পুস্তক পরিচয় ১...

জীবনীর মধ্যে আর এক জীবনী

সুবিশাল তাঁর পরিচয়ের জগৎ, সারা জীবন সেই জগতের সঙ্গে চিঠিপত্রে তাঁর যে প্রাণবান সংযোগ, তার ব্যাপ্তি তার গাম্ভীর্য যেমন, তেমন তার রঙ-বেরঙ, কখনও বা তার হালকা ভাবের দুলকি চাল। পরিণত বয়সে চিঠি লিখতে লিখতে যখন মন বলে ওঠে ‘আমার চিঠি লেখার বয়স চলে গেছে’ যখন স্মরণে আসে সেই অতীত দিন, চিঠি লেখার আনন্দেই চিঠি লিখতেন তখন, তবু তো দেখি তাঁর সেই সব চিঠিতেও বিচিত্র রসের ধারা উছলে পড়ছে। চিঠি তাঁর মত প্রকাশের ভাষা, তাঁর ভাবনা বা পরিকল্পনা অন্যের চিত্তগোচরে আনার পাত্র, প্রতিবাদের হাতিয়ার। অনেক বার তাঁর সাহিত্য বা রাজনীতি নিয়ে লেখা চিঠি পত্রপ্রবন্ধের রূপ নিয়েছে।

Advertisement

প্রণতি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ২০:১০
Share:

রবীন্দ্রপত্রাভিধান ১,২ খণ্ড, বিজন ঘোষাল। পত্রলেখা, প্রতিটি ৪৫০.০০

সুবিশাল তাঁর পরিচয়ের জগৎ, সারা জীবন সেই জগতের সঙ্গে চিঠিপত্রে তাঁর যে প্রাণবান সংযোগ, তার ব্যাপ্তি তার গাম্ভীর্য যেমন, তেমন তার রঙ-বেরঙ, কখনও বা তার হালকা ভাবের দুলকি চাল। পরিণত বয়সে চিঠি লিখতে লিখতে যখন মন বলে ওঠে ‘আমার চিঠি লেখার বয়স চলে গেছে’ যখন স্মরণে আসে সেই অতীত দিন, চিঠি লেখার আনন্দেই চিঠি লিখতেন তখন, তবু তো দেখি তাঁর সেই সব চিঠিতেও বিচিত্র রসের ধারা উছলে পড়ছে।

Advertisement

চিঠি তাঁর মত প্রকাশের ভাষা, তাঁর ভাবনা বা পরিকল্পনা অন্যের চিত্তগোচরে আনার পাত্র, প্রতিবাদের হাতিয়ার। অনেক বার তাঁর সাহিত্য বা রাজনীতি নিয়ে লেখা চিঠি পত্রপ্রবন্ধের রূপ নিয়েছে। প্রয়োজনের কথায় ভরা সাদামাটা চিঠিও ঢের লিখেছেন, তাতেও একটু যেন বিশেষত্বের ছোঁয়া লেগে থাকে। ব্যক্তিভেদে রবীন্দ্রনাথের চিঠি কত ভাবেই যে নিজেকে প্রকাশ করে, কত ভাবেই যে রূপারোপ করে।

গ্রন্থাকারে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র সংকলনের ধারা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এক কালে পত্রপত্রিকায় তাঁর অপ্রকাশিত পত্রগুচ্ছের প্রকাশ নিয়মিত দেখা যেত। তাঁর জীবৎকালেই ছোট ছোট কত পত্রিকাতেও তাঁর চিঠি বেরিয়েছে কত সময়। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের সমগ্র চিঠিপত্র এক পরিকল্পনাধীনে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সংকল্পজাত রবীন্দ্রপত্রাভিধান-এর সঙ্গে পরিচয় হল। প্রথম দুই খণ্ডে প্রায় সওয়া চারশো চিঠি সংকলিত হয়েছে।

Advertisement

প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় সম্পাদক জানাচ্ছেন, সহস্রাধিক ব্যক্তিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের বাংলা ও ইংরেজি চিঠি এই প্রকল্পের আওতায় আসবে, তার সংখ্যা কমবেশি সাড়ে সাত হাজার। এর বাইরেও যে বিদেশের কোনও কোনও সংগ্রহালয়ে, এ দেশের ব্যক্তিগত সংগ্রহে, খোদ বিশ্বভারতী-রবীন্দ্রভবন সংগ্রহে আরও কিছু অপ্রকাশিত উদ্বৃৃত্ত নেই, তাও বলা চলে না।

