পুস্তক পরিচয় ১

শেষ পর্যন্ত খুঁজে নেন শিল্পের প্রশান্তি

প্রকাশ দাসের সম্পাদনায় রামকিঙ্কর আর চিত্তপ্রসাদের শিল্পকর্মের ওপর অসামান্য বই দুটোর পর যে-প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তারই যেন পুনরপি সার্থকতা টের পাওয়া যায় তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশোন্মুখ গণেশ হালুই-এর জীবন ও চিত্র বিষয়ক অ্যালবাম-সদৃশ বইটি হাতে নিয়ে। চিত্রকর গণেশ হালুইয়ের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অনেক আলোচনাই হয়েছে, তাঁর ছবির প্রদর্শনী বার বার আকৃষ্ট করেছে দর্শকদের, কিন্তু বড় একটি বইতে একসঙ্গে তাঁর জীবনের তথ্যসম্ভার, তাঁর চিত্রবৈশিষ্ট্য ও চিত্রভাবনা, তাঁর অজস্র চিত্র-অনুলিপির সমন্বয় বোধহয় এই প্রথম।

Advertisement

অরুণ সেন

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

প্রকাশ দাসের সম্পাদনায় রামকিঙ্কর আর চিত্তপ্রসাদের শিল্পকর্মের ওপর অসামান্য বই দুটোর পর যে-প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তারই যেন পুনরপি সার্থকতা টের পাওয়া যায় তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশোন্মুখ গণেশ হালুই-এর জীবন ও চিত্র বিষয়ক অ্যালবাম-সদৃশ বইটি হাতে নিয়ে।

Advertisement

চিত্রকর গণেশ হালুইয়ের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অনেক আলোচনাই হয়েছে, তাঁর ছবির প্রদর্শনী বার বার আকৃষ্ট করেছে দর্শকদের, কিন্তু বড় একটি বইতে একসঙ্গে তাঁর জীবনের তথ্যসম্ভার, তাঁর চিত্রবৈশিষ্ট্য ও চিত্রভাবনা, তাঁর অজস্র চিত্র-অনুলিপির সমন্বয় বোধহয় এই প্রথম। সেখানে শিল্পীর নিজের লেখা, বন্ধু-সহযাত্রীদের ও শিল্পবিশেষজ্ঞদের লেখা তীক্ষ্ণ বিবেচনায় জড়ো করেছেন সম্পাদক। গণেশ হালুইয়ের নিজের রচনা বলতে নির্বাচিত গদ্যের সঙ্গে তাঁর ডায়েরির বেশ কিছু নির্বাচিত অংশ (বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা কবিতা ও চিত্রকলা সম্পর্কে টুকরো মত-মন্তব্য সহ) আর চারটি সাক্ষাত্‌কার। সঙ্গে তাঁকে লেখা কয়েকটি চিঠি আর শেষে জীবনপঞ্জি, লেখক-পরিচিতি, নির্দেশিকা।

‘চিত্রকর গণেশ হালুই’ শিরোনামে প্রকাশ দাস যে নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয় ‘পূর্বকথা’ লিখেছেন, তাতেই চুম্বকের মতো ধরা পড়ে সমকালীন শিল্পজগতের স্বনামধন্য ও ব্যতিক্রমী এই শিল্পীর জন্মের পরিবেশ থেকে তাঁর বেড়ে ওঠার ইতিহাস, তাঁর নিজস্ব ধরনের বহুমুখিতা ও কেন্দ্রীয়তার স্বরূপ— শিল্পীর নিজের ও অন্যের নানা লেখায়, এবং সম্পাদকের নিপুণ সারাত্‌সারে। বইটির পরিকল্পনায় ও গঠনে সমভিব্যাহারের এই লক্ষ্য ভূমিকায় স্পষ্ট।

Advertisement

শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর চিত্রকর্ম ও চিত্রভাবনা এবং তার রূপান্তর ও প্রগতির কয়েকটি কালপর্ব এ সব লেখালিখিতে বেরিয়ে আসে। প্রথমেই ব্রহ্মপুত্রের ধারে, ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরে জন্ম, বাল্য ও শৈশব, নদীপাড়ের নিসর্গকে চেনা, এমনকী সেখানকার বিদ্যালয়েই প্রাথমিক শিল্পচর্চা শুরু। দ্বিতীয়ত, ১৯৫০-এ দেশত্যাগ, ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী-শিবিরে চরম দুঃস্থতার মধ্যেও ছবি আঁকার স্বপ্নকে জিইয়ে রাখা। তৃতীয়ত, ১৯৫১-য় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ঠিকানা থেকে মায়ের গয়না বিক্রির টাকা সম্বল করে সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তির মতো অসম্ভব ঘটনা। নিতান্ত অনিচ্ছায় পাকেচক্রে ‘কমার্শিয়াল আর্ট’ বিভাগে ভর্তি হতে হল ঠিকই, এবং মাখন দত্তগুপ্তের মতো শিক্ষক পেলেও, পাশাপাশি কিন্তু নজর ছিল পাশ্চাত্য ও ভারতীয় চিত্রকলার দিকেও। ছাত্রজীবনেই স্বচ্ছ জলরঙের নৈপুণ্য চোখে পড়ে, যা এর শেষ পর্বে (১৯৫৫-৫৬) তাঁকে একের পর এক পুরস্কার এনে দেয়। চতুর্থত, কর্মজীবনে এসে বিরাট এক পরিবর্তন— তাঁর শিল্পীজীবনের বলা যায় ‘টার্নিং পয়েন্ট’।

ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে অজিণ্ঠার গুহাচিত্রের প্রতিলিপি করার চাকরি নেন গণেশ হালুই। ১৯৫৭-’৬২ তিনি নিষ্ঠাভরে এই কাজ করেন। অজিণ্ঠার চিত্রকলা বিষয়ে গভীর অনুধ্যান, পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, তার গঠন ও কৃত্‌কৌশলের উদ্‌ঘাটন— সর্বতো ভাবেই আলোড়িত হয়েছিলেন তিনি। সেই সব তথ্য, জ্ঞান ও নন্দনদৃষ্টিকে তিনি বৃহত্‌ একটি অবয়বে রূপ দিয়ে রেখেছেন, সেই বড় কাজটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায়। গণেশ হালুই তখন অজিণ্ঠা গুহার কাছাকাছি অজিণ্ঠা গ্রামে বাস করতেন, এবং সেখানকার পরিচিত প্রকৃতি ও মানুষের ছবিও এঁকেছেন। পরে যখন ফিরে আসেন তিনি নিজের জায়গায়, যুক্ত হন শিল্প মহাবিদ্যালয়ের মিউরাল বিষয়ের শিক্ষকতায়, পুরোদমে শুরু করেন চিত্রাঙ্কন— তখন অজিণ্ঠার গুহা এবং গ্রামীণ জীবনের ছাপ পড়ে তাঁর নতুন এই শিল্পসৃজনে। বস্তুত সেই বিকাশের কথা মাথায় রেখেই প্রকাশ দাস বলেন, ‘অজন্তা গুহাচিত্রের আদল প্রতিফলিত হয়েছে সেসব চিত্রকলায়’। প্রসঙ্গত দুটি ছবির উল্লেখ করেছেন প্রকাশ। ১৯৬০-এ অস্বচ্ছ জলরঙে আঁকা ‘চুমনি’ নামের ছবি, যেখানে খাটিয়ার ওপরে বসে থাকা এক নিষ্পাপ বালিকা-- ‘করুণাঘন মুখমণ্ডলে অপার বিস্ময় নিয়ে জেগে আছে তার দুটি আঁখি’, কিংবা সে রকমই খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে বালিকা। আরও অজস্র ছবিতেই এই অজিণ্ঠা-পর্বের ছোঁয়া এবং তাতে অন্তর্লীন লিরিকের প্রকাশ্যতা।

ক্রমশই যেন এই সময় থেকে আবার তাঁর ছবির নিসর্গে ও অবয়বে ঘটতে থাকে বিমূর্ততায় রূপান্তর। ল্যান্ডস্কেপের পুরনো দৃশ্যগ্রাহ্যতা ছেড়ে এবার তিনি চলে যান আংশিক অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপায়ণে। বস্তুত, ষাটের দশকের শেষ থেকেই তাঁর জ্যামিতিক বা বিমূর্তকেন্দ্রিক পরবর্তী চিত্রের বিস্তার। সত্তর দশকের গোড়ায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শুরু— তেলরঙে আঁকা চিত্রমালা ‘সুবর্ণরেখা’। এই চিত্রমালাকে, প্রকাশ বলেন, ‘ঘিরে উঠে আসবে নিয়তিতাড়িত আবহমান বাংলা, ভারতবর্ষ’— ‘জীবনের অনন্তে মিশে যাওয়ার এবং জীবনের অনন্ত পারাপারে নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি’। এই ভাবেই গণেশ হালুইয়ের ছবিতে ‘নিঃসঙ্গতার একাকিত্বের স্পর্শ’, ‘অসীমের দ্যোতনা’। সত্তরের দশকের ছবিতে তেলরঙ বা গুয়াশ মাধ্যমে উঠে আসে কিছু প্রতিকৃতি, তবে প্রধানত নিসর্গদৃশ্য। আশি বা নব্বই দশকে তাঁর চিত্রকলা বোধহয় আরও জ্যামিতিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে, হয়ে ওঠে ‘সাংকেতিক আর প্রতীক চিত্রকল্পময়’। প্রকাশের ভাষায়, ‘জ্যামিতির হাত ধরে কোলাহলহীন বিষাদমিশ্রিত এক মুখর নির্জনতা’। গণেশের চিত্রভাষায় বিমূর্ততার উত্‌স সম্ভবত সেখানেই।

এই বইয়ের পরিকল্পনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিনটি অংশ: ‘গণেশ হালুইয়ের নির্বাচিত রচনা’, ‘সঙ্গ-অনুষঙ্গ: গণেশ হালুই’ এবং ‘গণেশ হালুই ও তাঁর শিল্পকলা: নির্বাচিত রচনা’। শিল্পীর স্বলিখিত ও নির্বাচিত ১৫টি গদ্যের মধ্যে পরিসরে সবচেয়ে বড় তাঁর আত্মজৈবনিক ‘আমার কথা’। তাতে পরিবার পরিজন পরিপার্শ্ব, ১৯৩৬-এর জামালপুর থেকে ২০১১-র কলকাতা পর্যন্ত। বিশেষ করে অনেকেই পড়েছেন ‘দেশহারা ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবন’। এর পরিশিষ্ট হিসেবে যে অজস্র প্রতিলিপি সংযুক্ত হয়েছে, সেখানেও গণেশ হালুইয়ের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের প্রকরণবৈচিত্রের সাক্ষ্য মেলে— স্বচ্ছ জলরঙ, রঙিন পেনসিল, বিভিন্ন জাতের কাগজে ওয়াশ, কালি-কলম-তুলি, তেলরঙ, ওয়াশের ওপর তেলরঙ, এগ-টেম্পেরা, নেপালি কাগজে সংখ্যাতীত ওয়াশ, ইত্যাদি। এ ছাড়াও বিশেষ ভাবে গ্রাহ্য ‘অজন্তা চিত্রকলা: নির্মাণ ও করণকৌশল’ নামের ব্যাকরণসিদ্ধ লেখাটিও। ছোট প্রবন্ধ অনেক, সেখানেও তাঁর শিল্পভাবনার অকাট্য পরিচয়— কোনওটা দার্শনিক-নান্দনিক (‘ছবিতে পরিপূর্ণতা’, ‘শিল্প আর সত্য’), কোনও-কোনওটা তাঁর আগে-পরের শিল্পী বিষয়ক (‘যামিনী রায়, ‘জয়নুল আবেদিন’) কিংবা চিত্রভাষা বা প্রকরণ (‘বর্ণ’, ‘টেম্পেরা’)।

‘সঙ্গ-অনুষঙ্গ: গণেশ হালুই’ অংশটি মূলত স্মৃতিমূলক। জামালপুরের বাল্যবন্ধু, আর্ট কলেজের সহপাঠী বন্ধু, ‘মাস্টারমশাই’ সম্পর্কে বিভিন্ন পর্বের ছাত্র, অনুজ শিল্পীবন্ধু— সকলের কথাই পাই সেখানে তাঁদের মর্মস্পর্শী ভাষায়। বিপিন গোস্বামী, সনত্‌ কর, ঈশা মহম্মদ, প্রশান্ত কোলে এবং আরও অনেকে। আশিস ঘোষের লেখায় রাজস্থানের বনস্থলী বিদ্যাপীঠের শিল্পশিবিরের অভিজ্ঞতা। যোগেন চৌধুরীর ‘মানুষ ও শিল্পী গণেশ হালুই’-তে মানুষ হিসেবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন যেমন আছে, তেমনই আছে গণেশ হালুইয়ের শিল্প-অনুভব সম্পর্কে অকুণ্ঠ তারিফ। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু এই দু’জনের মধ্যেই শিল্পচর্চার প্রথম পদক্ষেপের মিলের কথা ওঠে অনেকের মনে। সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন যোগেন, ‘এর পর দীর্ঘ দিন গণেশদার ছবি সেমি-অ্যাবস্ট্রাক্ট অর্থাত্‌ আধা-বিমূর্ত, যার বিষয়বস্তু প্রকৃতি, ভূমি এবং কখনও কখনও স্থাপত্যকেন্দ্রিক’। আর তাঁর শিল্পকলা প্রসঙ্গে যাঁরা নানা সময়ে আলোচনা করেছেন তা থেকে অনেকটাই সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তার পরিধিও বেশ বড় — শিবনারায়ণ রায় থেকে শুরু করে হিরণ মিত্র, অরুণ ঘোষ, মৃণাল ঘোষ, সমীর ঘোষ প্রমুখ। প্রত্যেকের লেখাতেই এসেছে আধুনিক ভারতীয় ভিন্নধর্মী বিমূর্ততা কী ভাবে গণেশ হালুইয়ে রূপ পেয়েছে।

লক্ষণীয়, শিল্পীর নান্দনিক অন্বিষ্টের একটা নির্দিষ্টতা থাকলেও (জলরঙ বা গুয়াশে নিসর্গ), তা পরিবর্তনশীল— সব সময়ই নতুনের অভিলাষী, ঢেলে সাজার পক্ষপাতী। যেখানে শেষ সেখানেই পুনরারম্ভ। তিনি মনে করেন, ল্যান্ডস্কেপই তাঁর সর্বস্ব।

দেশভাগের বেদনা থেকে তাঁর শিল্পীজীবনের নানা সংকট, কিন্তু এ ভাবেই তিনি শেষ পর্যন্ত খুঁজে নেন শিল্পের প্রশান্তি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement