গত শতকে যদুনাথ সরকারের ইচ্ছে ছিল যে আওরঙ্গজেবের জীবনীর পাশাপাশি আকবরের আমলের ভারতের বৃত্তান্ত তিনি লিখবেন, তবেই যেন মোগল জীবন সন্ধ্যা ও মোগল জীবন প্রভাতের তুলনাটি ভারতের জাতীয় ইতিহাসে ‘মোগল-ই-আজম’-এর তাত্পর্যকে স্পষ্ট করে তুলবে। পরিকল্পনাটি রূপায়িত করতে তিনি পারেননি। কিন্তু কোনও বেতার বক্তৃতায় তিনি এক স্বপ্নযুগের কথা জানিয়েছিলেন। ষোড়শ শতকের কোনও এক সময়ে আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের বৈঠকে খবরনবিশ রূপে তিনি আমন্ত্রিত হন, কারণ সম্রাটের জীবনী আকবর নামা আর শাসনব্যবস্থার প্রামাণিক বিবরণ আইন-ই-আকবরি লিখতে আবুল ফজল ব্যস্ত। সারা দেশ জুড়ে নানা লোকের কাছে তিনি খবর জোগাড় করছেন, রাশি রাশি দলিল ও পুরনো ইতিবৃত্ত পড়ে শেষ করছেন। বাঙালি কায়স্থ সরকার মহাশয় হিন্দুস্থানি ও সংস্কৃত ভাষার মিশেলে সুবে বাংলার হাল হকিকত বর্ণনা করলেন, আবুল ফজল নিজের হাতে ফার্সিতে সংক্ষিপ্তসার লিখলেন, ইতিহাস লিখতে তাঁর কাজে লাগবে। স্বপ্ন মঙ্গলে ষোড়শ শতকের আকবর নামা-তে বিশ শতকের প্রমুখ ভারতীয় ঐতিহাসিক আপন ছোঁয়াটি কোথাও যেন উপলব্ধি করছেন, সাড়ে তিনশো বছরের উজানে সান্নিধ্যের এই স্বীকৃতিই তো একটি গ্রন্থকে চিরায়ত করে তোলে।
সম্রাট আকবর নদী পার হচ্ছেন।
আকবর নামা-র চিত্র।
এ হেন আকবর নামা-র নানা পাণ্ডুলিপি আছে, কলকাতা, লখনউ ও তেহরান থেকে একাধিক খণ্ডে মুদ্রিত, সাবেকি ইংরেজি ভাষান্তরটিও কয়েক বার ছাপা হয়েছে। তবু নাড়াচাড়া করলেই বোঝা যায় যে মূর্তি ক্ল্যাসিকাল লাইব্রেরি সিরিজে সদ্য প্রকাশিত আকবর নামা-র প্রথম খণ্ডের দ্বিভাষিক সংস্করণটি বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গে নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সাবেকি ধরনের সংস্করণে মূল ও অনুবাদ স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে মুদ্রিত, সবগুলিই আকারে ঢাউস। এই নব কলেবরে আকবর নামা-র রূপ হল ডিমাই সাইজের পেপারব্যাক, বাঁ দিকের পাতায় সুন্দর ‘নস্খ’ লিপিতে মূল ফার্সি পাঠটি ছাপা, ডান দিকের পাতায় মূলের অনুচ্ছেদের বিন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ইংরেজি অনুবাদটি ছাপানো। ফার্সি বর্ণমালায় সড়গড় যে কোনও পাঠক এক নজরে মূলের সঙ্গে মিলিয়ে ভাষান্তরটি পড়তে পারেন, আলাদা ভাবে তর্জমা পড়তেও ফার্সি ভাষায় অনভিজ্ঞ ইংরেজিনবিশ পাঠকের অসুবিধা হবে না। দামটিও মধ্যবিত্ত ভারতীয় পাঠকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।
আকবর নামা দুরূহ গ্রন্থ, গ্রন্থটির প্রথম দফতর বা খণ্ডটি আবার সবচেয়ে কম আলোচিত। সাবেকি সংস্করণের অনুবাদক হেনরি বেভারিজের পাণ্ডিত্য ও পরিশ্রমক্ষমতা অনস্বীকার্য। তিনি জানিয়েছিলেন যে আবুল ফজলের লেখা তাঁর একেবারে না-পসন্দ, ভাষা বাগাড়ম্বর সর্বস্ব, ক্লান্তিকর, অহেতুক ফেনানো। আকবরের রাজস্ব ও শাসনের বিবরণ লেখার ভার তাঁর উপরে ছিল, তথ্যের ভাণ্ডারী তিনি, পরিশ্রমও করতেন, তবে ভীষণ খোশামুদে, তাঁর ইতিহাসটি সেরেফ রাজপ্রশস্তিতে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রাচ্যের সাহিত্য স্বভাব তো অত সহজে যাওয়ার নয়। অন্তরঙ্গ পাঠের রুচি বিচারে আধুনিক অনুবাদক হুইলার থাকস্টন পূর্বসূরির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন, ফলে নতুন অনুবাদের মেজাজেও রকমফের ধরা পড়ে।
প্রথম খণ্ডের শুরুতেই আবুল ফজল আকবরের মতো বাদশাহের জীবনী লেখার দায় ও স্বাতন্ত্র্য বিচার করেছেন। তার পরেই বিশদ করে সম্রাটের ঠিকুজি-কোষ্ঠী বিচার করেছেন, ভাবী ইতিহাসের মর্ম ও তাত্পর্য তো জ্যোতিষশাস্ত্রে নিহিত থাকে। ক্রমানুসারে আদম থেকে শুরু করে তিমুরকে ছঁুয়ে বাবর ও হুমায়ুন পর্যন্ত আকবরের কুরসিনামা, ভারতে আকবরের বাপ-পিতামহের ইতিবৃত্ত, আকবরের জন্মসংবাদ প্রথম খণ্ডের উপজীব্য, শিশু আকবরের একটি অলৌকিক কেরামতের কাহিনিতে প্রথম দফতর শেষ হয়েছে।
একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় অনুবাদক-সম্পাদক থাকস্টন এই বিরস খণ্ডটিকে নতুন ভাবে পড়তে সাহায্য করেছেন, আকবরের জীবনীর নিহিত তাত্পর্য আবুল ফজল কী ভাবে ভেবেছিলেন, সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রের হিসেব অনুযায়ী দুটি শুভ গ্রহের সন্নিবেশের ক্ষণে আকবরের জন্ম, তিনি আলোকপুরুষ, তাঁর জ্যোতিতে সারা পৃথিবী আলোকিত। আবুল ফজলের কাছে আকবর নামা নিছক এক সফল পাদশাহের জীবনী বা তাঁর আইন-ই-আকবরি এক দক্ষ শাসনতন্ত্রের খতিয়ানমাত্র নয়, বরং ‘ইনসানে কামিল’ বা পরম পুরুষের মাহাত্ম্যগাথা, এক যুগন্ধর ও যুগত্রাতার কর্মজীবন। শুভ গ্রহের দুর্লভ রাজযোটকে আকবরের অবয়বে, ব্যক্তিত্বে ও চরিত্রে যাবতীয় আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক রূপ, গুণ ও ক্ষমতার সমাবেশ হয়েছিল, সেই প্রত্যেকটির পূর্ণ বিকাশের বিবরণ লেখাটাই তো মহান ইতিহাস। এই মহত্ত্বের ইতিবৃত্তকে যথাযথ ভাষায় প্রকাশ করতে নকশবন্দি সুফি শব্দাবলির ব্যঞ্জনা, শিয়া ইমামি তত্ত্বের অনুষঙ্গ ও ফিরদৌসির ইরানীয় মহাকাব্য শাহনামা-য় উল্লিখিত নায়কদের প্রসঙ্গ নানা রূপকল্প ও শব্দবন্ধে আবুল ফজল তাঁর রচনায় বার বার ছুঁয়ে গেছেন। আবুল ফজলের শৈলী বিষয়ানুগত, তাঁর ইতিহাসভাবনার সঙ্গে মানানসই। এই তাত্ত্বিক বিচারটাই থাকস্টনের অনুবাদের অভিমুখকে নির্ধারিত করেছে। পূর্বতন অনুবাদক বেভারিজের বৌদ্ধিক বিতৃষ্ণাকে অতিক্রম করে সহমর্মী রূপে তিনি এক মধ্যযুগীয় দরবারি ঐতিহাসিককে আধুনিক পাঠকের কাছে নতুন ভাবে পেশ করেছেন।
দ্য হিস্টরি অব আকবর,
আবুল ফজল। খণ্ড ১।
সম্পাদনা ও অনুবাদ: হুইলার এম থাকস্টন।
মূর্তি ক্লাসিকাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়া,
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৩৯৫.০০
অনুবাদটির অন্যতম সম্পদ ভেবেচিন্তে বাছাই করা সংহত ও সংক্ষিপ্ত টীকাটিপ্পনিগুলি। ক্ষেত্রবিশেষে সংশোধন করে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ফার্সি পাঠটিই এই সংস্করণে ছাপা হয়েছে। তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদে বেভারিজও ওই পাঠ শোধনের কাজ করেছিলেন, নানা শব্দের পাণ্ডিত্যপূর্ণ টীকা দিয়েছিলেন। কেবল মাঝে মাঝে তাঁর টীকাগুলি আবুল ফজলের ইতিহাসের সামগ্রিক তাত্পর্যের সঙ্গে লগ্ন হয়নি। টিপ্পনিতে থাকস্টন পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে অতি পরিচিত আরবীকৃত ফার্সি ‘মোগল’ নামটি বাবর ও তাঁর বংশধররা কখনওই আত্মপরিচিতিতে ব্যবহার করতেন না। তৈমুরের দৃষ্টান্ত অনুসারে তাঁরা ‘গুরকান’ অর্থাত্ চেঙ্গিজীয় ‘জামাতা’কুল সম্বন্ধী খেতাবে নিজেদের পরিচয় দিতেন। দরবারি ইতিহাসে তৈমুরীয় ‘খানদান’ বা ‘সিলসিলা’কে আবুল ফজলরা সব সময় ‘গুরকানিয়া’ বলে অভিহিত করতেন। আকবরের আমলে তুর্কি ভাষার দবদবা কমে এসেছে, মনসবদারদের পড়ার সুবিধার জন্য মাতৃভাষা তুর্কিতে লেখা বাবরের আত্মজীবনী রাজভাষা ফার্সিতে অনুবাদ করাতে হয়েছে। অথচ সেই সময়েই ইতিবৃত্তে খাস মঙ্গোলীয় লকব ‘গুরকান’ মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে বাদশাহি স্মৃতিতে জিইয়ে রেখেছে। টীকাটিপ্পনি তো নিছক শব্দার্থ নয়, প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গে আজকের পাঠকের ঐতিহাসিক কৌতূহলকে উসকে দেওয়াও ওই প্রকরণের কাজ।
রোহন নারায়ণ মূর্তির পোষকতায় ও সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক শেলডন পোলকের সাধারণ সম্পাদনায় সদ্য চালু হওয়া ‘মূর্তি ক্লাসিকাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়া’র আওতায় প্রকাশিত এ হেন দ্বিভাষিক সংস্করণটি নামে ও আকারে সনাতনী ‘লোয়েব ক্লাসিকাল লাইব্রেরি’র কথা মনে করিয়ে দেয়, গ্রিক ও লাতিনে লেখা ধ্রুপদী রচনার জগদ্বিখ্যাত এক দ্বিভাষিক গ্রন্থমালা। অতীতে কলকাতার ‘বিবলিওথেকা ইন্ডিকা’ বা দেশবিদেশের অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ওরিয়েন্টাল সিরিজ মূলত সংস্কৃত, আরবি ও ফার্সি ভাষার গ্রন্থগুলিই ধ্রুপদী সাহিত্য হিসাবে ছাপত, প্রাদেশিক দেশজ ভাষা বা ‘ভাখা’ সাহিত্যের রচনাবিশেষ কালেভদ্রে ওই সব গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত হত। মূর্তি লাইব্রেরির ঝোঁক এখানেই আলাদা। সেই ঝোঁক অনুযায়ী নিছক ভাষার প্রাচীনত্ব নয়, বরং আমাদের ভারতীয় চিন্তনে ও বিবর্তনে যে সব রচনা সজীব প্রতর্কের জন্ম দিয়েছে, সত্তার নির্মিতিতে ও মননের ক্ষেত্র প্রসারে খুঁটির কাজ করেছে, নানা মার্গীয় ও দেশি ভাষায় লেখা সেই সব সত্ সাহিত্যই সম ভাবে মান্য নব কলেবরে মুদ্রিত হওয়ার যোগ্য। ফলে এই গ্রন্থমালায় মীমাংসক কুমারিল ভট্টের শ্লোকবার্তিক, পালি থেরি গাথা, ফার্সি আকবর নামা-র পাশেই উঁকি মারবে বৈষ্ণব কবি সুরদাসের ভজনামৃত ও পঞ্জাবের বুলে শাহের সুফি সামা গীতি। এও প্রকাশক জানিয়ে দিয়েছেন যে, মূল পাঠের বর্ণমালা অনুযায়ী মুদ্রণের সাটে ভারতীয় হরফ লেখাঙ্কনের বৈচিত্রও ধরা পড়বে, আধুনিক ফন্টের বিন্যাসে কাতিবদের কৃতিত্বও স্বীকৃতি পাবে। ‘কুদরত তেরি রঙিবিরঙি’, এটাই তো ভারতীয় সংস্কৃতির চরিত্র।
গোলকায়নের যুগে, পাঠ-অভ্যাসের রূপান্তরে বা নানা চোখ-ধাঁধানো মাধ্যমের দাপটে প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে কারও প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু চেষ্টায় ক্ষতি কী? বলতে নেই, সাহিত্য অকাদেমি এখনও কর্মক্ষম। পাশাপাশি মূর্তির বেসরকারি উদ্যোগটি আমাদের একলষেঁড়ে আত্মতৃপ্ত জগতে ভিন্ন এক সময়ের ভিন্ন এক বেরাদরির সঙ্গে নতুন করে আলাপচারিতার পরিসরকে আরও প্রশস্ত করতে পারে। জীবনযাপনে কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের প্রতিরোধ তো মৌলবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে জেহাদ, সেই জেহাদ-ই-আকবরি নিরন্তর চালাতে হয়, এই বিশ্বাসটুকু অন্তত ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ছিল।