আলোচ্য নবোদ্যোগ-সংকলনে প্রত্যেক চিঠি-অন্তে পত্রপ্রসঙ্গ ও টীকা অংশে তথ্য সংযুক্ত হয়েছে। তবে রবীন্দ্র-পত্র সংকলন মাত্র এই সংকলন গ্রন্থের অভীষ্ট নয়। সম্পাদক যে ভাবে চিঠিপত্রের ‘আদান-প্রদান’কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার ফলে পত্রাভিধানের একটি নিজস্ব চরিত্র ফুটে উঠেছে। যাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠির আদান-প্রদান হয়েছে বা যিনি চিঠি লিখে তাঁর উত্তর পেয়েছেন, পত্রাভিধানে তাঁদের যথাসাধ্য পরিচয় তো আছেই, যিনি রবীন্দ্রনাথের উত্তর পাননি বা সেই উত্তরপত্রের যে ক্ষেত্রে সন্ধান নেই, তেমন পত্রদাতারও পরিচয় এবং প্রাসঙ্গিক অন্য বক্তব্য এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। গ্রন্থ-সম্পাদকের মনে হয়েছিল তা না হলে রবীন্দ্র পত্রাভিধান-এর ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না। গুরুত্ব বিচার করে রবীন্দ্রনাথকে লেখা নির্বাচিত পত্র এই সংকলনে স্থান করে নিয়েছে এবং আরও নেবে। গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সব চিঠিই আসবে। যেমন ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ-অজিতকুমার চক্রবর্তী পত্রবিনিময় পত্রাভিধানের দুই খণ্ডে অনেকখানি স্থান অধিকার করেছে।

সম্পাদকের বক্তব্যে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলাম, পাইনি। বিশ্বভারতী বরাবর রবীন্দ্রনাথের চিঠি সম্পাদনার নামে খণ্ডিত আকারে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘ছিন্নপত্র’ ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ প্রকাশকালে কাটছাট করেছিলেন। বিশ্বভারতীর পত্রসম্পাদনায় লক্ষ করা যায়, যদি রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে কারও সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য থাকে বা ব্যঙ্গোক্তি, বা ওই ধরনের আর কিছু, সে সব বাদ যায়। আশা করি মূল চিঠি দেখবার সুযোগ থাকলে রবীন্দ্রপত্রাভিধান সেই নজির অনুসরণ করবে না। এ বার অখণ্ড রবীন্দ্রপত্রের পরিচয় পাওয়া যাবে। কোন চিঠি কোথা থেকে আহৃত, সেই উৎসনির্দেশ বাঞ্ছিত, এই দুই খণ্ডে তা নেই।

দু-পাঁচটা মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে, শিথিলবন্ধ কিছু বাক্য, সে কথা থাক। অন্য কয়েকটি কথা বলি। পত্রপ্রসঙ্গ ও টীকায় সঠিক তথ্যবিন্যাসই লক্ষ হওয়া উচিত এবং উচিত অতিকথন পরিহার। এ গ্রন্থের প্রথম দৃষ্টান্তই বিপরীত কথা বলে। প্রশ্নের উত্তরে অক্ষয়কুমার ভট্টাচার্যকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে জানাচ্ছেন ফলের ঝুড়ি জোড়াসাঁকোয় কার কাছে দিতে হবে। ফল-প্রেরণকর্ত্রী হেমন্তবালা দেবীর নামটুকু যদি পত্রপ্রসঙ্গে আসেও, তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বিষয়ে কিছু কথা একেবারেই আলগা মাটিতে লাগানো হয়েছে, তাতে বিষয়ও স্পষ্টতা পায়নি। মূল ইংরেজি পত্রের সঙ্গে বাংলা অনুবাদ যোজনের কারণ কী? আর যন্ত্রনির্ভর অনুবাদ প্রাণহীন নীরস হয়, রবীন্দ্রনাথের চিঠি হয়ে উঠবে না সে অনুবাদ। অন্য বিপত্তি কেমন হতে পারে ‘enough empty applause’ ভাষান্তরে হয়েছে ‘অপরিচিত শূন্যগর্ভ সকলরব’ (পৃ ২৯৪)। বোধকরি এর সঙ্গে ছাপাখানার ভূতেরও কেরামতি মিশেছে।

অক্ষয়চন্দ্র সরকারের পুত্র অচ্যুতচন্দ্র সরকার শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম দিকের ছাত্র, নানা কারণে সে সময়ে সেখানকার টালমাটাল অবস্থা। ছেলের ক্ষতির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন অক্ষয়চন্দ্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন, ছেলেকে ছাড়িয়ে নেন। তবু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছাত্র অচ্যুতচন্দ্রের যোগাযোগ থেকে গিয়েছিল। আমার ধারণা, রবীন্দ্রনাথ বরাবর তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি ব্যহারে অত্যন্ত আন্তরিক, তিনি মনে করতেন এখানকার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর যোগ প্রাণের অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। বহু চিঠিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ছাত্র অরবিন্দমোহন বসু সম্পর্কে তাঁর অভিভাবক অবলা বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি। অচ্যুতচন্দ্রকে লেখা চিঠির সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক বিষয়ে দু-চার কথা আলোচিত হতে পারত, তার বদলে চিঠির চরিত্রনির্ণয় অসঙ্গত মনে হল। পুলিনবিহারী সেন প্রমুখ রবীন্দ্রপত্র সম্পাদনার একটি আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তার মূল্য আজও হারায়নি। এঁরা তথ্যগুলি গোচরে আনেন, কিন্তু চিঠি সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। এ কথাও ভেবে দেখতে বলি যে, পত্রপ্রসঙ্গে পত্র-বক্তব্য পুনরুল্লেখ এবং একই তথ্যজ্ঞান প্রায় একই ভাষায় বারবার উল্লেখ বৃথা জায়গা জোড়ে। অনেক ক্ষেত্রে আরও তথ্য উল্লেখের সূত্রটুকু যে ভাবে উল্লেখিত হয়েছে, সেই ভাবেই পূর্বসূত্র উল্লেখের ক্ষেত্রেও বাহুল্য এড়ানো সম্ভব, তথ্যের আরও সংহত উপস্থাপন লেখার উজ্জ্বলতা বাড়াবে, পাঠসহায়ক হবে।

অণুকণা খাস্তগীরকে লেখা তিনটি রবীন্দ্র-পত্রেই (পৃ ৩১০-১৫) ‘কল্যাণীয়েষু’ সম্বোধন কি মুদ্রণপ্রমাদ? রবীন্দ্রনাথের এমন প্রমাদ তো অভাবনীয়। অতসীলতা দেবীর (পৃ ৩১৬) উল্লেখ বিস্ময়কর। মীরা দেবী যথাস্থানে পরে আসবেন, তিনিই অতসীলতা। রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে তাঁর ক্ষুদ্রতমা কন্যাটি ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করতে শিখেছে এই উল্লেখে অতসীলতার প্রবেশ। চিঠিতে নাম ছিল না, থাকার কথাও নয়। তা যদি বা থাকত, চিঠিতে কোনও ব্যক্তির নাম থাকলেই কি বর্ণানুক্রমে তাঁরা এই ভাবে স্থান পাবেন? তা নিশ্চয় নয়। অতসীলতাই বা পেলেন কেন? ছাত্র সরোজচন্দ্র মজুমদার (পৃ ১৪১, ৩০৫) শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের দ্বিতীয় পুত্র, কনিষ্ঠ পুত্র নয়। এটুকু ভুল সামান্য, কিন্তু অমিতা ঠাকুর কেন ‘গায়িকা অমিতা’ (পৃ ২৯৬) পরিচয়মাত্র পেলেন, বোঝা গেল না!

রবীন্দ্রপত্রাভিধান-এর ডালায় সীমাহীন সম্ভাবনার পসরা সাজানো। সুসমন্বিত উদার সম্পাদনার দ্বারা সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হলে রবীন্দ্রনাথের এক জীবনীর মধ্যে আর এক জীবনী রচিত হবে।

ভূতপূর্ব শিক্ষক, রামমোহন কলেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement