বিমলমতিলাল! তে/ সমলমতিনা ময়া
বিমতিমলমার্জনে/ ত্বমলমিতি চিন্ত্যতে
ঈশ্বর বনাম নিরীশ্বর বিতর্ক
ইন্দ্রিয় দ্বারা সাক্ষাত্ প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনও প্রমাণ মানা যায় না— এই অভিমতের ভিত্তিতে চার্বাকরা কার্য থেকে কারণ অনুমান করার বিরুদ্ধে আপত্তি করেছেন, যার ফলাও করা সংস্করণ হল আধুনিক পশ্চিমী লজিকের ‘প্রবলেম অব ইন্ডাক্শন’— পরিমিত পরিমাণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অপরিমিত সার্বত্রিক নিয়ম জানবার সমস্যা— এর বহু রকমের জবাব নৈয়ায়িকরা দিয়েছেন। অনুমান প্রমাণই নৈয়ায়িকের প্রাণের ধন। এই অনুমান দিয়েই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের অতিরিক্ত মন বলে আর এক ইন্দ্রিয় আবিষ্কার করেছেন নৈয়ায়িকরা। তরুণ বিমলকৃষ্ণ ‘আমি আর আমার মন’ বাংলা নিবন্ধে এই মনের কথাই প্রাঞ্জল ভাবে লেখেন। তিনি গঙ্গেশের ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ থেকে চার্বাকের চোখে ধুলো দেওয়া একটি যুক্তি উদ্ধার করে আমাদের শোনাতেন: চার্বাক বলছেন, ‘সীমিতসংখ্যক সহচার দর্শনের ভিত্তিতে কখনওই অসীমসংখ্যক ক্ষেত্রবিষয়ক সার্বিক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।’ নৈয়ায়িক প্রত্যুত্তরে প্রশ্ন করবেন, ‘আচ্ছা ওই যে বললেন ‘কখনওই’ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপ্তিজ্ঞান অনিশ্চিত, কারণ অদেখা বিশেষ স্থলে নিয়মের ব্যতিক্রম সম্ভাবনা থেকেই যাবে’— এই কথাটি কি একটি সার্বত্রিক নিয়ম? যদি এটাও একটা সার্বত্রিক সামান্যীকরণ হয় তা হলে সব সামান্যীকরণের মতন এটারও ব্যতিক্রম হতে পারে, অর্থাৎ কোনও কোনও জায়গায় অদেখা স্থলের বিষয়ক সার্বত্রিক ব্যাপ্তিনিয়ম প্রমাণ করা যেতে পারে? আর যদি ‘সব ক্ষেত্রেই’ বলা সত্ত্বেও এই বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত, তা হলে অনুমানের মূলে যে ব্যাপ্তিজ্ঞান দরকার তা আপনারাই মেনে নিচ্ছেন যে হতে পারে।
আসল কথা, নৈয়ায়িক এই জগতের মধ্যে যে সব বৈচিত্রপূর্ণ কার্যসন্নিবেশ, গাছপালা, পশুপাখির, মানবশরীরের, পৃথিবীর পাহাড়, নদী, খনিজ, উদ্ভিদ, সমুদ্র, নদীর সাজানো সৃষ্টিশাড়ির বুনট দেখে— ওই সব কার্যগুলিতে নিমিত্তকারণজন্যত্ব— এই হেতু প্রয়োগ করেন। বুদ্ধিপূর্বক, উপাদান জেনে নিয়ে যেমন তাঁতি শাড়ি বানায়, কুমোর মাটি দিয়ে নানা আকৃতির ঘট, বাটি, ভাঁড় বানায়, তেমন, এক জন কোনও বিশ্বশিল্পী জগৎতাঁতির অস্তিত্বই এ অনুমানের সাধ্য। সেখানেই তাঁরা বার বার দেখা শাড়ির কারুকার্য ও তাঁতির উপস্থিতি— এ রকম হেতু