Usha Ganguly

স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের প্রকাশ

১৯৭৬ সালে ‘রঙ্গকর্মী’ তৈরির আগে কলকাতার হিন্দি থিয়েটারে অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি ছিল ঊষার।

Advertisement

দেবাশিস মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০০:০১
Share:

ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের কাজ থেমে গেল এমন এক সময়ে, যখন গোটা বিশ্বের মানুষ সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাৎ যে সামাজিক সম্পর্কের আঙিনায় বেঁচে থাকে থিয়েটার, তাকেই এক অনিশ্চয়তার মধ্যে এসে দাঁড়াতে হচ্ছে। অন্যান্য নাট্যশিল্পীর মতো ঊষাও যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু ঊষার প্রয়াণের ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এই অভিশপ্ত সময়ে আমরা এক আশ্চর্য ছবি দেখলাম। মুম্বইয়ে সমীরা আয়েঙ্গারের আয়োজনে ঊষার দেড় ঘণ্টার শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠান আয়োজিত হল, সেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগ দিলেন দেশের নানা প্রান্তের নাট্যকর্মীরা। দিল্লির কীর্তি জৈন এবং অনুরাধা কপূরের মতো নাট্য পরিচালকেরাও ছিলেন সেখানে। থিয়েটারের ক্ষমতাকে অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারলেন ঊষা। ১৯৮০-র দশক থেকে এ পর্যন্ত বাংলার পাশাপাশি গোটা ভারতে প্রায় চল্লিশটি কাজ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নতুন থিয়েটারের ভাবনার পাশাপাশি সমাজ জীবনের সুখ-দুঃখের শৈল্পিক উপস্থাপনে সম্মান ও শ্রদ্ধা লাভ করেছেন সর্বত্র। প্রতিবেশী দুই দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও সমান ভাবে আদৃত হয়েছেন ঊষা।

Advertisement

১৯৭৬ সালে ‘রঙ্গকর্মী’ তৈরির আগে কলকাতার হিন্দি থিয়েটারে অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি ছিল ঊষার। কিছু দিনের মধ্যেই নিজের মতো করে থিয়েটারের একটা পথ তৈরি করতে শুরু করলেন। ‘রঙ্গকর্মী’র আমন্ত্রিত নির্দেশক হিসেবে এলেন তৃপ্তি মিত্র। নাটক ‘গুড়িয়া ঘর’, প্রধান অভিনেতা ঊষা। তৃপ্তি মিত্রের সাহচর্যে অভিনয় করলেন একেবারে নিজের মতো, যেখানে আদর-আহ্লাদ-আবেগের সঙ্গে মঞ্চে ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবাদ। পরবর্তী সময়ে নির্দেশনাও। ভিন্ন ভাষার নাটক অনুবাদ করলেন, মৌলিক নাটক লেখার দায়িত্ব নিলেন। মঞ্চে সে ভাবে লাল পতাকা বহন না করলেও, এম কে রায়নার নির্দেশনায় ‘মা’ নাটকে সেই রাজনৈতিক ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, এবং ১৯৮৪-তে নিজের ‘মহাভোজ’ নাটক থেকে প্রতিবাদকেই সামনে রাখলেন ঊষা। এই প্রতিবাদ এসেছে তাঁর অভিনয়ের একটি বিশেষ কুশলী গঠনে। সেখানেই ঊষা তাঁর সময়ের এক বিশেষ বোধ ও মননের অভিনেতা হয়ে উঠেছেন, যেখান থেকে সাধারণ দর্শক তাঁদের আকাঙ্ক্ষার এক চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। সে পরিচয় ভেঙে দিয়েছে ভাষার দূরত্বও। হিন্দি ভাষার প্রযোজনার মাধ্যমে বাংলা থিয়েটারের সীমারেখাকে বাড়িয়ে নিয়েছেন ঊষা। মনে পড়ে, এক বার শম্ভু মিত্র জানতে চেয়েছিলেন, বাঙালি দর্শক কেমন আসছেন নাটক দেখতে? ইতিবাচক উত্তর শুনে বলেছিলেন, ‘এটা খুব দরকার।’

