কল্পবাস্তবের বিচিত্র ধারা মিলেমিশে থাকে সাহিত্যের কথালাপে। তৈরি হয় কালপ্রবাহী জীবন আর বিস্তারি জীবনের আখ্যান। এ ভাবেই দেখা যায় চরাচরের চালচিত্রে আঁকা অন্বেষণ ও অনুভবের তথ্য— ধূসর থেকে রঙিন হয়ে ওঠা চরিত্র।
কাহিনির তথ্যকে ছুঁয়ে দেখার অফুরান সুযোগ, আবার গল্প বলায় সত্যের ছোঁয়া, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ষাদুয়ার উপন্যাস (কৃতি, ৪০০.০০) এই পটভূমির এক উন্মুখ জয়যাত্রা। আদিগন্ত চা বাগানের জগৎ, উত্তরের ধোঁয়াটে পাহাড়ি বক্ররেখা, জনপদের ম্রিয়মাণ কলরব আর জল-জঙ্গলের মাঝে নিঃসঙ্গ নদীতটের মতো বিষণ্ণতার মেলামেশায় সৃষ্টি এই উপাখ্যান।
এই কাঠামোয় আছে আশা-নিরাশা, ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভের বার্তা বয়ে প্রান্তজনের কথক হয়ে ওঠা। বাস্তবের আবরণে ঢেকে ডুয়ার্সের ভুবন ছুঁয়ে যায় সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ। কিরাতজন কৃতির রূপক বুলি, ভাওয়াইয়ার সুর, ছড়া, প্রবাদ, লোককথা, কিংবদন্তি জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে বর্ণনায় আছে আবহমানের স্পন্দন। শব্দার্থ আর তথ্যসূত্র যোগ হলে তা সমাজ-গবেষণার বর্ণনা হতে পারত। এ রচনার উপলব্ধি মৌসুমি বায়ুর উদ্দেশে শুধু আকাঙ্ক্ষা নয় বর্ষণ-সিক্ত হওয়া। শালগুড়ি চা বাগানের ম্যানেজার দীপঙ্কর আর স্ত্রী সুরঙ্গমার সন্তানহীনতার বিষাদ, জয়দেবের স্মৃতিতে কলকাতার ব্যর্থপ্রেমের অনন্যা, নিরঞ্জন মাস্টারের দেশভাগের না-মানা মনের হাহাকারের কথকতা বা পক্ষীহাগার সম্পদ হারানো এক উত্তরসূরি ব্রিটিশ রায়ের আত্মবিলাপের হদিশ নিয়ে কত চরিত্রের নিবেদন যেন পাখা মেলে ওড়ে! ছোটনাগপুর ভূখণ্ডের আদিবাসী সমাজ, ওপার বাংলার মানুষের অনিবার্য বিচ্ছিন্নতায় বাঁচতে চাওয়ার আকুতি আর পাওয়া-না-পাওয়ার হিসাবনিকাশের আধার এই চা-বলয়ের সংস্কৃতি। মাশান, ধর্মঠাকুর, গোরক্ষনাথ, মেচেনি, ভান্ডানির লোকায়ত জগতের মাঝে রাজবংশী, নেপালি, ডুকপা, ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর কুহকী আলাপপর্ব চলতেই থাকে।
এই বই তাই এক অর্থে অলীক সুখের বর্ণনা। আঞ্চলিক ভাষা-শব্দের ব্যঞ্জনা খণ্ড খণ্ড ঘটমানতায় জলপাইগুড়ির বিস্তারি ভুটান সীমার দুয়ার খুলে দেখায় তিস্তার পাহাড়ি গতি থেকে বক্সা দুর্গের স্থবির প্রত্ন-ইতিহাস। দিগন্ত বরাবর মেঘের উড়ে যাওয়ার অস্পষ্ট ছায়ায় নৈঃশব্দ্যের দৃশ্য তৈরি হয়। সুপারি গাছ-ঘেরা টিনের কুটির, চা বাগান, কুলি লাইন, নুড়ি আর বালির নদীতট পেরিয়ে সেই ছায়ার পাহাড়ে মিশে যাওয়া। লেখকের এই মেধাবী দৃষ্টিপাতকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। তাঁর উপলব্ধিতে চলে আসে, ‘কল্পনা দিয়ে মূল গিদালের চারপাশের ফাঁক ভরতে ভরতে মনে হয় অলীকটাই আসলে সত্যি। তেমন দুয়ারের বর্ণনায় যে রূপকল্প উঠে আসে তা মিথ্যা, অসত্য, অলীক।’ সমকালীন অনুভবের কালাতিপাতে স্পর্শধন্য এই উপন্যাস।
উনিশ শতকীয় বাংলার সমাজ-ইতিহাসের নানা পিছুটানের বিপ্রতীপে ছিল অগ্রগামী হওয়ার বহু উপাদান। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ, পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোর মধ্যে কাব্যধারায় এল— ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল।’ এই সূত্রধারী শিশুশিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত হয়ে এলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। নদিয়া জেলার বিল্বগ্রামের জাতক, মাত্র একচল্লিশ বছরের মদনমোহনের জীবনলিপি অভিজিৎ চৌধুরীর দু’খণ্ডের সমাগত মধুমাস-এর (পারুল, ১২০.০০ ও ১২৫.০০) পরিব্যাপ্ত কাহিনি-সংলাপ। কলকাতার জীবন-সংস্কৃতির চৌহদ্দিতে তখন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশব সেন, ডিরোজিও প্রমুখের নানা কর্মোদ্যোগী দিশা। এমনই ঘটনা-পরম্পরার নানাবিধ বৈশিষ্ট্যকে সম্বল করে লেখক সময় ও সমাজকে উপন্যাসের আঙ্গিকে এনেছেন। পরিবার পরিজন ও সমাজক্ষেত্রে ইতিহাসের দ্বন্দ্ব, দীনতা, আশাবাদকে সম্বল করে মদনমোহনের বহুলাংশে অপরিচিত চরিত্রের পরিমণ্ডল স্পষ্ট করেছেন লেখক। যদিও কিছুটা খাপছাড়া হয়েছে বর্ণনার গতিপ্রকৃতি, যাতে দু’খণ্ডের বিস্তৃতি সংক্ষিপ্ত হলে ভাল হত। তা সত্ত্বেও, সমাজ-ইতিহাসে তৎকালীন বঙ্গসমাজের নানা ভাবনায় মুর্শিদাবাদে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের জীবন, কলকাতার বাবু-সংস্কৃতি, খ্রিস্টান ও ব্রাহ্মসমাজের তথ্য-হদিশ গুরুত্বপূর্ণ। কথাসাহিত্যে এমন মানুষের জীবনরূপ প্রতিষ্ঠা ধন্যবাদার্হ।
যেমন, জীবন-উপন্যাসের শিল্পীচরিত্র ‘রামকিঙ্কর’ শান্তি সিংহ-র রচনায় হয়ে উঠেছেন আলোকিত সত্যের মতো (রামকিঙ্কর, ছায়া পাবলিকেশন, ২০০.০০)। রামকিঙ্কর রাঙামাটির পথে হেঁটে গন্ধেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর, কোপাইয়ের জলধারার মতো মহাকালের স্পর্শ রেখেছেন। রাঢভূমির পরিবেশে শিল্পীজীবনের কাহিনিতে মিশেছে লেখকের ডকুমেন্টেশন। এখানে নন্দলাল বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, রাধারানি, যামিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়, অনিলবরণ রায় যেমন— তেমনি বাঁকুড়ার চৌহদ্দিতে শুশুনিয়া পাহাড়, ভূতশহর, বিষ্ণুপুর, তপোবন ও বীরভূমের শান্তিনিকেতন একাত্ম ভাবে ধরাছোঁয়ার মধ্যে। রামকিঙ্করের শিল্পীসত্তা এই প্রকৃতির মধ্য থেকেই জেগে ওঠা।
বাঁকুড়ার নিজস্ব ভাষায় সংলাপের আবেদন, শিল্পীজীবনের ছকভাঙা মাধুর্যেরই এক অবগাহন। ভারতশিল্পের বিস্ময়প্রতিভা বাস্তবিকই বাঁকুড়া শহরে দারিদ্রক্লিষ্ট পরিবারে মায়ের স্নেহ-প্রশ্রয় আর বাবার অনিশ্চয় আশঙ্কায় স্থিত। তখন অতুল, রামপদর বন্ধু তিনি। রামকিঙ্কর বলেন, ‘মনটা ভাল নাই। ঘরে দিনরাত বাবা গজর্-গজর্ করচ্যে। বলে লাপিতের ব্যাটার হাতে কাঁচি-খুর নাই। রংতুলি? ব্যাটা আটিস্ (আর্টিস্ট) হব্যেক!’ পরে রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্ক্ষা হয় রামকিঙ্করই তাঁর ভাস্কর্যশিল্পে ভরিয়ে দিক শান্তিনিকেতন। এমন তুচ্ছ জীবনের মহীয়ান হয়ে ওঠাতেই ছিল ঐশ্বর্যের দিনদুনিয়া। রঙ-তুলি আর পাথরের শিল্পগাথায় তাঁর যে নিজস্বতা মিশে আছে, সেটাই তো বাস্তবের চরিত্রকে মায়াটানে দাঁড় করায়।
আলেখ্য বিন্যাসের এমন স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত পরিসরে জনভূমি ও জীবনচরিত্রের জগৎ গড়ে তুলে, কাহিনিরূপের মতো কাহিনিকারের সার্থকতাও প্রকাশ পায়।