শরীর সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণা আছে মানুষের। যার অনেকটাই শোনা-কথা মাত্র, নেই কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। ব্যবহারিক জীবনের এমন অনেক ভ্রান্ত ধারণা ডেকে আনতে পারে নানা বিপর্যয়। একটু সচেতন হলেই কিন্তু এগুলি আটকানো যায়। তা ছাড়া অসুখবিসুখ বিষয়ে সাধারণের ধারণা সীমিত। সেগুলি নিয়ে গভীর ভাবে জানার অবকাশও কম। শরীর ও অসুখ বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা গড়তেই এসেছে বেশ কয়েকটি বই। যেমন বয়সকালে অবসাদ নিদারুণ একটি সমস্যা। এটা যে মানসিক অসুস্থতা, সেটা অনেকেই জানেন না। তাই চিকিত্সাও হয় না। এ দিকে অবসাদ ভেতরে ভেতরে তৈরি করে চলে নানা শারীরিক জটিলতা। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন, কেউ কেউ করেও বসেন। জীবনের বিকেলবেলার এই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন চিকিত্সক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বয়সকালে মনের অসুখ (পরম্পরা, ১২৫.০০) বইটিতে। কী ভাবে চিনবেন অবসাদ, চিকিত্সাই বা কী, প্রথাগত চিকিত্সার পাশাপাশি কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, ইন্টারপার্সোনাল থেরাপির মতো চিকিত্সা পদ্ধতি— বিভিন্ন বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ডিমেনশিয়া, ফোবিয়া, বেশি বয়সের শোকের অভিঘাত— বয়স্কদের অন্য নানা মানসিক সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করেছে বইটি।
রোজকার জীবনে সামান্য কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকলে অনেক বড় বড় অসুখ রুখে দেওয়া যায়। যেমন কীটনাশক দেওয়া তরিতরকারি থেকে হতে পারে নানা দীর্ঘমেয়াদি বিপত্তি। সবজি আধ ঘণ্টা নুন জলে ভিজিয়ে রাখার পর রানিং ওয়াটারে ধুলে কীটনাশকের প্রভাব কমে। তবে খাদ্যগুণ বজায় রাখতে সবজি ধুয়ে কাটবেন, কেটে ধোবেন না। এমনই জানা-অজানা তথ্যকে চিকিত্সক শ্যামল চক্রবর্তী একত্র করেছেন রোগ প্রতিরোধ সবার আগে (আনন্দ, ২০০.০০) বইটিতে। কী ভাবে পেটের অসুখ কমবে, কম খরচে অপুষ্টি আটকানোর উপায় কী, এই সব প্রশ্ন থেকে শুরু করে আলোচনা করেছেন ব্রেস্ট বা সার্ভাইকাল ক্যানসার আটকাতে কী করবেন সে সম্বন্ধেও। মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িতে মনোরোগী বা আত্মহত্যাপ্রবণ কেউ থাকলে কী করণীয়, সে সম্বন্ধে। অনেকটাই গল্পের ছলে লেখা। তবে তথ্য পরিবেশনে আরও একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এ-বেলার বেঁচে যাওয়া ভাতের সঙ্গে ও-বেলার চাল মিশিয়ে ফুটিয়ে খেলেই যে ব্যাসিলাস সেরিয়াস-এর সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে বলা হয়েছে, তা ঠিক নয়। অতিরিক্ত ভাত বেশি নাড়াঘাঁটা করলে, ঠিক মতো সংরক্ষণ না করলে বা তাপমাত্রার বেশি হেরফের হলেই এমনটা হতে পারে। তবে অনেক সময়েই অসতর্কতা বা অজ্ঞানতার ফলে নানা কঠিন অসুখ ডেকে আনা হয়। সে হিসেবে বইটি প্রয়োজনীয়।