ঊষা আরও বছর দশেক পরে সবিস্ময়ে বলেছিলেন, তিনি তো টিভি-র সিরিয়ালে কাজ করেন না, সিনেমাও খুব বেশি নয়, তবু রিহার্সাল ঘরে ছেলেমেয়েদের বসার জায়গা দিতে পারেন না। বিশেষ করে বহু দূর থেকে অল্পবয়সি অনেক মেয়ে আসে। তারা বাংলাভাষী। সেই তরুণী দল নিজেদের বলার বা বলতে না পারার কষ্ট নিয়ে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয়, নির্দেশনা, নাটক দেখেছে। সেখানে তাদের নিজস্ব সুরটি মিলেছে, আর তাই তারা ছুটে এসেছে ‘রঙ্গকর্মী’র মহলাঘরে।

Advertisement

‘মহাভোজ’, ‘হোলি’র মতো অনেকগুলি নাটকে মান্টো থেকে মহাশ্বেতা, রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছুঁয়ে গিয়েছেন ঊষা। তৈরি হয়েছে আজকের ঘরহারা মানুষের থিয়েটার। ১৯৯৮-এ একটি পত্রিকার আয়োজনে ঘরোয়া এক আলোচনা সভায় ঊষা বলেছিলেন, থিয়েটারে নির্দেশনার কাজ মানে রাজার হুকুম দেওয়ার কাজ নয়, একটি সর্বজনগ্রাহ্য মান্যতার প্রয়োজন, যেখানে প্রকৃত অভিনয় করতে পারবেন শিল্পীরা। এই পরিসরে তাঁর ‘মুক্তি’ নাটকে কাজ করে কেতকী দত্তের মনে হয়েছিল, ‘আমার শেষ জীবনের বড় পাওয়া মুক্তি।’ ঊষার অভিনেতা দলের আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জহরাবিবি। ‘খেলাগাড়ি’ (২০০৭) নাটকের আগে থিয়েটারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না শহরতলির এই মহিলার। তিনি ছিলেন ঠেলাগাড়ির চালক। ঊষা তাঁকে থিয়েটারে টেনে এনে এক রকমের মুক্তি দিয়েছিলেন। ওয়ার্কশপ বা কয়েক মাসের মহলা নয়, এই সব মানুষের সঙ্গে একটা ঠেলাগাড়ি মঞ্চে তুলে দর্শকের কাছে সমাজের প্রতি দিনের দেখা অথচ না জানা এবং না চেনা একটা দিক উপস্থিত করেছিলেন। হাবিব তনভীরের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হয়, সেই নাটকের কুশলী কণ্ঠস্বর এবং নিপুণ দেহভঙ্গি এখানে না থাকলেও একে থিয়েটার হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন দর্শক। কারণ এখানে অভিনয় সৌকর্যের থেকে বেশি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের অভিজ্ঞতার প্রকাশ। বিদেশি ‘ফ্রিডম অব থিয়েটার’-এ বোধ হয় এই ধরনের অন্বেষণের ইঙ্গিত আছে।

গত বছর মুম্বই শহরের ‘জুনুন’ নামে একটি সংগঠন নিমাই ঘোষের বাংলা থিয়েটারের ছবি নিয়ে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছিল। ডিসেম্বর মাসের পাতায় ছিল ‘রুদালি’ নাটকের একটি ছবি। কালো প্রেক্ষাপটে দীপদানি ধরা দু’টি হাত এবং ঊষার মুখে জড়িয়ে থাকা আলো। দীপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, যার আকার রবীন্দ্র প্রতিকৃতির মতো। চিত্রগ্রাহক সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। ছবিটি বোধ হয় প্রতীক করে রেখে গেলেন এই দুই শিল্পী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement