মনন কুমার রায়ের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি আইসিসিআর-এর বেঙ্গল আর্ট গ্যালারিতে। এক জন বরিষ্ঠ শিল্পী তিনি। সৃজনশীল চিত্রকলার ক্ষেত্রে এসেছেন ১৯৭০-এর দশকে। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছেন ১৯৭৫ সালে। ডিজাইনিং-এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু সৃজনশীল ছবির চর্চা ছাড়েননি। আলোচ্য প্রদর্শনীতে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর প্রায় সারা জীবনের কাজ। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘চেতনা, সাধনা, আত্মপ্রকাশ’। নানা বিষয় নিয়ে নানা আঙ্গিকে কাজ করেছেন। জীবনের বৈচিত্রে অবগাহন করেছেন প্রকাশভঙ্গির নানা ব্যাপ্তির মধ্য দিয়ে।
অনেক শিল্পী আছেন যাঁরা তাঁদের শিল্পীজীবনে কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর একটি বিশেষ রূপপদ্ধতিকে বেছে নেন তাঁদের প্রকাশভঙ্গি হিসেবে। এর মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব আইডেন্টিটি। প্রকাশের সেই বিশেষ ধরন থেকে তিনি আর বেরোতে পারেন না বা বেরোতে চান না। তাই অনেক শিল্পীকেই দেখা যায় সারাক্ষণই কেবল ‘গণেশ’ এঁকে যাচ্ছেন। কিন্তু ‘বৈচিত্র’ ব্য বহুমুখীনতার মধ্যেও যে ‘আইডেন্টিটি’ থেকে যায় বা রক্ষা করা যায়, তা আমরা পৃথিবীর বহু শ্রেষ্ঠ শিল্পীর ক্ষেত্রে দেখতে পাই। পিকাসো বা রামকিঙ্কর হতে পারেন এই বহুমুখীনতার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত।
মনন কুমার রায়ের ছবি দেখতে দেখতে এই কথাগুলো মনে হচ্ছিল, কেননা জীবনকে যেমন তিনি নানা দিক থেকে দেখেছেন ও উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছেন, তেমনই আঙ্গিক নিয়েও নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে তাঁর একান্ত আগ্রহ। স্বাভাবিকতাবাদী রীতিকে তিনি আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন আর্ট কলেজ জীবনে তাঁর অনুশীলন পর্বে। সে রকম ন্যুড-স্টাডি বা লাইফ-স্টাডির কিছু নমুনা এই প্রদর্শনীতে রয়েছে। দক্ষতার সঙ্গে মননকে তিনি মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকতায় এই সুদক্ষ অধিকারের জন্যই যখন তিনি রূপাবয়ব ভেঙেছেন, তা আলুলায়িত হয়ে যায়নি। ঐতিহ্যগত নব্য ভারতীয় ধারার আঙ্গিক নিয়েও তিনি কিছু কিছু ছবি করেছেন। লৌকিকের প্রতিফলনও এসেছে। এই সমন্বয় তাঁর ছবিতে বিশেষ এক অভিমুখ এনেছে যেখানে ১৯৪০-এর দশকের শিল্পকলার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়।
একটা পর্যায়ে প্রতিচ্ছায়াবাদী রীতির প্রতিফলন এসেছে তার ছবিতে। প্রতিচ্ছায়াবাদের সঙ্গে উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদের কিছু বৈশিষ্ট্যও তিনি মিলিয়ে নিয়েছেন। সে রকমই একটি ছবিতে দেখি ঊর্ধ্বাঙ্গে নগ্নিকা একটি মেয়ে মাথাটি একটু উঁচু করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানার উপরে। ডিম্বাকৃতি মুখের গঠনে মদিগলিয়ানির ছায়া প্রতিভাত হয়। সৌন্দর্যের এক বিষাদমগ্ন সদর্থকতাকেই পরিস্ফুট করতে চান শিল্পী। এরই পাশাপাশি তিনি আঁকেন আর একটি নারীমুখাবয়বের পার্শ্বচিত্র। নাক ও মুখের গঠনে বলিষ্ঠ কৌণিকতা প্রাধান্য পায়। আয়ত চোখটি চোখের স্বাভাবিকতা অতিক্রম করে আদিমতা থেকে নিয়ে আসে এক ধরনের তন্ময়তা, যে ভাঙনকে পিকাসোর ঘরানার বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। অবয়বের সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দেন অলঙ্করণের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য। একটি ফুল ফুটে থাকে মেয়েটির কাঁধের কাছে, হাতেও ধরা থাকে প্রস্ফুটিত ফুলের একটি দীর্ঘ বৃন্ত। চারপাশের পরিবৃত সৌন্দর্যের মধ্যেও মানবীর অন্তরের এক হতাশা ধ্বনিত হয়। জীবনের জটিলতার গহনে প্রবেশ করেন শিল্পী। অলঙ্করণ নিয়েই খেলতে পারেন কোথাও কোথাও। একটি নারীর মুখ। রৈখিকভাবে আঁকা। মাটির ভিতরে বা উপরে গাছের শিকড় যেমন ছড়িয়ে যায় তেমনি ছড়ানো শিকড় বা ডালপালার বিন্যাসে গড়ে ওঠে মানবীর মুখ। আর্ট-নুভিউ বা বাউহাউজ আন্দোলন অলঙ্করণ শিল্পের সম্ভাবনাকে যেভাবে সৃজনাত্মক শিল্পে উন্নীত করার চেষ্টা করেছে, তারই বিদগ্ধ চর্চার প্রয়াস থাকে এখানে।
একটা পর্যায়ে শিল্পী পরিপূর্ণ ভাবে অভিব্যক্তিবাদী আঙ্গিকের দিকে চলে যান। অবয়বকে ভাঙেন। তার ভিতর থেকে অন্তর্লীন তমিস্রাকে বের করে আনেন। যে তমসায় পরিবৃত হয়ে আছে আজকের জীবন, তারই গভীরে প্রবেশ করেন শিল্পী। সে রকমই একটি ছবিতে দেখি, কয়েক জন নগ্নিকা দাঁড়িয়ে থাকে পরস্পরে সংশ্লিষ্ট হয়ে। বাইরের বিশ্ব থেকে যেন তাঁরা আড়াল করতে চাইছে নিজেদের। এরকমই বৈচিত্রে, বহুমুখীনতায় শিল্পী জীবনকে দেখেছেন, রূপ দিয়েছেন। এ সবের ভিতর থেকে তাঁর নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তা নয়।