কেবল দুইটি পেশা আহ্বান করে জীবন উৎসর্গের, সেনাবাহিনী এবং সাংবাদিকতা— মৃত্যুর কয়েক দিন পূর্বে লিখিয়াছিলেন শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক লাসান্থা বিক্রমসিংহে। ঘাতকের গুলি তাঁহাকে হত্যা করিয়াছিল ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি। দশ বৎসর কাটিয়াছে, সাংবাদিকের সঙ্কট কাটে নাই। ২০১৮ সালে গোটা বিশ্বে প্রাণ হারাইয়াছেন চুরানব্বই জন সাংবাদিক। ভারতবাসীরও স্বস্তির অবকাশ নাই। সাংবাদিক হত্যার নিরিখে বিশ্বে এই দেশের স্থান পঞ্চম। আফগানিস্তান, মেক্সিকো, ইয়েমেন, সিরিয়ার পরেই ভারত। সিরিয়া এবং সোমালিয়ার মধ্যে ভারতের স্থান, ভাবিলে শিহরিত হইতে হয়। সাংবাদিকদের ওই আন্তর্জাতিক সংগঠনটির মতে, ভারত, পাকিস্তান এবং ফিলিপিন্সে সাংবাদিক হত্যার কারণ যুদ্ধ কিংবা সংগঠিত অপরাধচক্র নহে, স্বাধীন কণ্ঠের প্রতি রাষ্ট্রের অসহিষ্ণুতা। ২০১৭ সালে কর্নাটকে গৌরী লঙ্কেশ, ২০১৮ সালে কাশ্মীরে শুজাত বুখারির হত্যা নাগরিক সমাজকে আহত, আলোড়িত করিয়াছে। সাংবাদিকতা করিতে গিয়া অপর যাঁহারা প্রাণ হারাইয়াছেন, কারারুদ্ধ হইয়াছেন, কর্মস্থল হইতে বিতাড়িত হইয়াছেন, তাঁহারাও সমাজে এক সন্ত্রস্ত শূন্যতা রাখিয়া গিয়াছেন। স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারেই প্রোথিত গণতন্ত্রের শিকড়। তাহা দুর্বল করিবার কোনও চেষ্টাই বাকি নাই।
প্রতিবাদ হইয়াছে। সুপরিচিত বেশ কিছু সাংবাদিক অভিযোগ তুলিয়াছেন, সংবাদমাধ্যমের উপর নজরদারি করিতেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তিকে আঘাত লাগিতে পারে, সে সম্ভাবনা দেখা দিলেই সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করা হইতেছে। সতর্কবার্তা না মানিলে বয়কট, বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার, মিথ্যা মামলা, ভীতিপ্রদর্শন চলিতেছে। সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতেও নারাজ নেতা-মন্ত্রীরা। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ প্রায় সম্পূর্ণ করিলেন একটিও সাংবাদিক সম্মেলন না করিয়া। সংসদে প্রবেশকালে তিনি মস্তকে ভূমিস্পর্শ করিয়াছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন এড়াইতে ও প্রশ্নকর্তাকে চুপ করাইতে তাঁহার আগ্রহ দেখিয়া গণতন্ত্রের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা সম্পর্কে সংশয় জাগিতে বাধ্য। তাঁহার শাসনকালে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত ক্রমাগত পশ্চাতে সরিয়া, এখন মায়ানমারের নীচে স্থান পাইয়াছে।
মোদী সম্প্রতি বলিয়াছেন, ‘পদাতিক’ সাংবাদিকরা পরিশ্রমী, তাঁহাদের সহিত সংযোগ রাখা প্রয়োজন। দলীয় সতীর্থদের প্রতি ইহাই তাঁহার পরামর্শ। খবর সংগ্রহ করিবার কাজটি শ্রমসাধ্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করিবার কাজটি রাজনৈতিক দলের নহে। সাংবাদিক কোন প্রতিষ্ঠানের কোন পদে কাজ করেন, তাহা নেতা-কর্মীদের বিবেচনা করিবেন কেন? সাংবাদিক মাত্রই উত্তর পাইবার অধিকারী। যে সাংবাদিক সরকারি তথ্য কিংবা দলীয় অবস্থান জানিতে চাহিবেন, তাঁহাকেই জানাইতে হইবে। সমালোচিত হইবেন জানিয়াও নেতা-মন্ত্রীরা উত্তর দিবেন, গণতন্ত্রে ইহাই প্রত্যাশিত। এই বৎসর গুপ্ত আততায়ীর হাতে নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি লিখিয়াছিলেন, বিশ্বের সব স্বৈরাচারী যেন একই বিষাক্ত কূপের জল পান করিয়াছে। শাসকের পীড়নের অপেক্ষা বিশ্বের উদাসীনতাই খাশোগিকে বেশি অবসন্ন করিয়াছিল। বাক্স্বাধীনতা লইয়া ভাবিতে বসিলে এই অবসাদ অনুভব না করিয়া গতি নাই।