শূন্য করে ভরে দেওয়াই যার খেলা, সেই বসন্ত এল

এই বসন্তে প্রকৃতি ফিরে পায় জীবন। কেটে ফেলা গাছ থেকেও জেগে ওঠে নতুন পল্লব। আসে বসন্ত। লিখছেন মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসশীতের পরে এই বসন্তে প্রকৃতি ফিরে পায় জীবন। কেটে ফেলা গাছ থেকেও জেগে ওঠে নতুন পল্লব। সূর্যের উত্তরায়ণের পরে আসে বসন্ত। এই সেই সময়, যখন জেগে ওঠে  সকলে। নতুন পল্লব জানে না, তার আশ্রয় বৃক্ষটি মাটিতে পড়ে রয়েছে। তার শিকড়  উৎপাটিত। সে তার নিজের মতো করেই বাঁচতে চায়। বাঁচার এই স্বপ্ন দেখা থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রকৃত বসন্ত।    

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:০৭
Share:

ফাগুনের নবীন আনন্দে জেগে ওঠার দিন। কী আশ্চর্য দেখুন! বাতাস বলে দেয় ওই এল ওই এল রে! স্কুল চত্বরে গাছে গাছে ফাগুন, কোকিলের ডেকে ওঠা আর ছাত্রীরা ঠিক আমাদের ছোটবেলার মতো গলা তুলে ওদের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে উচ্চে তুলেছে স্বর ‘কুহু’, ভাবা যায়! আমরা তো শাস্তির ভয়ে ওদের অপূর্ব লতাকন্ঠী স্বরে স্বর মেলাতে পারিনি। বাড়ি ফিরে দেখে নেব ভেবে রেখে মুগ্ধ হয়েছি, উদাস হয়েছি, তাকিয়ে থেকেছি আমলকীর ডালে আর কুল বনের ইশারায়।

Advertisement

শীতের পরে এই বসন্তে প্রকৃতি ফিরে পায় জীবন। কেটে ফেলা গাছ থেকেও জেগে ওঠে নতুন পল্লব। সূর্যের উত্তরায়ণের পরে আসে বসন্ত। এই সেই সময়, যখন জেগে ওঠে সকলে। নতুন পল্লব জানে না, তার আশ্রয় বৃক্ষটি মাটিতে পড়ে রয়েছে। তার শিকড় উৎপাটিত। সে তার নিজের মতো করেই বাঁচতে চায়। বাঁচার এই স্বপ্ন দেখা থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রকৃত বসন্ত।

সত্যি এই ধুলো ধুলো দিনেই চড়কের গান বেজে ওঠে। লাল সিঁদুর টিপ, মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে ওরা দল বেঁধে এসে যায় দুয়ারে দুয়ারে, এক মুষ্ঠি চাল অথবা অর্থ সাহায্যের জন্য। মনে রয়েছে, ভয়ে এক ছুট্টে চলে গিয়েছি মায়ের পিছনে। তোর্সার চরে কিংবা তিস্তার ধারে, তখনও যেমন, এখনও তেমন। ওদের বীভৎস সব চড়কের খেলা দেখতে ভিড় জমায় মানুষ। কখনও জিভ এফোঁড় ওফোঁড়, কখনওবা, পিঠে বল্লম ফুটিয়ে ঘুরতে থাকা, সে চিত্র যতই বীভৎস হোক, বাতাসে বসন্তের গানে কমতি পড়ে না। আসলে মনেই তো বসন্ত। গুনগুন সে গান ‘‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে...।’’ রাস্তার ধুলো ওড়া নির্জন দুপুরে হঠাৎ চলে আসে শিবরাত্রি। সে উপলক্ষে নতুন বাজার এলাকায় কীর্তন গানের আসর। আজন্ম বৈষ্ণব বাড়ির কন্যে আর বৈষ্ণব পদ কথা ছোট্ট থেকে এ পর্যন্ত ভিড় ভিড় করে থাকে। বয়ে আনি কৃষ্ণের জন্মলীলা-কালীয়দমন পূর্বরাগ অনুরাগ অভিসার বিরহ মাথুর পর্ব। মনে পড়ে যায় সেই প্রাণঢালা গান। কথা সহজ কিন্তু বড় সত্য।

Advertisement

চুপ করে দুপুরে মার চোখ ফাঁকি দিয়ে কীর্তন আসরে গোপিনী-সহ কৃষ্ণের নৌকা বিলাস দেখে নেওয়া। শেষ হতেই এক ছুট্টে বাড়ি। সেই তোর্সার ধার। যাই হোক, সব কিছুর অনুষঙ্গে বসন্ত। বছর পেরিয়ে যায়, বসন্তরাজ একই ভাবে ঘুরে ঘুরে এসে পাখ পাখালির ডাক, মৌমাছির গুঞ্জরণ, হলুদ লালের সমাহারে জানিয়ে দেয় প্রেম এলো রে।

প্রেম জড়িয়ে আনে বিষাদ, স্মৃতি বয়ে আনে ভালবাসা। কতগুলো ক্ষত। সে ক্ষত এত দৃঢ় যে শত শত সাম্রাজ্য দাঁড়িয়ে গেলেও, শত সহস্র নদী জল বয়ে গেলেও ক্ষত সারে না। মিলিয়ে যায় না। কোনও কোনও প্রেম তীব্রতায় সব ছাপিয়ে যায়। কবিগুরুর সেই গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে ‘‘তুমি কিছু দিয়ে যাও মোর প্রাণে গোপনে গো /...তুমি কিছু নিয়ে যাও বেদনা হতে বেদনে/ যে মোর অশ্রু হাসিতে লীন, যে বাণী নীরব নয়নে।’’

আহা! কোথায় লাগে মোবাইল প্রেম, শত শত ভ্যালেন্টাইন ডে’র উইশ! এত ‘‘আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো...।’’ ফাগুনের দিনে এই যে নিভু নিভু শীতে সামান্য উষ্ণ ওম শরীরে চাপিয়ে মরসুমি ফুলের সুবাস আর আমলকী, কুলের টক স্বাদ নিতে নিতে বসন্ত উপভোগের জন্য তো চাই এক প্রস্তুত মন, যে কি না সহস্র রকম রিরংসা, হিংসা, ঈর্ষার ঊর্ধ্বেও বলবান মহীয়ান। মাথা উঁচু করে শত আবিলতার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়েও বলতে পারে ‘বসন্ত তুমিই করেছ মহান’।

কোনও প্রস্তুতি, কোনও মেশামেশি, কোনও দূরত্ব, কোনও শত্রুতা বসন্ত আবাহনীতে দাঁড়াতে পারে না। এই জন্যই তো আমরা আর আমাদের মতো সহজেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া কিছু পাগল বাতাসে আবিরের গন্ধ পাই। সে আবিরের রং হরেক। ভেষজ আবির নিয়ে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে প্রাণে প্রাণ মেশানোর ডাক দিই। সে ডুয়ার্সের পথ প্রান্তরেই হোক, কিংবা স্কুল চত্বরের বিরাট প্রাঙ্গণই হোক, বুড়ির ঘর জ্বলে ওঠে দাউদাউ। আমরা সমস্ত কালিমা, মালিন্য, সমস্ত অন্ধকার দূর করব বলে শপথ নিই। গৌড়ীয় মঠের শিশু বালক কীর্তনীয়াদের ডেকে আনি। ওরা খোল বাজিয়ে আমাদের চলার পথের সঙ্গী হয়। কোনও প্রবীণা হাতে তুলে নেন মন্দিরা। আমরা বসন্ত আবাহনীকে উৎসব করে তুলি, সঙ্গে নিই চা বনবস্তির একদল জনজাতির কন্যেকে—ওরা প্রকৃতি কন্যার মতোই নেচে নেচে গেয়ে ওঠে ‘‘নয়া বসন্ত্ কর দান কর্ ডালি / আইন্ হী তোর ই দুরা মে....আওয়া আওয়া আওয়া.../পিন্ধুয়া ঘিচা মে হার...আওয়া...’’

ওদের আনন্দে চোখে জল আসে। বুঝতে পারি সব ঝাপসা লাগছে কেন! আসলে বুকের গভীর ক্ষতটা আবার নড়ে চড়ে ওঠে, কে যেন নেই, কে যেন চলে গিয়েছে, সে কী আসে...সে কী এ পথেই আসবে, রঙিন শিমুল পলাশের পথ ধরে! শূন্য করে ভরে দেওয়াই যার খেলা সে বসন্ত যে দাঁড়িয়ে আছে পরিপূর্ণ হয়ে। এতো আমার, আমাদেরই বাংলা, সে প্রকৃতিই তো প্রেমিক, দু’হাত বাড়িয়ে আছে রক্ত চন্দনে ভরে দেবে বলে....ওগো দ্বার খোলো সব ফাগুনের বাঁশি বাজল যে!

(লেখক কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির শিক্ষক। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement