ভারতে মুসলমানরা কেমন আছেন এটা জানার জন্য নিয়োজিত রাজেন্দ্র সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের দশ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ২০১৬ সালে। গত দশ বছরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে, অন্যান্য কারণের সঙ্গে, এ রিপোর্টেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উন্নয়নের নানান সূচকে দেশে মুসলমানরা পিছিয়ে যে আছেন, রিপোর্টের এই তথ্যে বিস্ময়ের কিছু ছিল না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার তথ্য দেখে অনেকেই চমকে যান। তৎকালীন সরকার রিপোর্টের ফলাফল হজম করতে পারেনি, নিজেদের অকর্মণ্যতা ঢাকতে চেয়েছিল, এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে মুসলমানদের বাঁচানো হচ্ছে— এই বলে। দাঙ্গা ও দৈহিক হিংসার হাতে থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা রক্ষা পেলেও, রিপোর্ট থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা কেবল পিছিয়েই নয়, চরম অবহেলার শিকার। ২০১১’তে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করে, বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার-এর নেতৃত্বেই উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠিত হবে। তার পরে এ রাজ্যে নানান কমিটি গঠনের খবর শোনা গেলেও বিচারপতি সাচারের নেতৃত্বে কোনও কমিটি গঠনের খবর জানা যায়নি। যেটা জানা গেল তা হল, মুসলমান উন্নয়নে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ‘একশো ভাগ কাজই হয়ে গেছে’! এই পরিসরে সামগ্রিক আলোচনার অবকাশ নেই, কিন্তু সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের দশ বছর পর পশ্চিমবঙ্গে কেবল কর্মসংস্থানে, বিশেষত সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য সুযোগসুবিধাগুলোয় চোখ বোলালেই বোঝা যায়, একশো ভাগ কাজ হয়ে যাওয়ার দাবিটা মানা কতটা কঠিন।
সাচার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উচ্চপদে মুসলমানদের অংশগ্রহণ মাত্র ৪.৭ শতাংশ, এবং মোট সরকারি চাকরিতে মাত্র ২.১ শতাংশ। রাজ্য সরকারের ব্যুরো অব ইকনমিক ও স্ট্যাটিস্টিকস প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মচারীদের বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি তথ্যের উপর ভিত্তি করে ‘স্টাফ সেন্সাস’ তৈরি করে। বিগত দু’বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের হিসাব এতে পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারের মোট সাড়ে তিন লক্ষের কিছু বেশি কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ মুসলমান। গত দশ বছরে, সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণের শ্লথ গতির কাছে কচ্ছপও হার মানবে। এই গতিতে এগোলে, খুবই সহজ পাটিগণিতের হিসাবে, জনসংখ্যার নিরিখে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব সমতা-গুণাঙ্কে পৌঁছতে অন্তত ৬০ বছরেও বেশি সময় লাগবে। প্রসঙ্গত, ‘স্টাফ সেন্সাস’ থেকে জানা যায়, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সামগ্রিক ভাবে মাত্র ২০ শতাংশ মহিলা যুক্ত। সরকারি কাজে মুসলমান মহিলাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নগণ্য।
আর একটা মূল্যবান তথ্য দেখা যেতে পারে। কলকাতা শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কলকাতা পুলিশের, এখানে প্রায় আটাশ হাজার পুলিশ কর্মীর মধ্যে মুসলমান দশ শতাংশের নীচে (৯.৪৪)। ২০০৭-০৮ সালে করা তথ্য অধিকার আইন বলে জানতে পেরেছিলাম, প্রায় পঁচিশ হাজার পুলিশ কর্মীর মধ্যে মুসলমান মাত্র ৯.১৩ শতাংশ। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ছিল মাত্র ২২।
কলকাতা পুলিশের তথ্যে একটু মনোযোগ করলে দেখা যায়, উচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে, জয়েন্ট কমিশনার লেভেল-এ এক জন মাত্র মুসলমান পুলিশ অফিসার, কনস্টেবল ও সেপাই র্যাঙ্কে সংখ্যাটা বেশি— মুসলমানদের অনুপাত সামগ্রিক গড় দশ শতাংশের আশেপাশে। কলকাতা পুলিশে প্রশাসনিক কর্মীবর্গের মধ্যে মাত্র ৩.৪ শতাংশ মুসলমান। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সর্বোচ্চ দফতর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ডায়রেক্টরেটে প্রশাসনিক ১৩৭ কর্মীর মধ্যে মাত্র ৩ জন মুসলমান। অবশ্য ২০০৮ সাল থেকে কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেকটর, সার্জেন্ট, কনস্টেবল ও সেপাই, মহিলা কনস্টেবল ও ড্রাইভার প্রভৃতি পদে মুসলমান নিয়োগের হারে গত কয়েক বছরে কিছুটা অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে।
