জাক শিরাক
টানা ১৯৬৭ থেকে ’৭৪ সাল অবধি কোনও না কোনও সরকারি বা মন্ত্রিপদের ভাগীদার, ১৯৭৪-৭৬ এবং ১৯৮৬-৮৮ দু’বার ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী, ১৯৯৫ থেকে বারো বছরের প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি প্রয়াত জাক শিরাক (১৯৩২-২০১৯) ছিলেন মহাযুদ্ধ-পরবর্তী ফ্রান্সের এক বর্ণময় রাজনীতিক। শুরু ১৯৬৭’তে, করেজ-এর নির্বাচিত সাংসদ হিসেবে। শোনা যায়, তাঁর রাজনৈতিক গুরু জর্জ পঁপিদু-র বারণ অমান্য করে বামদুর্গ করেজ-এর মাটি থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি। এই একগুঁয়েমির জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পঁপিদু তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘বুলডোজ়ার’।
তাঁর প্রয়াণ উপলক্ষে শোক-বিবৃতিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ বলেছেন, শিরাক ধারণ করে আছেন ফ্রান্সের বিশেষ এক ভাবধারা। সত্যিই, উন্নয়নের তিন স্বর্ণদশক থেকে মন্দা ও গণ-বেকারির কালো ছায়া, ভুবনায়ন থেকে ইউরোপের মুক্ত বাজার, সরকারে বাম-ডানের মিউজ়িকাল চেয়ার থেকে সহাবস্থান— ইতিহাসের এক খণ্ড যেন তাঁর জীবন। ফরাসিরা স্বভাবতই স্মৃতিকাতর। শোক-ভাষণ কালে মাকরঁ-র টেবিলে সাজানো ছিল ব্রোঞ্জের ফ্রেমে বাঁধানো পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের গুরু শার্ল দ্য গল-এর ছবি। মাকরঁকে শিরাকের ব্যক্তিগত উপহার। শিরাক পেয়েছিলেন তাঁর গুরু পঁপিদুর কাছ থেকে। ছবি সমেত এক প্রজাতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
এই উত্তরাধিকারের প্রভাবে তাঁকে বার বার বদলাতে হয়েছে মতাদর্শ। দক্ষিণপন্থী শিরাক ছাত্রাবস্থায় সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন বন্ধু মিশেল রোকার-এর মাধ্যমে। জোলিয়ো ক্যুরি-র মতো তাবড় কমিউনিস্টদের পাশে তাঁর স্বাক্ষর পাওয়া যায় পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে শান্তির দাবিপত্রে, তাঁকে নাকি দেখা গিয়েছিল প্যারিসের স্যাঁ স্যুলপিস গির্জার সামনে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র বিক্রি করতেও। কিন্তু তত্ত্বের থেকে তাঁর বেশি ঝোঁক ছিল প্রয়োগের দিকে, আদর্শবোধের থেকেও বেশি দায়বদ্ধ কর্মতৎপরতার প্রতি। দ্য গলের নজরে পড়তে দেরি হল না ন্যাশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্কুল-এর (এই এলিট প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরোন ফ্রান্সের তাবৎ প্রশাসক ও রাজনীতিক) এই প্রাক্তনীর। ধরলেন দ্য গলের জাতীয়তাবাদী পথ। ক্রমশ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের নীতিতে হাঁপিয়ে উঠে এক দিন মুক্ত বাজারের ভজনায় মন দিলেন।
১৯৬৮’র মে ছাত্র বিদ্রোহের সময় শিরাক সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রকের স্টেট সেক্রেটারি। ছাত্র-শ্রমিকের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের প্রতি সরকার পক্ষের এই প্রতিনিধির বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না। তবে শান্তি বৈঠকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে শ্রমিকের দাবিদাওয়ার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় ছিল না সে দিন।
১৯৮৬-তে বেকারত্বের বাড়বাড়ন্তে জনগণ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ-র নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী দলের প্রতি আস্থা হারালেন, আইনসভার নির্বাচনে ভোট বৃদ্ধি হল উগ্র দক্ষিণের। তার ফায়দা তুলল শিরাকের নতুন গড়া মধ্য দক্ষিণপন্থী দল। তারা সরকার বানাল। কার্যনির্বাহী সরকারের শীর্ষাসনে বসলেন শিরাক। ফ্রান্সে এই প্রথম প্রসিডেন্ট ও তাঁর অধীনস্থ নির্বাচিত সরকার ডান-বাম— এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল। শুরু হল বাম-দক্ষিণের সহাবস্থানের যুগ। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল বাম রাজনীতি।
১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ছাত্র-যুব’র মন জয় করতে ম্যাডোনাকে দিয়ে বিরাট কনসার্টের আয়োজন করলেন শিরাক। প্রচারমাধ্যম ও স্টারডম-এর সঙ্গে বিশেষ খাতির ছিল তাঁর। ফরাসি রক তারকা জনি হলিডে-র বিখ্যাত সেই গান— ‘আমাদের সবার ভেতর আছে একটা শিরাক’। প্রচারমাধ্যমের উপদেশে নির্বাচনের আগে মুখের ভোলবদল করলেন। উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সাহায্য নিলেন। সাধারণ ফরাসিকে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। উগ্র ডানপন্থী নেতা জঁ মারি ল্য পেন প্রচার করলেন, মিতেরঁকে একটাও ভোট নয়। তার পর টেলিভিশনের বিতর্কে মুখোমুখি দু’জনের ঐতিহাসিক বাক্-যুদ্ধ। ‘আজ সন্ধ্যায় আমি প্রধানমন্ত্রী নই, যেমন আপনি নন দেশের প্রেসিডেন্ট। আমরা সমকক্ষ দুই প্রার্থী। আজ আমি আপনাকে মিস্টার মিতেরঁ বলেই সম্বোধন করব।’ মিতেরঁর উত্তর: ‘এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একেবারে একমত, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার।’ চেহারায়, স্বভাবে দু’জনের বৈপরীত্য ছিল লক্ষণীয়, যেমন ছিল নীরব শীতল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মিতেরঁ-র কাছে পরাস্ত হলেন তাঁর ক্যাবিনেটের প্রধানমন্ত্রী।
মন্দার প্রভাবে যেমন ভেঙে পড়ছিল ফরাসি সমাজ, তেমনই কর্কট রোগে প্রেসিডেন্ট মিতেরঁ-র স্বাস্থ্য। সমাজবাদ ও তার ধারক দু’জনেই অস্তগামী। ১৯৯৫-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শিরাকের জয়টা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। একটা ফ্রান্স যদি উন্নয়নের রথে সওয়ারি, সমাজবাদীদের ভুলে অন্যটা ক্রমশ নিম্নগামী— এই রকম একটা তত্ত্বকে সামনে রেখে প্রচার চালিয়ে সফল হলেন। প্রধানত, ‘সামাজিক ফাটল’-এর এই তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়েই ফ্রান্সে এখন চলছে ‘হলুদ জ্যাকেট’ আন্দোলন।
প্রেসিডেন্ট হয়ে শিরাক একটা ভুল করলেন। সরকার ডানপন্থীদের দখলেই ছিল। কিন্তু প্রচারমাধ্যমের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছিল জনসমর্থনে ভাটা এসেছে। শিরাক নির্বাচন মারফত এই সত্য যাচাই করতে চাইলেন। বিশেষ ক্ষমতা বলে ভেঙে দিলেন সংসদ। কিন্তু নির্বাচনে জয় হল বাম জোটের। এ বার বাম পরিচালিত সরকারের মাথায় দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপ্রধান।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৭— টানা দুই মেয়াদে শ্রম আইনে সংস্কার, বেসরকারিকরণ, সামাজিক নিরাপত্তায় কাটছাঁট ইত্যাদি যে কোনও দক্ষিণপন্থী নেতা যা যা করে থাকেন, শিরাক করেছিলেন। আবার পারমাণবিক বোমার নিরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা সৈন্যবাহিনীতে তরুণদের বাধ্যতামূলক শ্রমদানের প্রথার অবসান তাঁর আমলেই। ৯/১১-র পর তিনিই প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রনেতা হিসেবে ঘটনাস্থলে ছুটে যান, মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাশে বসে বিশ্ব-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। আবার ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রবল বিরোধিতায় নামেন। ১৯৭৫ সালে দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট ভালেরি জিসকার দেস্ত্যাঁ-র আমলে ও তাঁর প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে গর্ভপাত আইনি মান্যতা পায়। বিশেষত, ফ্রান্সে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই আইনের অভিঘাত সুদূরপ্রসারী। ১৯৮১ সালে শিরাক বিরল দক্ষিণপন্থী সাংসদদের এক জন, যাঁরা মৃত্যুদণ্ডের অবসানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আফ্রিকার নিকট বন্ধু হিসেবেও তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। সত্তরের দশকে নেলসন ম্যান্ডেলার দলকে গোপনে অর্থসাহায্য করতেন বলে নিজেই পরে জানিয়েছেন।
প্রাচ্য শিল্পকলা ও দর্শনের ভক্ত ছিলেন শিরাক। প্রথম ফ্রান্স ভ্রমণকালে পণ্ডিত রবিশঙ্করেরও নজর এড়ায়নি আসরে প্রত্যহ উপস্থিত এই জিজ্ঞাসু। সে দিন কে জানত, ঈষৎ আলুথালু এই কিশোরের মধ্যেই ঘুমিয়ে এক দুঁদে রাষ্ট্রনেতা!