১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই শোভাবাজারে বিনয়কৃষ্ণ দেবের বাড়িতে ‘বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার’ নামে একটি সভা স্থাপিত হয়। এক দিকে ইংরেজি, অন্য দিকে সংস্কৃত সাহিত্যের সাহায্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও বিস্তার সাধন এই সভার উদ্দেশ্য ছিল। ১৩০১ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ সভাটি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’ নামে পুনর্গঠিত হয়। রমেশচন্দ্র দত্ত পরিষদের প্রথম সভাপতি, প্রথম দুই সহকারী সভাপতি নবীনচন্দ্র সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর প্রথম সম্পাদক এল লিওটার্ড। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে পরিষৎ ২৪৩/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে নিজস্ব ভবনে উঠে আসে। এ জন্য সাত কাঠা জমি দান করেছিলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। পরে তিনি এই ভবনের পিছনে আরও জমি দেন, যেখানে পরিষদের প্রথম সভাপতি রমেশচন্দ্র দত্তের স্মৃতিতে গড়ে তোলা হয় দোতলা ‘রমেশ ভবন’। কলকাতা পুরসভার অর্থানুকূল্যে পরিষৎ ভবনের আদিরূপ অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এটি পুরসভার ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকায় প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রায় ১২৫ বছর ছুঁতে চলেছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার এই স্বপ্নসম্ভব প্রতিষ্ঠানের সূচনাপর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু এর সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। গত শতাধিক বছরের বাঙালি মনীষার একটা বড় অংশই কোনও না কোনও ভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে পরিষদের নানামুখী উদ্যোগে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পঠনপাঠন শুরুর ক্ষেত্রে পরিষৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও ইতিহাস চর্চায় পরিষদের চেষ্টা আজ ইতিহাস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রমেশচন্দ্র দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রমুখের ব্যক্তিগত গ্রন্থসংগ্রহ সাহিত্য পরিষৎ গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে। উনিশ শতকের দুষ্প্রাপ্য বই ও পত্রপত্রিকার এত বড় সংগ্রহ আর কোথাও নেই। সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা ১৩০১ বঙ্গাব্দ থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, রামেন্দ্রসুন্দর, নবীনচন্দ্র প্রমুখের প্রামাণিক রচনাবলি ছাড়াও বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছে সাহিত্য পরিষৎ, যেমন, বৌদ্ধগান ও দোহা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদকল্পতরু, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস, বাংলা সাময়িকপত্র, ভারতকোষ, সাহিত্য সাধক চরিতমালা। ১৯০৮-এ নিজস্ব ভবন স্থাপিত হওয়ার পরই পরিষৎ সংগ্রহশালা পরিকল্পিত রূপ নিতে শুরু করে। প্রাচীন মুদ্রা, বাংলার পাল ও সেন যুগের পাথরের মূর্তি, ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, মন্দির টেরাকোটার গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহের সঙ্গে সংরক্ষিত হয়েছে মনীষীদের তৈলচিত্র, স্মৃতিচিহ্ন, পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র। সংগ্রহশালার শতবর্ষ উপলক্ষে রমেশ ভবনের তিনতলায় একটি নতুন প্রদর্শকক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এখানে পাথর, ধাতু ও পোড়ামাটির প্রাচীন নিদর্শনগুলির সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে নতুন দুটি অংশ। একটি বাংলার লোকায়ত শিল্প, অন্যটি বাঙালির দৈনন্দিনের শিল্প। এই নতুন প্রদর্শকক্ষ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই সংগ্রহশালাও কলকাতার অবশ্য দ্রষ্টব্য।