শহরের পুর প্রশাসনের ছবিটাও একই রকম। কলকাতা পুরসভায় মোট ২৭ হাজার কর্মীর মধ্যে ৪.৪৫ শতাংশ মুসলমান। এর মধ্যে মাত্র ৮০ জন গ্রুপ-এ কর্মী। গ্রুপ–সি’তে মুসলমান কর্মচারীদের উপস্থিতি তুলনায় বেশি। ২০০৭ সালে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, কলকাতা পুরসভার মোট কর্মচারীদের ৪.৪৭ শতাংশ মুসলমান।
একটা বিষয় পরিষ্কার। সামগ্রিক ভাবে সরকারি চাকরিতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বে লক্ষণীয় কোনও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সূচনা পূর্বতন সরকারের শাসনকালেই হয়েছিল, দেওয়ালের লিখন পড়তে পেরে তারা তড়িঘড়ি মুসলমানদের এক অংশকে ওবিসি ঘোষণা করে, যাতে তাঁরা সংরক্ষণের সুবিধা নিতে পারেন। বর্তমান সরকার এর সুবিধা ভোগ করছে। ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা সরকারি চাকরিতে কতখানি প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে পারবেন, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে।
সংগঠিত ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অকিঞ্চিৎকর উপস্থিতির অন্যতম কারণ উচ্চশিক্ষা চত্বরে মুসলমানদের লক্ষণীয় অনুপস্থিতি। শিক্ষালাভের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়লেও, সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা মুসলমান অল্পবয়সি চাকরি-প্রার্থীদের মধ্যে এখনও সুলভ নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৩-৪ শতাংশ মুসলমান। সরকারি চাকরিতে মুসলমান চাকরি-প্রার্থীদের যোগ্য করার জন্য নাম কা ওয়াস্তে কিছু শহর-কেন্দ্রিক সরকারি চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি, মুসলমান সমাজের মধ্য থেকে কিছু উৎসাহী মানুষ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য ছেলেমেয়েদের সাহায্য করছেন।
অবহেলার নজির দেখা যায় মানব উন্নয়নের জন্য প্রাপ্য ও ন্যায্য অধিকারের ক্ষেত্রেও। ২০১৪ সালে স্নাপ ও গাইডেন্স গিল্ড-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত পাবলিক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে মুসলমান ছাত্রছাত্রী ভর্তির হার ভাল, কিন্তু পরিকাঠামোগত অবস্থা নানা দিক থেকে নিদারুণ। যেমন, এক হাজার বা তার বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামের তিন শতাংশতে কোনও বিদ্যালয় নেই। মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকার বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র–শিক্ষকের অনুপাত (৩৭) রাজ্যের গড়ের (২৭)থেকে অনেকটা বেশি। মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে স্বাস্থ্য পরিষেবাও বেহাল: প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে ৩৫ শতাংশ গ্রামের মানুষকে অন্তত চার কিলোমিটার ও ১২ শতাংশ গ্রামের মানুষকে ৮ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সমীক্ষা-কৃত গ্রামের ৪৫ শতাংশ হাতের নাগালে আধুনিক চিকিৎসার অভাবে হাতুড়েদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে রাস্তার সম্পর্ক নিবিড়; সে ক্ষেত্রেও দেখি ১৮ শতাংশ গ্রামের রাস্তা কাঁচা, সাইকেল চালানোও কঠিন। গর্ভবতী মহিলার প্রসববেদনা এই রাস্তায় দ্বিগুণ হয়, তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতেই বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়, ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বাচ্চা জন্মানোর হার কম থাকে— স্বাস্থ্য আধিকারিকের সরল ব্যাখ্যা: ‘স্বাস্থ্য পরিষেবা নিতে মুসলমানদের তীব্র অনীহা আছে’!
সাচার রিপোর্টে মুসলমানদের নানান সামাজিক অর্থনৈতিক বঞ্চনার তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। মুসলমানরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে, সামাজিক ন্যায্যতার স্বাভাবিক তাগিদেই শিক্ষায় স্বাস্থ্যে কর্মনিয়োজনে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত সমস্যা ও বঞ্চনাগুলো দূর হবে। তথ্য ও বাস্তব সেই আশাকে সম্মান করেনি।
প্রতীচী ইনস্টিটিউট -এ কর্মরত