‘গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল’—একদা বহুল প্রচারিত এই চরণটির উত্স সম্ভবত নিহিত আছে নদীর পশ্চিম তীরের ধর্মীয় ঐতিহ্যে। গঙ্গার যে অংশ হুগলি নামে পরিচিত, তার পশ্চিমখণ্ডে আছে ত্রিবেণীর মতো প্রসিদ্ধ ধর্মকেন্দ্র। পুণ্যার্জনের নিশ্চয়তার পাশাপাশি, পশ্চিম কূলের প্রবল প্রতিপত্তির কার্যকারণ বহুবিধ। প্রধান কারণ অবশ্যই মধ্যযুগের অন্ত্যপর্বে সপ্তগ্রামের বণিকদের উদ্যোগে-আয়োজনে এবং খ্রিস্টীয় ১৬-১৮ শতক পর্যন্ত ইউরোপীয় বণিক-ধর্মপ্রচারকদের উপস্থিতি ও কাজকর্মে।
আলোচ্য গ্রন্থের উপজীব্য হুগলি নদীর পশ্চিম কূলে ইউরোপীয় উপস্থিতির একটি সুগম বিবরণ। ব্যান্ডেল থেকে হাওড়া, এই ভূখণ্ডের কয়েকটি প্রধান জনপদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বেশ ক’টি প্রধান ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। লেখকদ্বয় সেই যোগসূত্রগুলিকে ব্যাখ্যা করেছেন একটি অবিচ্ছিন্ন উপাখ্যানের কাঠামোয়। তার সঙ্গে আছে আধুনিক পশ্চিমি শিক্ষার প্রসারে এই অঞ্চলের অগ্রগণ্য ভূমিকার কথা এবং জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী আন্দোলনের প্রসঙ্গ। ষোড়শ থেকে বিংশ শতকের আদি পর্ব— প্রায় চার শতকে ব্যাপ্ত এই উপাখ্যান। ভূমিকায় লেখকরা জানিয়েছেন, বইটি বিশেষজ্ঞদের জন্য লেখা হয়নি। ইতিহাস-উত্সাহী পাঠকসমাজের কথা ভেবেই তর্ক-প্রতিতর্কের মল্লক্রীড়া এড়িয়ে, টীকাটিপ্পনীর বাহুল্য বর্জন করে একটি স্বচ্ছন্দ ও সুগ্রন্থিত কাহিনি শুনিয়েছেন দুই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাস ও অকালপ্রয়াত বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়।
বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ পর্যায়ে ইউরোপীয় বণিককুলের আগমন এবং ক্রমিক সমৃদ্ধির কাহিনির একটি স্থানীয় এবং বৃহত্তর প্রেক্ষিত আছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির জটিল বিন্যাস, ভারত মহাসাগরের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব, এমন বহুবিধ প্রসঙ্গ সবিস্তারে আলোচিত ইতিহাসবেত্তাদের গবেষণায়। এই নাতিস্ফীত বইয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষিতের আভাস রয়েছে— ফলত স্থানিক ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি যথাযথ ভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়ে ওঠে।
আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটির প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে উপাখ্যানের রূপরেখা। ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে বার্তোলোমিউ ডায়াসের উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে পর্তুগাল প্রত্যাবর্তনে যে কাহিনির সূত্রপাত, পশ্চিম কূলের সীমানা অতিক্রম করে পূর্ব কূলে কলকাতা নগরীর পত্তনে তার পর্বান্তর। পর্তুগিজ, ডাচ, ডেন, ফরাসিদের ক্ষণস্থায়ী উত্থান এবং তাদের ক্ষমতার অবসানে ইংরেজ শক্তির উত্থান প্রতীকী এবং আক্ষরিক অর্থেই পশ্চিম কূলের অন্তিম যাত্রা এবং পূর্ব কূলের নিশ্চিত অভ্যুত্থানকে সূচিত করে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে সপ্তগ্রাম-ব্যান্ডেল-হুগলি এই তিন সন্নিহিত স্থানে পর্তুগিজ অধিকার এবং অপসরণের চমকপ্রদ কাহিনি। বাংলায়, হুগলির পশ্চিম কূলেও, পর্তুগিজ অধিকার ছিল স্বল্পস্থায়ী। জাহাঙ্গির এবং শাহজাহানের