প্রশ্ন: নতুন অর্থবর্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সরকার কি রাজস্ব ঘাটতিতে লাগাম পরাতে পারছে না?
পিনাকী চক্রবর্তী: প্রথমে খেয়াল করা দরকার, রেভিনিউ ডেফিসিট বা রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে চলতি খরচের যে অংশ ঋণ করে ব্যয় করতে হয়। রাজকোষ ঘাটতি বা ফিসকাল ডেফিসিট হল সরকারের সমস্ত খরচের যে অংশ ঋণ করে ব্যয় করতে হয়। যদি রাজস্ব ঘাটতি থাকে, তবে ঋণের একটা বড় অংশ চলতি খরচের জন্য ব্যয় হয়। সেটা মোটেই কাম্য নয়। কেন্দ্রের রাজস্ব ঘাটতি কীভাবে বাড়ে? বড় অঙ্কের টাকা যায় ধারের উপর সুদ মেটাতে। বেতন, পেনশন, সরকারি শাসনব্যবস্থা চালাতে। এই খরচ গত কয়েক বছরে খুব একটা বাড়েনি। পেট্রপণ্যে ভর্তুকি কমেছে। খাদ্যে ভর্তুকি বাড়েনি। রাজস্ব ঘাটতিও কমেছে। এর পর যদি রাজস্ব ঘাটতি শূন্য করতে হয়, তবে সরকারকে রাজস্ব বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। আমার বিশ্লেষণ, রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে বিপুল বহরের কেন্দ্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পের জন্য। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, এনআরইজিএ বা একশো দিনের কাজ, সর্ব শিক্ষা অভিযান, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা—সবই তো রাজস্ব খাতে ব্যয়।
প্র: এ-সবে টাকা ঢালতে গিয়ে কি পরিকাঠামোয় কোপ পড়ছে?
উ: গত কয়েক বছরে কেন্দ্রের পরিকাঠামোয় বা মূলধনী খাতে খরচের জায়গাটা ক্রমশ কমেছে। বেসরকারি লগ্নি বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ (পিপিপি) থেকে পরিকাঠামোয় বেশি খরচ হচ্ছে। রাস্তা তৈরির খরচ তোলার জন্য টোল বসানো হচ্ছে। বাজেটের বাইরে যে-সব খরচ পরিকাঠামো তৈরির জন্য করা হচ্ছে, সেটা অনেক বেশি।
প্র: কেন্দ্রীয় প্রকল্পে এত টাকা ঢালার কারণ কী?
উ: এটা হল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সরকারি ব্যয়ের ‘পলিটিকাল ইকনমি’। কেন্দ্র এমন সব কাজে রাজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে, যেগুলো বরাবর রাজ্যের দায়িত্ব ছিল। গ্রামে রোজগারের ব্যবস্থা তো রাজ্যের কাজের তালিকায় পড়ে। সর্ব শিক্ষা অভিযানে প্রাথমিক শিক্ষায় কেন্দ্র টাকা ঢালছে। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে খরচ হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যে। সবই রাজ্যের প্রাথমিক দায়িত্ব। দারিদ্র কমানো, সকলের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা অবশ্যই মহৎ নীতি। প্রশ্ন হল, দায়িত্বটা কার? সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের।
প্র: তাতেই কি কেন্দ্রের রাজস্ব ঘাটতি বাড়ল?
উ: কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করে রাজ্যকে অনুদান দেওয়া হল। সেটা রাজস্ব ব্যয়। ফলে ঘাটতি বাড়ল। সরকার এফেক্টিভ রেভিনিউ ডেফিসিট বা কার্যকর রাজস্ব ঘাটতির ধারণা চালু করল। তার হিসাবে রাজ্যকে দেওয়া অনুদানের একটা অংশ চলতি খরচ হিসাবে ধরা হয় না। এর মূল উদ্দেশ্য ঘাটতি কম দেখানো। সেটা কাম্য নয়। এখন কেন্দ্র রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। এতে সমস্যা বাড়বে। পরিকাঠামোয় ব্যয় কমালে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাবে।
প্র: ইউপিএ আমল থেকেই তো কেন্দ্রীয় প্রকল্পের রমরমা শুরু?
উ: হ্যাঁ। ইউপিএ-জমানায় বৃদ্ধির হার ৮ থেকে ৯ শতাংশ ছুঁয়েছিল। আয়কর বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। তখন এ ধরনের কেন্দ্রীয় যোজনা করা সম্ভব ছিল...
প্র: কেন্দ্র তো বলতেই পারে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি জাতীয় অগ্রাধিকার!
উ: এই মুহূর্তে ২৮টা কেন্দ্রীয় প্রকল্প চলছে। যদি কেন্দ্র বলে, সকলের জন্য স্বাস্থ্য বিমা তার অগ্রাধিকার, রাজ্যকে তার দায় নিতে বলা কেন! কেন্দ্র পুরো খরচ করুক। কেন্দ্রের অগ্রাধিকার রাজ্যের অগ্রাধিকার না-ও হতে পারে।
প্র: কেন্দ্রের কি রাজ্যের হাতে অর্থ দিতে আপত্তি?
উ: করের ভাগ ও অনুদান মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কর বাবদ আয়ের ৬৫ শতাংশ অর্থ কেন্দ্র রাজ্যগুলির মধ্যে বিলি করে দেয়। এর মধ্যে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ মেনে যে ৪২ শতাংশ অর্থ রাজ্যগুলির মধ্যে বিলি হচ্ছে, রাজ্য তা নিজের মতো খরচ করতে পারে। আসলে ৬৫ শতাংশ অর্থ রাজ্যকে দিতে কেন্দ্রের আপত্তি নেই। শর্তহীনভাবে দিতে আপত্তি। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের ফলে সেই শর্তহীন অর্থ দেওয়াটা বেড়েছে।
প্র: কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পেরই কি তবে দরকার নেই? রাজ্য সামাজিক সমস্যার সমাধান বেশি ভালভাবে করতে পারে?
উ: পোলিয়ো টিকাকরণ কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সাফল্যের ক্লাসিক উদাহরণ। সেটা রাজ্যগুলিকে দায়িত্ব দিলে হত না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যদি দিল্লিতে বসে মনে করে, আমি সবই পারি, সেটা ভুল ধারণা। এক বারও বলছি না, একশো দিনের কাজের প্রকল্প এ-দেশে দরকার নেই। কিন্তু কোনও রাজ্যে তার দরকার হলে রাজ্যই তা করতে পারে। একশো দিনের কাজের প্রকল্প তো প্রথম রাজ্যেই শুরু হয়। মহারাষ্ট্রে। তামিলনাড়ুতে প্রথম মিড-ডে মিল চালু হয়। কেন্দ্র তাতে মুগ্ধ হয়ে বলল, আমি সারা দেশে চালু করব। সব রাজ্যকে টাকা ঢালতে হবে। এটা ঠিক নয়। যে সব কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘কমপারেটিভ অ্যাডভান্টেজ’ রয়েছে, সে সব কাজ কেন্দ্র অবশ্যই করবে। তার মানে এই নয় যে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ উন্নয়ন সবেতেই কেন্দ্রীয় সরকার নাক গলাবে।
প্র: কেন্দ্র কি রাজ্যের তুলনায় দক্ষতার সঙ্গে খরচ করে?
উ: সব রাজ্যকে এক মাপকাঠিতে ফেলা যাবে না। তবে রাজ্যকে আরও ধার করার ক্ষমতা দিতে হবে। রাজ্যের খরচের দায় বেশি। অথচ আয়ের উৎস খুবই সীমিত। রাজ্য ধার করে পরিকাঠামোয় ব্যয় করুক।
প্র: সরকার বলছে, রাজস্ব ব্যয় মানেই খারাপ নয়। স্কুলের বাড়ি তৈরির জন্য খরচ জরুরি হলে শিক্ষকদের বেতন দেওয়াটাও জরুরি।
উ: শিক্ষকদের বেতন কে দেয়? রাজ্য। কেন্দ্র প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল চালায় না। কেন্দ্রের কাজ প্রাথমিক স্কুল চালানো নয়। কেন্দ্রীয় সরকার বরং গবেষণা, উচ্চ শিক্ষায় টাকা ঢালুক।
প্র: রাজ্যের হাতে বেশি অর্থ তুলে দিতে তারা জনমোহিনী নীতি নিতে পারে। সেই শঙ্কা কি নেই?
উ: কেন্দ্র পপুলিজম করে না? ল্যাপটপ, গ্রাইন্ডার-মিক্সার বিলিকে প্রথমে পপুলিজম বলা হত। স্কুলে মিড-ডে মিলও এক সময় পপুলিজম ছিল। এন টি রাম রাও প্রথম অন্ধ্রে ২ টাকা কিলো দরে চাল বিলি শুরু করেন। তখন তা পপুলিজম ছিল। ৪০ বছর পর সেটাই গোটা দেশে খাদ্য সুরক্ষা আইন হল। কোনটা পপুলিজম, কোনটা নয়, সেটা বিচার করা খুব কঠিন। খোলা মনে বিষয়টা দেখা উচিত।
প্র: তা হলে সরকারি প্রকল্পের লক্ষ্য কিসের ভিত্তিতে ঠিক হবে?
উ: রাজ্যের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেই এক-এক রাজ্যে এক-এক সমস্যা। কেরলে উচ্চ রক্তচাপ, শুগার, হৃদরোগে বেশি মানুষ মারা যায়। উত্তরপ্রদেশে এখনও মশার কামড়, ছোঁয়াচে রোগেই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। অগ্রাধিকার তার ভিত্তিতে ঠিক হবে। আমরা গোটা ভারতকে জানি না। জানি বলে বড়াই করাও উচিত নয়। রাজ্যগুলিকে আরও আর্থিক স্বাধীনতা দিতে হবে। তা রাজ্যকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নীতি নির্ধারণে সাহায্য করবে।
আর্থিক উপদেষ্টা, চতুর্দশ অর্থ কমিশন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি’তে অধ্যাপক
সাক্ষাৎকার: প্রেমাংশু চৌধুরী