প্রায় কাছাকাছি বিষয়ের আরও একটি বই স্বাস্থ্যের স্বাধীনতা (পুনশ্চ, ১২৫.০০)। শরীর ও চিকিত্সা সংক্রান্ত নানা গতানুগতিক ভুল ধারণাকে তুলে ধরেছেন চিকিত্সক সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। স্বাস্থ্যকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে এই প্রয়াস। যেমন চলতি ধারণা, উপোসে শারীরিক দুর্বলতা বাড়ে। নিয়ন্ত্রিত উপোস কিন্তু আসলে উপকারী। দেখা গেছে পাঁচ-ছয় দিন উপোসে রাখার পর ইঁদুরের অন্ত্রের কোষের পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বাড়ে। যকৃতের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাময় কোষও উপোসকালে মরে যায়। কোষের অতিরিক্ত বিভাজনের প্রবণতা কমার ফলে ক্যানসারের সম্ভাবনা কমে। এমন নানা ভুল ধারণা নিয়ে আলোচনা রয়েছে বইটিতে। আছে ব্যবহারিক জীবনের নানা অজানা তথ্যও। খেসারির ডালের এক ধরনের পদার্থ স্নায়ুর ক্ষতি করে। যার ফলে প্রথমে হাঁটা-চলায় অসংলগ্নতা থেকে পরে পঙ্গুত্ব পর্যন্ত আসতে পারে। কিন্তু খাওয়ার আগে ডালকে ভাল করে সেদ্ধ করে ছেঁকে নিলে বা রাতে ডাল চুনজলে ভিজিয়ে রাখলে বিষাক্ত পদার্থটি বেরিয়ে যায়। মিষ্টি ও কৃমি, হলুদের ফাঁদে ন্যাবা, বাজিতে হাত পোড়া, আয়োডিনের অভাবে কী হবে— এমন নানা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা মেলে। বেশ কিছু ভুল ধারণা শুধরে নিতে পারবেন পাঠক।
এ প্রজন্মের জন্য সুব্রতা সরকার লিখেছেন উনিশ-বিশের সমস্যা (প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০.০০)। বয়ঃসন্ধিতে নানা কৌতূহল ছেলেমেয়েদের মনে গিজগিজ করে। উত্তর না পেয়ে তারা অনেক সময় নানান ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করে বসে। হয়ে যায় ভুল। বিশেষত ভিন্ন লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ এবং উত্তেজনার মুহূর্তে পা পিছলে গেলে। এদের সামলাতে অভিভাবকরাও বিপন্ন বোধ করেন। অথচ ঠিক মতো যৌনশিক্ষা না থাকায় এমনতর ভুল বয়ঃসন্ধিতে হামেশাই হয়ে থাকে। বয়ঃসন্ধির যৌনতা, মানসিক স্বাস্থ্য আর জীবনযাপন তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। তবে এই প্রজন্মের কথা ভেবে বইটির পরিবেশন শৈলী আরও একটু প্রাঞ্জল হলে ভাল হত।
হঠাত্ খেয়াল করলেন বাচ্চা ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না বা কানে শুনতে পাচ্ছে না। বৃদ্ধিও ঠিক মতো হচ্ছে না। বেশি রকম চঞ্চল, হঠাত্ রেগে উঠছে। সব মিলিয়ে সুস্থ বাচ্চার থেকে আলাদা। অনেক ক্ষেত্রে এগুলি অটিজ্ম-এর লক্ষণ। বাচ্চা ‘অটিস্টিক’ তকমা পেলে অনেক বাবা-মা’ই চোখে অন্ধকার দেখেন। সমস্যাটি নিয়েই সব্যসাচী পড়ুয়ার বই অটিজম (পারুল, ১০০.০০)। অটিস্টিকরা পাগল নয়। জিনের গণ্ডগোলেই এমনটা হয়। স্বাভাবিক শিশু মনোজগত্ আর বহির্জগতের সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারে, অটিস্টিকদের সেখানেই সমস্যা। ওরা নিজেদের জগতে মগ্ন থাকে। ওদের মনের কাছাকাছি পৌঁছনোর হদিশ রয়েছে বইটিতে। সঙ্গে আচরণগত সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ। অটিজম নিয়ে সচেতনতা গড়তে এ ধরনের বই মূল্যবান।