুনে রাখা যায় তার উদাহরণও কবি। তাই বোধহয় প্রাণের সঞ্চারের প্রকাশ বৃক্ষরোপণেই সম্ভব, এই ভাবনাতেও তাঁর চলে যাওয়ার পরেও প্রত্যক্ষ, প্রাণবন্ত হয়ে থাকার সূচনা করে গিয়েছিলেন নিজের হাতে কোনও না কোনও ছুতোয় গাছ লাগানোর মধ্যে দিয়ে।
১৩৩৫ বঙ্গাব্দের ৩০ আষাঢ়, ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই, শান্তিনিকেতনের গৌরপ্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন করলেন কবি। এরপরে সিংহসদনের সভায় কবি তাঁর রচিত ‘বলাই’ লেখাটি পড়েন। পিতৃ–মাতৃহীন বলাই তার নিঃসঙ্গ জীবনে উদ্ভিদদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করত। তাই তা প্রাসঙ্গিক ছিল সে দিন।
বৃক্ষরোপণ উৎসব নিয়ে উৎসাহের অন্ত ছিল না তাঁর। ইউরোপ প্রবাসী পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে ২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘তোমার টবের বকুল গাছটাকে নিয়ে অনুষ্ঠানটা হল। পৃথিবীতে কোনও গাছের এমন সৌভাগ্য কল্পনা করতে পার না। সুন্দরী বালিকারা সুপরিচ্ছন্ন হয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞক্ষেত্রে এল। (বিধুশেখর) শাস্ত্রী মহাশয় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন— আমি একে একে ছয়টা কবিতা পড়লাম।’
‘তপতী’ নাটক রচনার কয়েকদিন পরেই ১৯২৯ সালের ১০ অগস্ট বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে কবি লিখলেন —
‘আয় আমাদের অঙ্গনে
অতিথি বালক তরুদল
মানবের স্নেহ–সঙ্গ নে।’
১৯৩৬ সালের বার্ষিক বর্ষামঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের আয়োজন হয়েছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমের কাছে ভুবনডাঙা গ্রামে। সে বার ভুবনডাঙার বিশাল জলাশয় প্রতিষ্ঠা ছিল বর্ষামঙ্গল উৎসবের একটি বিশেষ অঙ্গ। কবি এই জলাশয়ের ধারে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা রোপণ করেন। বর্ষামঙ্গল উপলক্ষে তাঁর লেখা নতুন তিনটি গান গাওয়া হল — ‘চলে ছল ছল নদী ধারা নিবিড় ছায়ায়’, ‘আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু’ এবং ‘ঐ মালতীলতা দোলে’।
১৯৩৭ সালের ১৪ অগস্ট ‘আন্দামান দিবস’–এর অনুষ্ঠান হবে। কবি চাইলেন এতেও বৃক্ষরোপণ হোক। এই গাছেদের মধ্যে তিনিও মিশে থাকবেন শান্তিনিকেতন জুড়ে। হলও তাই। শান্তিনিকেতনের কাছে সাঁওতাল গ্রামে বৃক্ষরোপণ উৎসবে পৌরোহিত্য করলেন কবি। পরের বছর ১৯৩৮ সালে বৃক্ষরোপণ উৎসবে কবির বিশেষ আমন্ত্রণে সর্বপল্লী ডঃ রাধাকৃষ্ণন এসেছিলেন।
১৯৪০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ ও বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠিত হল। কবির রচিত শেষ বর্ষা সঙ্গীত - ‘এসো এসো ও গো শ্যামছায়াঘন দিন’ গাওয়া হল।
কবি চলে যাওয়ার সময় ভিড়ের চাপে শ্মশানে পৌঁছতে পারেননি রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন শান্তিনিকেতনেই। মাসখানেক পরে এখানে বৃক্ষরোপণ করেন তিনি। পরের বছর কবি–কন্যা মীরাদেবী ছাতিমতলার কাছে আরেকটি ছাতিম গাছের চারা বসিয়েছিলেন।
বৃক্ষরোপণ যে জীবনবৃক্ষের নব সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়, তা বারবার মনে করিয়ে দেয় বাইশে শ্রাবণ। এই ছাতিম, আমলকী, অশোক, বেল, অশ্বত্থতেই তো কবির স্পর্শ, কবির প্রাণ জুড়ে আছে।
তথ্যঋণ-
আনন্দবাজার পত্রিকা
চিঠিপত্র ৫
বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহলানবিশ
বাঙালনামা- তপন রায়চৌধুরী
শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮
The Last Ten Months – Anil Kumar Chanda, Visva Bharati News/ vol.10/ Juiy 1941
স্বপনকুমার ঘোষ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী