অস্তিত্ব: তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি। নিজস্ব চিত্র
তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি নিজেই এক ইতিহাস। ভারতের ইতিহাসের নানা পর্বের সঙ্গে যুক্ত ময়ূর রাজবংশের রাজপুরুষেরা। এক সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান ছিল এই রাজবাড়ি। তার আগে থেকেই অবশ্য ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে ছিলেন ময়ূর বংশের রাজারা। মহাভারতের সঙ্গেও যোগ রয়েছে তাম্রলিপ্ত রাজপরিবারের।
রাজপ্রাসাদ তৈরির বিষয়ে রাজা বীরেন্দ্রনারায়ণ কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, গ্রিসের আটজন স্থপতিকে আনা হয়েছিল প্রাসাদ নির্মাণে। তাঁরা ইউরোপীয় স্থাপত্যের আদলে রাজপ্রাসাদ তৈরির পরিকল্পনা করেন। খিলান দেওয়া প্রাসাদ। সামনে প্রশস্ত জায়গা। এই আদলেই কাজ শুরু হয়েছিল। একটি মূল স্তম্ভের উপরে রাজবাড়িটি অবস্থিত। দু’দিক দিয়ে চলে গিয়েছে সারি সারি ঘর। খিলান দেওয়া ঘরগুলো আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাম্রলিপ্তের ময়ূর রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ রায় ১৮৩৭ সালে রাজবাড়ি তৈরি করানোর কাজ শুরু করেন। দু’লক্ষ টাকা দিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। দোতলা রাজবাড়ির কাজ এগিয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ হঠাৎই খাজনা সংক্রান্ত বিবাদে ব্রিটিশদের বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।
সেই সময়ে ছিল ‘সূর্যাস্ত আইন’। নিয়ম অনুযায়ী, দেশীয় রাজা, জমিদার বা ইজারাদারদের নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে খাজনা জমা দিতে হত। না পারলে তাঁদের সম্পত্তি দখল করে নেওয়া হত। সেই সময়ে মেদিনীপুর শহরে রাজস্ব জমা দিতে হত। কিন্তু রাস্তা নিরাপদ ছিল না। পথে ডাকাতের ভয় ছিল। রাজা লক্ষ্মীনারায়ণের সেনারা রাজস্ব নিয়ে নদী এবং স্থলপথে মেদিনীপুরের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকেরা সেই রাজস্ব লুঠ করায়। রাজস্ব জমা দিতে না পারায় রাজপরিবারের সম্পত্তির বড় অংশ নিলাম হয়ে যায়। লক্ষ্মীনারায়ণ ন’লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা খাজনা দিতেন। সম্পত্তি নিলাম হওয়ায় তিনি প্রাসাদ নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। যেটুকু খাজনা আদায় হত তা দিয়েই রাজত্ব চালাতেন। রাজত্ব ফিরে পাওয়ার আশায় ফোর্ট উইলিয়ামে দরবার করেছিলেন। প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত মামলা লড়েছিলেন। পরে রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ প্রাসাদ সম্পূর্ণ করতে কিছুটা কাজ করেছিলেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তাম্রলিপ্ত রাজাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরোধ লেগেই ছিল। রাজা কমলনারায়ণ রায়ের মৃত্যুর পরে জমিদারি নিয়ে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে গোলমাল বাধে। ইংরেজ সেনা রাজবাড়ি দখল করতে আসে। সালটা ১৯৮২। রানি কৃষ্ণপ্রিয়া রুখে দাঁড়ান। ফলে রাজ ময়দানে যুদ্ধ শুরু হয়। রানি কৃষ্ণপ্রিয়ার বাহিনী পরাজিত হয়। তিনি রাজ্যচ্যুত হন। পরে আবার তা ফেরত আসে। ইংরেজদের সঙ্গে রাজপরিবারের দীর্ঘ বিরোধের কিছু নথি রয়েছে। ব্রিটিশ শাসকেরা রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণকে একটি চিঠি লেখেন। তার ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে তাঁরা লিখেছেন, বিরোধ প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়িয়েছিল। রাজ কর্তৃপক্ষ মামলা করেছিলেন কাউন্সিলে। একসময়ে রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ সব সম্পত্তি তাঁর জামাই তথা ময়নার রাজা রাধাশ্যামানন্দ বাহুবলীন্দ্রের হাতে ছেড়ে দেন। তাঁকেই দেখভালের দায়িত্ব দেন। তাঁর অদূরদর্শিতায় তমলুকের রাজা জমিদারি ফিরে পাননি।
ব্রিটিশ শাসকদের চিঠিতে আরও একটি তথ্য মেলে। তাঁরা লিখেছিলেন, তমলুকের রাজা বহু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কৃষ্ণার্জুন মন্দির-সহ সাতটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই দেবোত্তর সম্পত্তি থেকে তমলুকের রাজার বছরে ৪০ হাজার টাকা আয় হতে পারত। কিন্তু রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ জমিগুলো মন্দিরের খরচ চালানোর জন্য দিয়ে দেন। এ ছাড়াও লাখেরাজ জমি তমলুকের রাজারা তাঁদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আধিকারিকদের দান করে দেন। যা থেকে রাজারা কয়েক হাজার টাকা আয় করতে পারতেন। দান করা জমি ছিল নিষ্কর। কিন্তু পরে রাজপরিবার এই প্রাপকদের পাশে পাননি। ইংরেজদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতের প্রাচীনতম পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম তাম্রলিপ্ত রাজপরিবার। যা অন্তত ৫০২০ বছরেরও পুরনো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রাজপরিবারের সদস্য ধীরেন্দ্রনারায়ণ রায় দীর্ঘদিন লন্ডনে ছিলেন। ব্রিটেনের রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি কিছু নথি সংগ্রহ করেন। তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তাম্রলিপ্ত রাজপরিবারের উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় তাম্রলিপ্তের রাজকুমার তাম্রধ্বজ উপস্থিত ছিলেন। এর পরে উল্লেখ মেলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে। যুবরাজ তাম্রধ্বজ বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে পাণ্ডবদের নিয়ে বিরুদ্ধে যুদ্ধে করেন। মহাভারতে তাম্রলিপ্তের তৃতীয় উল্লেখ যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়ে। তাম্রলিপ্ত রাজ যজ্ঞের ঘোড়া আটকান। প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল দুই পক্ষে। পরে কৃষ্ণের চেষ্টায় যজ্ঞের ঘোড়া মুক্তি পায়। দুই রাজপরিবারের মধ্যে সখ্য তৈরি হয়। অশ্বমেধ যজ্ঞস্থলে তাম্রলিপ্ত রাজা বহু উপঢৌকন নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রাজপরিবারের। ৬২তম রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণ, তাঁর পুত্র ধীরেন্দ্রনারায়ণ এবং নাতি কুমারেন্দ্রনারায়ণ স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীলকুমার ধাড়া নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বাসস্থান এবং আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে ওঠে রাজবাড়ি। ১৯০৫ সালে অবিভক্ত বাংলায় বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। তমলুকে ব্রহ্মা বারোয়ারি ময়দানে রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণের নেতৃত্বে বিরাট জনসমাবেশ বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধে অংশ নেয়। ১৯২১ সালে দুর্ভিক্ষের সময়ে বড়লাট লর্ড রোনাল্ডস স্টিমারে তমলুক এসেছিলেন। তিনি রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন লর্ড রোনাল্ডস দেওয়ানি আদালতের (জেলা আদালত) পূর্বদিকের ময়দানে সরকারি উদ্যোগে মণ্ডপ তৈরি করে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময়ে রাজপরিবারের ভূমিকা ছিল। নরঘাটে লবণ আইন ভঙ্গের জন্য বিশাল মিছিল রাজবাড়ি থেকে রওনা হয়েছিল। নেতৃত্বে ছিলেন ধীরেন্দ্রনারায়ণ। তিনি লাহৌর কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন। ওই বছরেই মেদিনীপুরের কুখ্যাত জেলাশাসক পেডি রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণের কাছে হাজির হন। রাজাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজপ্রাসাদ থেকে সত্যাগ্রহীদের তাড়িয়ে দিতে। কিন্তু রাজা রাজি না হওয়ায় পেডি তাঁকে বন্দি করেন। বন্দি রাজাকে নিয়ে তিনি মেদিনীপুরে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু খবর ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। পাঁশকুড়ার চনশ্বরপুরে মুসলিম সম্প্রদায় তাঁদের রাস্তা আটকান। বাধা পেয়ে রাজাকে ফিরিয়ে এনে তমলুকের পায়রাটুঙ্গি ডাকবাংলোয় বন্দি করা হয়। পরে রাজাকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল ও দমদম জেলে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের ১১ এপ্রিল সুভাষচন্দ্র বসু তমলুকে এলেন। প্রথমে সভাস্থল ছিল রাখাল মেমোরিয়াল ময়দান। কিন্তু শাসকদের চাপে মালিক পক্ষ পিছিয়ে গেলেন। কংগ্রেস নেতারা দেখা করলেন রাজা সুরেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে। রাজবাড়ির প্রাচীন আম ও গোলাপবাগান কেটে রাতারাতি সভার মাঠ তৈরি হল। রাতে হ্যাজাক জ্বেলে সভা হয়।
১৩৪৯ বঙ্গাব্দের ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাম্রলিপ্ত পুরনো রাজপ্রাসাদ। রাজপরিবারের সদস্যরা মূল রাজবাড়ির পিছনের দিকে ‘রানি মহলে’ চলে যান। বর্তমানে পুরনো প্রাসাদ পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের অধীনে। সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে।
লেখক রাজপরিবারের সদস্য