সাধ্যের একত্র অবস্থানের ভিত্তিতে জগতের নৈসর্গিক কার্যগুলোরও এক জন সর্বশক্তিমান নির্মাতা আছেন তা অনুমান করতে চান। সেখানেই সমর্থক যুক্তি হিসেবে ব্যাপ্তিনিয়মটাকে সবল সযুক্তিক করবার জন্য নেতিবাচক ভাবে তাঁরা ‘তর্ক’ লাগান, ‘যদি এক জন বুদ্ধিমান জগৎকর্তা না থাকতেন তা হলে পরমাণুগুলো জুড়ে জুড়ে, এমনকী লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলেও, এমন চমৎকার জগৎ গড়ে উঠত না, যে জগতে মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল যন্ত্র জন্মাতে পারে। সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকেও এমন আকস্মিকতা বাঁদরের আনতাবড়ি কম্পিউটার কি-বোর্ডে আঙুল চালিয়ে সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলি লিখে ফেলার থেকেও অনেক বেশি অসম্ভব।
বিমলকৃষ্ণ মতিলাল এই সেশ্বর নিরীশ্বর বিবাদের মধ্যে মধ্যস্থ থাকতে ভালবাসতেন। ঠিক আছে, জগৎটা নিষ্কারণ নয়। কিন্তু এক জনই জগৎনির্মাতা হতে হবে, এমন কী যুক্তি আছে? ধর্মকীর্তি— যিনি অনুমান মানতেন, কিন্তু বৌদ্ধ হিসেবে ন্যায়ের ঈশ্বরানুমানকে কচুকাটা করে গেছেন, তিনি উইঢিবির দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছেন, অপূর্ব নির্মাণ কৌশল, কিন্তু বল্মীকদের কি কোনও ধারণা আছে কী বানাচ্ছে, কেন বানাচ্ছে? তিনি এও দেখিয়েছেন যে, যত যত স্থানে ভূয়োদর্শন-পর্যবেক্ষণ রিপিট করে করে তোমরা দেখেছ যে যেখানেই বিশেষ উদ্দেশ্যসাধক বিচিত্র নির্মাণকৌশল আছে, সেখানেই এক জন নির্মাতা আছে— সেই সব জায়গায় নির্মাতা এক জন শরীরবান দেশকালে সীমায়িত ব্যক্তি, এই ব্যাপ্তির ভিত্তিতে এক জন অশরীরী সর্বব্যাপী দেশকালে অসীম অনন্ত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে তোমরা কী করে আমদানি করবে? এ তো হেতু আর সাধ্যের মধ্যে বিরোধ দোষ হয়ে গেল!
যদি তিনি সর্বকর্তা সর্বজ্ঞই হন আর কল্যাণময় হন তা হলে জেনেশুনে অজ্ঞ মানুষকে দিয়ে অসৎ আচরণ কেন করান? আগে পাপ করিয়ে তার পর শাস্তি দিয়ে শিক্ষাদান যদি তাঁর বিবেকবান ন্যায়শীল হওয়ার লক্ষণ হয়, তা হলে মানুষকে আদিতেই ওই খারাপ কাজ থেকে নিবৃত্ত করার শক্তিটুকুও তাঁর নেই। আর এই সবই যদি ওই কল্পিত সর্বজ্ঞ শিবের লীলাখেলা হয় তা হলে তাঁকে পাগল বা নিষ্ঠুর বলা ছাড়া উপায় থাকে না। এক জনের ক্ষণিক তৃপ্তি হবে বলে রাশি রাশি জীবের যন্ত্রণায় প্রাণ বেরিয়ে যাবে? আর এই ঈশ্বরকে মঙ্গলময় সর্বশক্তিমান বলে মানতে হবে? প্রজ্ঞাকরগুপ্ত ধর্মকীর্তির ঈশ্বর খণ্ডনাত্মক সাতখানা মারাত্মক শ্লোকের ব্যাখ্যায় ‘প্রমাণবার্তিক অলংকার’ গ্রন্থে ও রকম পাতার পর পাতা যা লিখেছেন তা জে এল ম্যাকি বা রিচার্ড ডকিন্স-এর মতো নিরীশ্বরবাদীদের যুক্তিকেও হার মানায়। বিমলকৃষ্ণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেফানোস্ নির্মলেন্দু স্মারক বক্তৃতামালার প্রথম দুটি বক্তৃতায় এই দুঃখ ও কদাচারের সমস্যার জবাবে শংকরাচার্য, উদয়নাচার্য, জয়ন্ত ভট্ট কী বলেছেন তার বিশদ আলোচনা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২-তে ছাপা ‘লজিকাল অ্যান্ড এথিকাল ইসুজ্ অব রিলিজিয়াস্ বিলিফ্’ বইটিতে পাওয়া যাবে। একটি অপূর্ব নিজের
বুদ্ধির দীনতাখ্যাপক সংস্কৃত কবিতা
দিয়ে উনি এই বই মধুসূদন ন্যায়াচার্য, বিশ্ববন্ধু তর্কতীর্থ এবং অনন্ত তর্কতীর্থ ওঁর তিন ন্যায়দর্শনের অধ্যাপকের চরণে উৎসর্গ করেছিলেন।
বিমলকৃষ্ণ নিজের বালিকা কন্যা অন্বিতার সঙ্গে এই সহজ প্রশ্নের খেলা খেলতেন, এই বিষয়ে ‘ওমনিপোটেন্স’ নিয়ে, তিনি লিখেও গিয়েছেন। অন্বিতা জিজ্ঞেস করবে, ‘আচ্ছা বাবা, গড কি এমন একটা পাথর তৈরি করতে পারেন যা এত ভারী যে তিনি নিজেই তুলতে পারেন না?’ বিমলবাবু বলবেন, ‘হুঁ! মুশকিলের কথা! যদি এমন পাথর তৈরি করতে পারেন তা হলেও তিনি সর্বশক্তিমান নন। তুলতে পারেন না যে! আর যদি তৈরি না করতে পারেন তা হলেও তিনি সর্বশক্তিমান নন।’ লক্ষ করুন, এই সবই ভাবা হচ্ছে ‘যদি পারতেন...’ ‘যদি না পারতেন’ জাতীয় তর্ককল্পনার মাধ্যমে। এই জাতীয় কল্পনার ভাণ্ডার হল লুইস ক্যারলের আজব দেশে অ্যালিসের গল্প। বর্তমানে গণিতবিশারদ অন্বিতা মতিলাল, যাকে আদর করে বিমলকৃষ্ণ ‘কানেক্টেড’ বলে ডাকতেন (অন্বিতা মানে তা-ই), তার সঙ্গে এই অ্যালিসের আজগুবি কিন্তু লজিকের ধাঁধাভরা গল্পের আদানপ্রদান চলত। অন্বিতার সঙ্গে প্রাতরাশের টেবিলে ফিলজফি, ফাজলামি, লুইস ক্যারল, আর পুত্র তমালকৃষ্ণের সঙ্গে ইউরোপের ইতিহাস চর্চা করতে করতে সকলেরই স্কুল-কলেজের দেরি হয়ে যেত। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অতিথিবৎসল ছাত্রদরদি গ্রন্থরচনায় অতন্দ্র বিমলকৃষ্ণের বাড়িতে কলেজে সর্বত্র তর্ক ও কল্পনার এক ধুম লেগেই থাকত। যে তর্কের সহিত থাকে, তাকেই তো বলে সতর্ক। কিন্তু বিমলকৃষ্ণ অন্য আর এক নৈতিক মানবিক অর্থেও থাকতেন সর্বদা সতর্ক।
পাশ্চাত্য লজিকে আর ভারতীয় লজিকে ঘটনাবিরুদ্ধ ‘তর্ক’-এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা রচনা করেছেন বিমলকৃষ্ণের স্নেহধন্যা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যা অমিতা চট্টোপাধ্যায়।
(চলবে)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই, মানোয়া’য় দর্শনের শিক্ষক