গত ৮ মার্চ পালিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রত্যেক বছরের মতো সেই দিনটিতে চলল অনেক আলোচনা, সভা-পর্যালোচনা। শুধু ভোটাধিকার নয়, অন্য যে সব অধিকারের লড়াই মেয়েরা শুরু করেছিলেন, সেই অধিকার লাভ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। অর্ধেক আকাশ আজও অন্ধকারে। রাজ্যে-রাজ্যে, জেলায়-জেলায় মেয়েদের অবস্থা নিয়ে আবার ভাবার সময় এসেছে।
এ রাজ্যের মেয়েরাও শিক্ষালাভ করছেন, প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন, বিশ্বে দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন। কিন্তু বিনা বাধায় শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন— এমন মেয়ের সংখ্যা এখনও যথেষ্ট কম। বর্তমানে বেশিরভাগ শিক্ষিত পরিবারের লোকজন মনে করেন, তাঁরা মেয়েদের যথেষ্ট শিক্ষা দিচ্ছেন, ছেলে-মেয়ের ভেদাভেদ করছেন না; মেয়েদের যত্নে রাখতে, স্বচ্ছন্দ দিতে খরচ করছেন দু’হাতে।
কিন্তু তার পরে? অনেকেই মেয়েকে ভাল পাত্রস্থ করতে মেয়ে ছোট থাকতেই টাকা জমাচ্ছেন। অভিভাবকেরা বিয়ের বয়স হতে না হতেই খুঁজছেন ভাল পাত্র। মেয়েকে সুশিক্ষিত, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেও বিয়েতে পণ দেওয়াতে কার্পণ্য করছেন না। এতে নাকি ‘সোশ্যাল স্টেটাস’ বজায় থাকছে! কিন্তু পণ দিয়ে তো সুখ কেনা যায় না। বিপদ বেড়ে চলে দিন দিন। মুখে বিরোধিতা করলেও, বাস্তবে সমাজের স্রোতের বিপরীতে যেতে পারেন ক’জন!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আবার রক্ষকই যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অভিভাবক হয়ে সুরক্ষার নামে তাঁদের এক দিকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার ঠিক উল্টো পিঠে একই সঙ্গে চলে নারী নির্যাতন, মেয়েদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা, ধর্ষণ, এমনকি হত্যাও। দু’দিকেই মেয়েরা অন্যের ইচ্ছা, চাহিদার দাস। মেয়েদের ইচ্ছা কি পরিবারের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিপরীতে সক্রিয় ভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়? কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও সাহযোগিতা বা সুবিচার না পেয়ে জীবনে পথ হারিয়ে গিয়েছেন বহু যোগ্য মেয়ে। স্বাভাবিক ভাবে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, মেয়েদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আসলে কতটা উন্নতি হচ্ছে তা কিন্তু বিচার করে দেখার বিষয়।
শহরে যখন নিয়ন আলোয় অন্ধকার ঢাকার চেষ্টা চলছে, গ্রামে অন্ধকার তখন আরও গাঢ় হয়ে আলোকে গ্রাস করছে। নাবালিকা বিয়ের হার মুর্শিদাবাদে প্রায় ৩৯.৯ শতাংশ। এ দিক থেকে জেলা হিসাবে মুর্শিদাবাদ ভারতের অন্য সকল জেলার থেকে বেশ এগিয়ে। শিক্ষার প্রসারের দিক থেকেও এই জেলা যথেষ্ট পিছিয়ে। ২০১৫-১৬ জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মুর্শিদাবাদের গ্রামাঞ্চলে ২০-২৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে ৫৯.২ শতাংশ মহিলারই ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে, এবং ১৫-১৯ বছরের মধ্যে ৩১.৫ শতাংশ মহিলা মা হয়েছেন বা হতে চলেছেন। মুর্শিদাবাদে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার যথেষ্ট কম। এর ফলে স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অধিকার (আইনি)-কোনও বিষয়ে মহিলারা তেমন সচেতন নন। এমন সমাজ-সংস্কৃতি গড়ে উঠছে যা শিশুর সার্বিক বিকাশকে ব্যাহত করছে। এ কথা ঠিক, সরকারি সহযোগিতা, উদ্যোগ, অনুদান আসছে অনগ্রসর এলাকার অগ্রগতির জন্য। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল গড়ে উঠছে। এই জেলায় দু’টি গার্লস কলেজ রয়েছে, পাশাপাশি আরও অনেক কলেজ থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের শিক্ষায় অগ্রগতির হার খুবই সামান্য। বেশি সংখ্যক মেয়ে কলেজে ভর্তির পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক মেয়ের পড়ার ইচ্ছা থাকলেও কম বয়সে বিয়ে ও সন্তানের জন্ম বা পারিবারিক অন্য চাপে তাদের পড়া ছেড়ে দিতে হচ্ছে; আবার পাশ করার জন্য যে সময় পড়াশোনা করা দরকার, সেই সময় তাঁদেরকে অন্য কাজে ব্যয় করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির ছেলেকে পড়াতে গিয়ে মেয়ের পড়াশোনার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। শুধু অভাব নয়, মানসিকতা অনেক সময় বড় বাধা হয়ে উঠছে। উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীর পারিবারিক সচেতনতা ও সমর্থন এই দুইয়েরই প্রয়োজন। মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় এরকম সচেতন পরিবারের সংখ্যা তুলনামূলক কম।
মেয়েদের জীবনের মোক্ষলাভ কি বিয়েতে? নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধু সন্তান প্রতিপালন ও সুগৃহিণী হওয়া? এই সব প্রশ্নের সদুত্তর আজও মেলেনি। সমাজের অর্ধাংশ জুড়ে যাঁরা রয়েছেন সেই মহিলাদের জন্য মুক্ত পরিবেশ গড়তে সমাজ ব্যর্থ, এটা আমাদের লজ্জা! মেয়েদের নিয়ে সমাজের মনোভাব দিশাহীন। মহিলাদের অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখলে, তারা ঘরের কোণে কূপমণ্ডূক হয়ে বাঁচলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থ চরিতার্থ হয়।
আমাদের দেশে মেয়েদের নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ঠিক মতো তৈরি হয় না। জীবন, শরীর, স্বাস্থ্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বেশিরভাগ মেয়ের থাকে না। এই দেশে, ২০১৭-১৮ সালেও রাজনীতিতে সচেতন ভাবে যোগদান করেন শতকরা ৪৯ জন মেয়ে। আবার যে মহিলারা রাজনীতিতে আসছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কেউ (বেশরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ) তাঁদের চালনা করছেন। এই সমাজে, মেয়েরা বিদ্যালয়, কলেজে যাবেন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করবেন কিন্তু স্বাধীন বা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাবেন না। পাবেন না মতামত দেওয়ার অধিকার। এটাই কি কাঙ্ক্ষিত? সাজে আধুনিক হলেও, বাস্তবে তাঁরা কতটা পিছিয়ে, কতটা অন্ধকারে সে সম্পর্কে সমাজ উদাসীন। যাঁরা সচেতন, তাঁদের নিজের মতামত দেওয়ার সাহস নেই। সাহস যদি দেখাতে সক্ষমও হন, তাঁদের কথা কেউ কানেও তোলে না। আর শিক্ষার অর্থ যদি শুধু ডিগ্রি লাভ হয়, যদি তার ব্যবহারিক প্রয়োগের জায়গা না থাকে, চাকরির বা আয়ের সুযোগ না থাকে, সেই শিক্ষালাভে শিক্ষার্থীর আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। কোনও বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ দ্বারা এর প্রতিকার সম্ভব নয়। যে দিন সামগ্রিক ভাবে মেয়েদের দুর্বল, অসহায়, পর-নির্ভরশীল, ভোগ্যপণ্য ভাবা বন্ধ হবে, যে দিন মেয়েরাও বুঝবেন নিজের পৃথক অস্তিত্বের কথা; পুরুষের চোখ দিয়ে নিজেকে না দেখে, নিজেকে নিজের মতো করে চিনবেন, নিজেকে অন্যের ভোগ্য, করুণার পাত্রী না ভেবে-সচেতন, সাহসী ও সাবলম্বী হতে পারবেন সে দিন নতুন সূর্য উঠবে, আলোয় ভরে যাবে চারপাশ, নিয়ন আলোর আর দরকার হবে না।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ডোমকল গার্লস কলেজ