উনিশশো সাতচল্লিশ সালে পার্টিশন বা দেশভাগ হয়েছিল। এখানে একটা ভাবার বিষয় আছে। বাংলায় যাই বলি না কেন, ইংরেজিতে কথাটা কি ‘পার্টিশনস’ হওয়া উচিত নয়? এত রকমের ঘটনা, এতগুলি অঞ্চলে, এত রকমের ভাগাভাগি, এত আলাদা ভাবে অঞ্চলগুলির পাল্টে যাওয়া: সব কিছুকে একবচনের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা কি উচিত না সম্ভব? পঞ্জাব ও বাংলা প্রধান দুটি বিভক্ত প্রদেশ, কিন্তু দুই প্রদেশের অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক ফারাক। সেই ফারাকটা যদি বা খেয়াল রাখাও হয়, আরও একটা প্রদেশ যে এই বিদারক ইতিহাসের চাপে পিষ্ট হয়ে ছিল এবং আছে, যার নাম সিন্ধু, সেটা কখনওই আলোচনার পরিসরে আসে না। নন্দিতা ভাবনানি যে হঠাত্ কেন সিন্ধুপ্রদেশীয় হিন্দুদের দেশভাগ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার কথা ভাবলেন, এটাই প্রথম বিস্ময়। অতি যত্নকৃত বইটিতে তিনি আমাদের আশঙ্কাটাই প্রমাণ করে দিলেন। বাংলায় যাই বলি, ইংরেজিতে বলা উচিত— ‘পার্টিশনস’।
সিন্ধুপ্রদেশের হিন্দুদের ইতিহাস পঞ্জাব ও বাংলার দেশভাগের ইতিহাসের থেকে খুব আলাদা বলেই বোধহয় এত দিন ‘পার্টিশন লিটরেচার’-এর মধ্যে তারা ঢুকতে পারেনি। পঞ্জাব ও বাংলার মতো সিন্ধু প্রদেশ ভাগাভাগি হয়নি, সম্পূর্ণ প্রদেশটিকেই পাকিস্তানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। জমি ভাগের প্রশ্নটি না থাকার জন্য প্রাথমিক ভাবে হিংসা হানাহানিও কম হয়েছে। পরিবর্তে ১৯৪৭-এর পর সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের প্রান্তীয়করণের অভিজ্ঞতা হয়েছে সিন্ধুর হিন্দুদের। তাঁরা নতুন দেশের নতুন ইসলামিপনার দাপাদাপির সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। উচ্ছেদ ও নির্যাতন থেকে তাঁরা রেহাই পাননি, তবে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কিছু পরে। লালকৃষ্ণ আডবাণীর করাচি-ত্যাগ যদিও সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরেই, হিন্দু উদ্বাস্তু-প্রবাহ সীমানা পেরোতে শুরু করে ১৯৪৮-এ। এঁরা ঠাঁই নেন পশ্চিম ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরের অবর্ণনীয় পরিবেশে। এইখানে বাংলার সঙ্গে সিন্ধি ইতিহাসের মিল, যদিও আংশিক মিল। বাংলার সেই বহুকথিত ‘লং পার্টিশন’-এর সঙ্গে এঁদের মেলানো যাবে না, কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত কোনও দিনই পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের মতো ‘পোরাস’ বা ছিদ্রময় থাকেনি। উদ্বাস্তুধারা ও দিকে দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগটা প্রবল ভাবে দুমুখো, মাঝখানে অমূল্য সেতু বাংলার ভাষাবন্ধন। কিন্তু সিন্ধিদের সঙ্গে ভারতের কোনও জনবসতিরই যোগাযোগ স্থাপিত হয় না, কারণ এ দেশে তাঁদের ভাষা কেউ জানে না। দ্রুত নিজেদের ভাষা ভুলে গিয়ে ‘অন্য’ ভাষায় আশ্রয় নিতে হয় তাঁদের। জায়গা মিললেও তাঁরা পঞ্জাবি বা বাঙালি উদ্বাস্তুদের মতো কোনও দিনই মিশে যেতে পারেননি মূল স্রোতে। এ দিকে পাকিস্তানেও রাষ্ট্রীয় উর্দুর চাপে সিন্ধির মতো প্রান্তিক ভাষার দ্রুত বিদায়সাধন ঘটেছে। অর্থাত্, সিন্ধি ভাষাকে নিপুণ ভাবে মুছে দিয়েছে দেশভাগ। ভারত বা পাকিস্তান দুই দেশেই পরবর্তী সিন্ধি প্রজন্মের কাছে তাদের ভাষা মৃত। তাদের ইতিহাস অবরুদ্ধ। সিন্ধুর ইতিহাস লেখা না হওয়ার একটা কারণ এখানেই লুকিয়ে। নন্দিতা ভাবনানি সিন্ধি পরিবারের মেয়ে হয়েও মধ্য-কুড়িতে পৌঁছনোর আগে একটুও সিন্ধি জানতেন না। এই বই লেখার জন্যই তাঁর সিন্ধি ভাষা শিক্ষা শুরু।
ছোট এই কথাটির মধ্যেই ধরা আছে অনেক সূত্র। নন্দিতা ভাবনানির বই এ রকম অনেক নতুন কথা বলে, আর বলে প্রচুর গল্প। অনেক পরিবারের কাহিনি, অনেক উপকথা, অনেক প্রচলিত ধারণা। যাঁরা দেশ ছেড়ে এলেন, যাঁরা দেশে থেকে গেলেন এবং যে মুসলমানরা ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে গিয়ে মোহাজির নামে ভূষিত হলেন, এই তিন ইতিহাস এই বইয়ে একসঙ্গে মেলে। মোহাজিররা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে তাদের বাড়িঘর কেড়ে পাকিস্তানি হয়ে ওঠে, তবু পাকিস্তানি রাষ্ট্রের কাছে চির-সন্দেহভাজন হয়ে থাকে। এককালের প্রসিদ্ধ হিন্দুপ্রধান বন্দর-শহর করাচির হিন্দু-মুসলিম আদানপ্রদানের সংস্কৃতির ধারার প্রতিই হয়তো ধাবিত এই রাষ্ট্রীয় সন্দেহপ্রবণতা। দেশভাগ-উত্তর পাকিস্তানের সব অংশই যে সমান ভাবে পাকিস্তানি নয়, এ ভাবে তার একটা পরোক্ষ ইঙ্গিত মেলে এই বইয়ে, প্রত্যক্ষ ভাবে যে দাবি করেছেন আয়েশা জালাল তাঁর নতুন বইতে। নন্দিতা বাণিজ্য-বিষয়ের ছাত্রী, ইতিহাসের নয়, হয়তো সেই কারণেই শেষ পর্যন্ত একটা সংবদ্ধ ইতিহাস রচনার প্রয়াস ফুটে ওঠে না এই বইয়ে। বইটির মুখবন্ধে আশিস নন্দী সেই সামান্য দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থে ইতিহাসবিদ নন বলেই হয়তো বইটি সাধারণ পাঠকদের কাছেও ভারী সুবোধ্য। সিন্ধুর ইতিহাস এই বইয়ের মাধ্যমে নতুন করে বেঁচে উঠল বললে অত্যুক্তি হবে না।
ইতিহাস রচনার সেই সংবদ্ধতা স্পষ্ট ভাবে মেলে নীতি নায়ারের বইতে, পঞ্জাবের দেশভাগের নতুন বিশ্লেষণে। পঞ্জাব নিয়ে অনেক আলোচনা হওয়ার পরও নীতির বইয়ের প্রধান গুরুত্ব, এই সব পদ্ধতিগত ও তত্ত্বগত প্রশ্ন তুলে ধরার মধ্যে। পঞ্জাবি হিন্দুদের ইতিহাস লিখতে গিয়ে নীতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন একটি কেন্দ্রীয় ধাঁধার প্রতি: সরকারি ইতিহাসের সূত্র ও তথ্য যেখানে স্পষ্ট ভাবে দেশভাগের ভবিতব্যতা প্রমাণ করে, সেখানে পঞ্জাবি হিন্দুরা কেন দেশভাগের সিদ্ধান্তে এমন বিষম বিস্মিত ও পীড়িত বোধ করেছিলেন, কেন তাঁরা এই ভবিতব্যতা দেখতে পাননি। এই প্রশ্নের সূত্র ধরে সরকারি ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের মৌখিক ইতিহাসের যে বিভাজন-বিন্দু, সেখানে আলো ফেলতে চান তিনি: স্মরণ ও বিস্মরণের মিশ্র প্রক্রিয়ার মধ্যে কী ভাবে আটকে থাকে ইতিহাস, কেন মানুষ কিছু ঘটনা বা বাস্তব বিশেষ ভাবে ভুলে যেতে চায়। এই বই পড়ে মনে হয়, মূল আলেখ্য-র গুরুত্বকে ছাপিয়ে উঠেছে আলেখ্য-র পিছনকার এই দ্বন্দ্বময় প্রেক্ষিতের গুরুত্ব। ইতিহাস কতটাই স্মৃতিনির্ভর, এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের ধর্ম, গোষ্ঠী, নাগরিকত্ব সমস্ত আইডেন্টিটিই যে স্মৃতি-প্রক্রিয়ায় লীন, এই বিশ্বাসে নীতির গবেষণা নিষিক্ত।
সাধারণ মানুষের এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধাক্কাতেই দুর্বল হয়ে পড়ে পার্টিশনের নিশ্চিত ভবিতব্যতার তত্ত্বটি। মুসলিমপ্রধান প্রদেশের মুসলিম রাজনীতির পাশে হিন্দু পঞ্জাবি সম্প্রদায়ের প্রবল আইডেন্টিটি-সংকট, নিরাপত্তাবোধের অভাব, এবং হিন্দুপ্রধান দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে প্রাদেশিক সংখ্যালঘু অস্তিত্বকে নিরাপদ করার তাড়নার রাজনীতি তৈরি হয়। অর্থাত্ একটা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ তৈরি হয়। মূল ভারতের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা সহজ হতে পারে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনীতির একের পর এক নেতৃত্ব তৈরি করার সুবাদে। স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, লালা লাজপত রায়, ভগত্ সিংহ: যতই আলাদা হোন ভাবনাচিন্তায় কাজেকর্মে, পঞ্জাবি হিন্দু সমাজকে তাঁরা একই দক্ষতায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রে ঠেলে দিতে পেরেছেন। কত বার ‘পঞ্জাব অন্যায়’ (‘Punjab wrong’)-এর বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় আন্দোলন তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে হিন্দু প্রগতির দুর্দম ধারণা। পঞ্জাবি হিন্দু নেতাদের ঐক্য-বচন ক্রমশ পাল্টে গিয়েছে সাম্প্রদায়িক ভেদের ডিসকোর্সে। কিন্তু তবু চূড়ান্ত বিচ্ছেদ অপ্রত্যাশিতই ছিল।
নীতির বর্ণনায় পঞ্জাবি হিন্দুদের কথা পড়তে গিয়ে আমাদের অবধারিত মনে পড়ে বাংলার হিন্দুদের কথা, যাঁরা সংখ্যালঘু হয়েও সংখ্যালঘু-মানসিকতার শিকার হননি, সম্ভবত তাঁদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির কারণে। তা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক ভেদের ডিসকোর্স বাংলাতেও প্রবল ভাবে বিস্তার লাভ করে। জয়া চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাঙালি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাই দেশভাগ ডেকে আনে। ইতিহাস কিন্তু বলে, পঞ্জাবের মতো বাংলাতেও দেশভাগ অত্যন্ত অভাবিত ছিল, শেষ কয়েক মাসের আগে। নীতির প্রশ্নটি যদি তলিয়ে দেখি, কেন সাম্প্রদায়িক বিভেদের পরিবেশ সত্ত্বেও দেশভাগ অবধারিত হয়ে ওঠেনি, ওঠে না, তা হলে সম্ভবত উত্তরটা খুঁজতে হবে অন্যত্র। সাম্প্রদায়িক ভেদ ও দূরত্বের ডিসকোর্সে কী ভাবে ভেদের সংকট ও তার রাজনৈতিক/ সামাজিক সমাধানগুলি ভাবা হচ্ছিল, তার মধ্যে। এবং তখনই স্বীকার করে নিতে হবে, অনেকাংশে এক রকম শোনালেও, জয়া চট্টোপাধ্যায়ের বই তেমনটা দাবি করলেও, বাংলায় এই ডিসকোর্স কিন্তু কখনও একমাত্রিক ছিল না। পঞ্জাবেও নয়। এই ভিন্ন মাত্রাগুলি আর একটু উদ্ঘাটিত হতে পারত নীতির বইতে। শ্রদ্ধানন্দ ও মালবীয়ের রাজনীতি বিষয়ে অনেক জানা গেল, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তার ভেদ বিষয়ে তত জানা গেল না। নেহরু কেন বার বার মালবীয়ের দ্বারস্থ হতেন বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য, বোঝা গেল না। মুসলিম রাজনীতি যদিও এই বইয়ের আলোচ্য নয়, তবু হিন্দু রাজনীতি প্রসঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে যে প্রাদেশিক মুসলিম প্রধানমন্ত্রীর কথা উঠে আসে, সেই সিকান্দার হায়াত্ খানের সঙ্গে কেন সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ নেতৃত্বের সংঘর্ষময় সম্পর্ক ছিল, এই বিভেদের বিভিন্ন ধারণা ও বিভিন্ন রাজনীতির প্রসঙ্গে এলে তা আরও জানা যেত। সেটা হল না। অনেক গুরুতর প্রশ্ন নিয়ে এলেন নীতি, দেশভাগের অন্যান্য ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে অনেক প্রশ্ন উঠেও আসে পাঠকের মনে। সব উত্তর না পেলেও প্রশ্নগুলোই কিন্তু বিরাট লাভ।