সময় পর্তুগিজ বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। কিন্তু এদের একটি বড় অংশ স্বাধীন ভাবে এবং অপ্রত্যক্ষ সরকারি সমর্থনে জলদস্যুতার সহজ পথ বেছে নিয়েছিল। আরাকানের মগদের সঙ্গে জোট বেঁধে নদীমাতৃক বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে চলত এদের অবাধ দৌরাত্ম্য। ঝুটিবাঁধা মগ, শিরস্ত্রাণ বা ঝাঁকড়া চুলের হার্মাদদের অত্যাচারের স্মৃতি গ্রামবাংলার জনমানসে এমন গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে অষ্টাদশ শতকে যখন বাংলায় ব্যাপক ভাবে পোড়ামাটির মন্দির বানানো হতে থাকে তখন পর্তুগিজ কিংবা মগ-পর্তুগিজদের দৌরাত্ম্য— অসহায় নারীপুরুষদের নৌকো অথবা জাহাজের খোলে বন্দি করে রাখা, লুঠপাট— এ সবের নিপুণ রূপায়ণ ঘটে মন্দির ফলকে। বিষ্ণুপুর থেকে মেদিনীপুরে কিংবা হুগলি জেলার গ্রামে-গ্রামান্তরে অনেক মন্দিরের ফলকে ধরা আছে সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। এ সব মন্দির যখন গড়া হয় তত দিনে পর্তুগিজ আধিপত্যের লেশমাত্র টিকে নেই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের গবেষণার কথা— মগ-হার্মাদ দৌরাত্ম্যে বাংলার বর্ণজাতিব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, এবং ‘মগদোষ’ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন ঘটে। আবার গির্জা, পাদ্রি, বালতির মতো অনেক শব্দই পর্তুগিজ উত্স থেকে বাংলা ভাষায় স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে পর্তুগিজ প্রভাব সুবিদিত। এই সে দিন পর্যন্ত গ্রামবাংলায় টম্যাটোর পরিচিতি ছিল ‘বিলাতি বেগুন’ বলে। ব্যান্ডেল চিজ ততটা সুপরিচিত নয়— এই সুখাদ্যটি কয়েক বছর আগেও পাওয়া যেত কলকাতার নিউ মার্কেটে। অনুমান অসঙ্গত হবে না, এর উত্পত্তি পর্তুগিজ হেঁশেলে, একদা বাণিজ্যকেন্দ্র ব্যান্ডেলে। দুর্ভাগ্যক্রমে, পর্তুগিজদের বিশিষ্ট স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লুপ্ত, বারংবার সংস্কারের দাপটে ব্যান্ডেল গির্জার মূল অবয়ব কতটা বজায় আছে তা বলা কঠিন। মোগল আমলের একটি পুথিচিত্রে হুগলির দুটি গির্জার পুরনো চেহারার আভাস পাওয়া যায়।
হুগলির লাগোয়া চুঁচুড়ায় গড়ে উঠেছিল ডাচদের বাণিজ্য এবং প্রশাসনকেন্দ্র। পর্তুগিজদের বিদায় এবং ডাচদের উত্থান, হুগলি নদীর পশ্চিম কূলের কাহিনির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থানপতনের সঙ্গে চুঁচুড়ার ভাগ্য অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ডাচ ব্যারাক, আধিকারিকদের আবাস, সমাধিক্ষেত্র, গির্জায় এই ইতিহাসের একটি পর্যায় আংশিক ভাবে ধরা আছে— যেমনই আছে এক অনবদ্য স্মৃতিসৌধ— ডাচ মহিলা আনা মারিয়ার স্মৃতিতে স্থাপিত এবং সৌভাগ্যক্রমে প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংরক্ষিত। চুঁচুড়ায় আর্মেনিয়ান গির্জার মূল চরিত্র এখন অনেকটাই অবলুপ্ত সম্পন্ন ভক্তদের স্থূল হস্তাবলেপনে। আর এই চত্বরেই সমাহিত আছেন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পর্বের এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব জোসেফ ডেভিডোভিচ বেগলার— মধ্য এশিয়ার খিবা-র রাজপরিবারের সদস্য, আলেকজান্ডার কানিংহামের সহযোগী, পূর্ব ভারতের প্রত্নস্থলের ক্ষেত্রানুসন্ধানকারী, নৈহাটির জুবিলি ব্রিজের নকশাকার এবং অন্ত্যপর্বে চাকদহ মিউনিসিপ্যালিটির কর্তা।
একই ভাবে চন্দননগরের ফরাসি উপনিবেশ, তার নিজস্ব স্থাপত্য, নগর-পরিকল্পনা, ফরাসি বণিক, সৈনিক, কর্মচারীদের সমাধিক্ষেত্র নিয়ে এক বিশেষ পর্বের সাক্ষী। দুপ্লের সঙ্গে চন্দননগরের যোগাযোগের প্রশ্নটি বিতর্কিত, কিন্তু কোনও ক্রমে টিকে থাকা ফরাসি ভাষার চর্চা, রাস্তার নামে, মানুষজনের স্মৃতিতে, অধ্যাপক আঁদ্রে বেতেই-এর সংবেদী স্মৃতিচারণায় ধরা পড়েছে ফরাসি ও বাঙালি সমাজের সম্পর্কের টানাপড়েন। চন্দননগরের নাকি ফরাসডাঙার তাঁতিদের কথাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের ইতিহাসকাররা নিশ্চয়ই সে সব আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাঙালি মনে রেখেছে ধুতির পাড়ে তাদের পদ্যবিলাস— ‘বেঁচে থাকো বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’।
পরবর্তী পর্যায়ে চন্দননগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং শ্রীঅরবিন্দের যোগাযোগ, বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, হরিহর শেঠের উদ্যোগ আয়োজন, মতিলাল রায় এবং প্রবর্তক সংঘ থেকে চন্দননগরের বিশিষ্ট মিষ্টান্ন শৈলী এবং ফরাসি তরিকার রুটি এবং বিস্কুটের ক্ষীয়মান অবশেষ, সব মিলিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তার এক বিশেষ স্থান আছে।
চন্দননগরের অল্প দূরত্বে শ্রীরামপুর, ডেন বা দিনেমারদের কেন্দ্র। লেখকরা মনে করিয়ে দিয়েছেন শ্রীরামপুরের প্রাক-ইউরোপীয় ইতিহাসের কথা। এখানেও রয়েছে ড্যানিশ এবং স্থানীয় শৈলীর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা গির্জা, প্রশাসকের আবাস অথবা অধুনা বিলুপ্ত ড্যানিশ সরাইখানা ইত্যাদি। যদিও শ্রীরামপুরের খ্যাতির অনেকটাই ব্যাপটিস্ট মিশন আর তার ছাপাখানার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোত। আর কবিগানের কল্যাণে শ্রীরামপুরের গির্জা তো পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির মনে।
শেষ দুটি অধ্যায়ের উপজীব্য উনিশ শতক থেকে পশ্চিম কূলের আধুনিক ইংরেজি (বা ইউরোপীয়) ভাষাশ্রিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী রাজনীতি। হুগলি কলেজ তো বাঙালি নবচেতনার উন্মেষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, অন্য দিকে শ্রীরামপুর কলেজ বা অনেকগুলি বিখ্যাত স্কুল এই অঞ্চলে পশ্চিমি শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই বিষয়ে ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই বিশদে চর্চা করবেন। জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী রাজনীতিতে এই অঞ্চলের ভূমিকাও সর্বজনবিদিত।
লেখকদ্বয় এক জটিল, বহুবর্ণ ইতিহাসকে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাবে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বৃহত্তর প্রেক্ষাপট কখনও হারিয়ে যায়নি, আবার স্থানিক মাত্রাও বিশ্লেষিত হয়েছে সুসংহত কাঠামোয়। আশা করব, পশ্চিম কূল থেকে এ বার দৃষ্টি প্রসারিত হবে পূর্ব কূলেও, নৈহাটি ইছাপুর টিটাগড় কাঁকিনাড়ার ইতিহাস অনুসন্ধানের পরিধি ছাপিয়ে যাবে পাটকল এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসকে। পূর্ব কূলের সামাজিক ইতিহাস, বাণিজ্যের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি চর্চায়, দেশজ ভাষা সাহিত্য দর্শন ইত্যাদিতে আগ্রহী হবেন বাঙালি ইতিহাস গবেষক এবং বাঙালি পাঠক।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক